ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের কাছে বাংলা

ইংরেজি মাধ্যম স্কুল মানেই সেখানে বাংলার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই, বিষয়টি ঠিক এমন নয়। কারণ এসব স্কুলে এখন বাংলা পাঠদান বাধ্যতামূলক করেছে সরকার। তাই আবশ্যিক বিষয় হিসেবে প্রতিটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে শিক্ষার্থীদের বাংলা পড়তে হয়। প্রতি ক্লাসেই বাংলা বাধ্যতামূলক বিষয়। ‘ও’ লেভেল পরীক্ষায় বাংলা বিষয় আছে।

বিভিন্ন জাতীয় দিবস ও উৎসবের অনুষ্ঠানও পালন করা হয় বাংলায়। এমনকি স্কুলের শুরুটাও হয় জাতীয় সংগীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে। তবে দেশের জন্য ‘ও’ লেভেলে এখন বাধ্যতামূলক বাংলা পরীক্ষা দিতে হলেও ‘এ’ লেভেলে বাংলা বিষয়টি বাধ্যতামূলক নয়।এসব বিষয় নিয়েই ঢাকার কয়েকটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি হয়েছিলেন প্রতিবেদক পারভেজ দেওয়ান।

রায়হান শরীফ
স্ট্যান্ডার্ড এইট, একাডেমিয়া স্কুল

অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে আমাদের স্কুলে বাংলাও পড়ানো হয়। তবে যুক্ত বর্ণগুলো আমার কাছে একটু কঠিন লাগে। এছাড়া বলতে-লিখতে আর কোনো সমস্যা হয় না। তারপরও কোনো কিছুতে আটকে গেলে শিক্ষকের কাছ থেকে জেনে নেই। 

অঙ্কিতা মল্লিক
স্ট্যান্ডার্ড নাইন, ধানমণ্ডি টিউটোরিয়াল

ইংরেজি মাধ্যমের পড়ালেখার মান ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড। যেহেতু আব্বু-আম্মুর চাওয়া আমি দেশের বাইরে গিয়ে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করি, তাই আমাকে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে ভর্তি করে দেন। এখানে সবকিছু ইংরেজিতে হলেও বাংলা পড়তে বা লিখতে তেমন কোনো সমস্যা হয় না। কারণ বাসায় তো বাংলাতেই কথা বলি। 

আব্দুল্লাহ ইবনে ত্বকী
ও লেভেল পরীক্ষার্থী, ইউরোপিয়ান স্ট্যান্ডার্ড স্কুল

বাংলা বলতে সমস্যা হয় না, তবে লিখতে একটু সময় লাগে। ইংরেজি বর্ণের মতো বাংলা বর্ণগুলো সব সময় ‘স্ট্রেইট’ হয় না, অনেক কিছুই ঘুরিয়ে লিখতে হয়। এটা আমার একটু কষ্টকর মনে হয়। তাই প্রয়োজন হলে বাসায় আম্মুর সাহায্য নেই। 

জান্নাতুল নাইমা জান্নাত
স্ট্যান্ডার্ড সেভেন, ম্যাপললিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল

স্কুলে তো সব সময় ইংরেজিতেই লিখতে-পড়তে হয়। তবে বাংলা বিষয়ের ক্লাসে সবকিছু বাংলাতেই হয়। আমার কাছে বাংলা বলার চেয়ে লিখতে বেশি কঠিন লাগে। এ জন্য আমার বাসায় বাংলার জন্য একজন শিক্ষকও আছেন। তিনি আমাকে লিখতে সাহায্য করেন। 

ফাইয়াজ হোসেন ফারাশ
স্ট্যান্ডার্ড নাইন, সানিডেল স্কুল

বাংলা তো আমাদের মাতৃভাষা। তাই বলতে সমস্যা হয় না, তবে লিখতে গেলে কিছু কিছু শব্দ আছে যেগুলো কঠিন লাগে। বাংলা বই তো খুব একটা পড়া হয় না, তবে পড়ার সময় কোথাও আটকে গেলে শিক্ষক বা বড় ভাইদের সাহায্য নেই। বাংলা বিষয়ের ওপর ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোতে খুব একটা জোর দেওয়া হয় না। এটা করা গেলে বাংলা শেখাটা আরও সহজ হতো। 

ইয়াকিন সাজ্জাদ
ক্লাস-১২, কার্ডিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল

প্রশ্ন-১: ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের বাংলা ভাষা লিখতে এবং বলতে শেখার ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোনো ঘাটতি আছে বলে কি মনে করেন? এ ক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী?
উত্তর :
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় ইংরেজিকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়। যেমন-স্কুলে আমাদের বাংলায় কথা বলা নিরুৎসাহিত করা হয়। কেবল বাংলা ক্লাসেই বাংলা বলা যাবে। প্রতিদিন আটটা ক্লাসের মধ্যে কেবল একটা ক্লাস বাংলা থাকে, যেটা বাংলা ভাষা চর্চা করার জন্য খুবই কম সময়। 

আমার মতে, সপ্তাহের দিনগুলো ভাগ করে দুই দিন বাংলা আর তিন দিন ইংরেজিতে কথা করতে পারলে ভালো হতো। এছাড়া বাংলা বই পড়তে উৎসাহিত করা উচিত।

প্রশ্ন-২: ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে মূলধারার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিভিন্ন ভর্তি পরীক্ষায় প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা হয় কি? এ ক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী?
উত্তর:
হ্যাঁ, অসুবিধা হয়। ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে দেশের পাবলিক পরীক্ষা ও প্রতিযোগিতায় সমস্যা হয়। ভর্তি পরীক্ষায় ইংরেজি আর বাংলার মাধ্যমের সিলেবাসের মধ্যে সমন্বয় করলে আমাদের জন্য সুবিধা হবে।

