ফিরে দেখা স্বাস্থ্য খাত-২০২১

উদ্বেগ, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি ছিল আলোচিত বিষয়

করোনার দ্বিতীয় বছরটি বাংলাদেশের জন্য সুখকর ছিল না। বছরটিতে করোনা সেবা নিয়েও হয়েছে দুর্নীতি। সংক্রমণের দ্বিতীয় বছরের এপ্রিল থেকে অক্টোবর এই সাত মাস বাংলাদেশের জন্য ছিল খুবই বেদনাদায়ক।

২০২০ সালের চেয়ে ২০২১ সালে যেমন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি আবার একইসঙ্গে করোনায় সর্বোচ্চ মৃত্যুও হয়েছে এই বছরটিতে। গেল বছরের ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত করোনায় ২৮ হাজার ৬১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর করোনায় আক্রান্ত হয়েছে ১৫ লাখ ৮৩ হাজার ৬২৬ জন। বিজ্ঞানীরা বেশ কয়েক বছর থেকেই ইমাজিং (উদীয়মান) এবং রিইমাজিং (পুনঃউদীয়মান) রোগ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়ে আসছিলেন। ডেঙ্গু ও ইবোলার চেয়ে ভয়াবহ ভাইরাস চলে আসতে পারে সামনের বছরগুলোতে।

এ ব্যাপারে দরিদ্র দেশ হিসেবে বাংলাদেশের করার কিছুই ছিল না। তবে বাংলাদেশ রোগ মোকাবেলায় মোটামুটি প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে পারতো। এমনকি ২০২০ সালের ডিসেম্বরে করোনা সংক্রমণ কমে আসার পরও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরও সংক্রমণ বাড়লে যে প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল তা নেয়নি। 

করোনার দ্বিতীয় বছরে স্বাস্থ্য খাতে শুধু নেই আর নেই: চীনে প্রথম ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে করোনা শনাক্ত হলেও বাংলাদেশে শনাক্ত হয়েছে ২০২০ সালের ৮ মার্চ। করোনাভাইরাস বাংলাদেশে আসতে তিন মাস সময় লাগলেও সরকারের কোনো প্রস্তুতি ছিল না। প্রস্তুতি যে ছিল না তা স্পষ্ট করে প্রকাশ হয়ে পড়েছে ২০২১ সালে। এই বছরই করোনার ডেল্টা ভাইরাসের সংক্রমণে সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ মারা যায় এবং সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। প্রথম বছর করোনার আদি ভাইরাসটিই মানুষকে সংক্রমিত করলেও খুব বেশি বিপদে পড়তে হয়নি; কিন্তু দ্বিতীয় বছর ২০২১ সালের মার্চের পর থেকে রূপান্তরিত ধরন ডেল্টা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহাল দশা প্রকটভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় শুধু ‘নেই আর নেই’।

করোনা আক্রান্ত রোগীর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় অক্সিজেনের। কারণ করোনা সংক্রমণ ঘটলে সব বয়সের মানুষের ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। স্বাভাবিক নিয়মে অক্সিজেন নিতে পারে না মানুষ। ফলে কৃত্রিমভাবে অক্সিজেন দিতে হয় রোগীকে বাঁচিয়ে রাখতে; কিন্তু ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণের সর্বোচ্চ পর্যায়টিতে অক্সিজেনের ছিল চরম সংকট। রোগীর আত্মীয়-স্বজনকে দেখা দেছে, বাইরে থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। অক্সিজেন ছাড়াও করোনা রোগীকে সেবা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও নার্স ছিল না। এমনকি ডাক্তার ও নার্সদের সুরক্ষার জন্য মানসম্মত পিপিই, মাস্ক ও গ্লোভসও ছিল না।

২০২০ সালে ডিসেম্বরের দিকে করোনা কমে যেতে থাকলে, ‘স্বাস্থ্য দপ্তর থেকে প্রায়ই শোনা যেত বাংলাদেশ থেকে করোনা শেষ হয়ে গেছে।’ শুধু আত্মতৃপ্তিতে ভুগেছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা। পরের বছরও যে ভাইরাসটি আঘাত হানতে পারে এবং তা মোকাবেলায় দীর্ঘ মেয়াদি কোনো পরিকল্পণা তাদের ছিল না। ফলে ২০২১ সালে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ শুরু হলে দিশেহারা হয়ে পড়েন স্বাস্থ্যকর্মীরা। মার্চে ডেল্টার সংক্রমণ সামান্য থাকলেও মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছিল ডেল্টার সর্বোচ্চ আঘাত। তবে একদিনে সর্বোচ্চ ২৮ জুলাই ১৬ হাজার ২৩০ জন করোনায় সংক্রমিত হয়েছে।

অপরদিকে ৫ ও ১০ আগস্ট এই দুই দিনে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ২৬৪ জন মারা গেছেন করোনায়। আগে থেকে দেশীয় এবং বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যবিদেরা পূর্বাভাস দিয়ে রেখেছিলেন যে, করোনা ভাইরাসটি নির্মূল হবে না। তবে নিয়ন্ত্রণ হবে; কিন্তু তা হতে কয়েক বছর লেগে যাবে। এই পূর্বাভাস সত্ত্বেও করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় যথেষ্ট জনবলের ব্যবস্থা করেনি সরকার