প্রশ্ন-৩: আপনি কি মনে করেন ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে?
উত্তর:
আমার মতে বাংলা ভাষা চর্চায় ইংরেজি মিডিয়ামের শিক্ষার্থীরা বেশ পিছিয়ে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই আমাদের ইংরেজি চর্চার উপর বেশি জোর দেওয়া হয়। আমরা ইংরেজির ব্যবহার জানতে ইংরেজি সিনেমা, টিভি সিরিজ দেখি বা বই পড়ি। যার ফলে আমরা অন্য সংস্কৃতি সম্পর্কে জানলেও নিজেদের সংস্কৃতির ব্যাপারে বেশ পিছিয়ে। আমি মনে করি ইংরেজি ও বাংলা মিডিয়ামের নতুন প্রজন্মের সবাই নির্বিশেষে সংস্কৃতির দিক থেকে পিছিয়ে। 

শেহজাদ আহমেদ
ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ

উত্তর ১: অবশ্যই, ইংরেজি মাধ্যমের কিছু শিক্ষার্থীর মধ্যে ঘাটতি রয়েছে। বিশেষ করে লেখালেখির ক্ষেত্রে। আমাদের চেষ্টা করা উচিত ছোট বয়সেই শিক্ষার্থীদের বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। কারণ আমার অভিজ্ঞতায়, বেশিরভাগ ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা কখনোই বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হতে পারেনি।

উত্তর ২: ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা দুই ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে। আমাদের জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরীক্ষা এবং প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বীতা করা খুবই সহজ। কিন্তু দেশের পাবলিক পরীক্ষা ও প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া আমাদের জন্য দুঃস্বপ্নের মতো হয়। আমরা জানি আমাদের ঘাটতি আছে। তারপরও দেখা যায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের তুলনা করতে থাকেন।

উত্তর ৩: হ্যাঁ অবশ্যই। বাংলা পড়তে না পারা এবং ইচ্ছার অভাবে তারা স্বাভাবিকভাবেই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের দুর্দান্ত ইতিহাস তাদের অজানা থাকছে। যে কারণে তারা বাংলাকে সুন্দর ও সমৃদ্ধ ভাষার পরিবর্তে কঠিন ও জটিল বলে মনে করে। 

তানজীম কাসিম 
এ লেভেল, লন্ডন গ্রেস ইন্টারন্যাশনাল স্কুল

উত্তর ১: আমি মনে করি, ইংরেজি মাধ্যমের প্রতিষ্ঠানগুলো যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করে তাদের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে লিখতে ও বলতে শেখানোর। বাংলা ব্যাকরণ থেকে শুরু করে গল্পগুচ্ছের মতো বই কমবেশি সব ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোতে পড়ায়। বাংলা আর ইংরেজি মাধ্যমের মধ্যে পার্থক্য এটাই যে বাংলা মাধ্যমে সব বিষয় বাংলায়, আর ইংরেজি মাধ্যমে সব বিষয় ইংরেজিতে। কিন্তু আমি মনে করি যে, ভাষা শিক্ষার ব্যাপারে দুই দিকই সমান। 

উত্তর ২: হ্যাঁ, হয়। ইংরেজি আর বাংলার মাধ্যমের সিলেবাসের মধ্যে সমন্বয় থাকলে পিছিয়ে থাকার ভয় কিছুটা কমবে।

উত্তর ৩: না, এটা ইংরেজি বা বাংলা মাধ্যমের প্রভাবের চেয়ে বেশি ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে আমি মনে করি।

শাহাদত ইসলাম রায়হান
এ লেভেল, কার্ডিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল

উত্তর ১: না। তবে প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত করে বাংলা ভাষার প্রতি শিশুদের আকৃষ্ট করে তোলা যায়।

উত্তর ২: হ্যাঁ, ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে মূল ধারার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিভিন্ন ভর্তি পরীক্ষার প্রতিযোগিতায় সমস্যা হয়। দেখা গেছে, কারিকুলাম আলাদা হওয়ার কারণে ভর্তি পরীক্ষায় অনেক কম নম্বর পেয়ে থাকেন অনেক ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থী। তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পরীক্ষা ও প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বীতা করা সহজ হয় আমাদের জন্য।  

উত্তর ৩: না। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের তাদের মাতৃভাষার প্রতি অনেক আগ্রহ রয়েছে এবং তারা অনেক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে থাকেন।

জর্জ জেফারসন দেসা
এ লেভেল, প্রাইভেট ক্যান্ডিডেট

উত্তর ১: হ্যাঁ, আমি বিশ্বাস করি দক্ষ বাংলা শিক্ষকের অভাব, বা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে বাংলা পড়ানোর উপযুক্ত পদ্ধতির অভাব রয়েছে। এমনকি সেরা স্কুল থেকে স্নাতক হওয়া শিক্ষার্থীদেরও বাংলা পড়তে/লিখতে সমস্যা হয়। আমার পরামর্শ হবে বাংলা শেখানোর প্রচেষ্টা দ্বিগুণ করা।

উত্তর ২: হ্যাঁ, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের দেশের মূল ধারার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। কারণ পরীক্ষাগুলো জাতীয় পাঠ্যক্রমকে কেন্দ্র করে হয়। একটি সাধারণ সমাধান হলো ভর্তি পরীক্ষায় যাওয়ার আগে এইচএসসির সিলেবাস অনুযায়ী পড়াশোনা করা। আর সবচেয়ে ভালো হবে যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সব ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি নির্বাচন করে। 

উত্তর ৩: হ্যাঁ অবশ্যই।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //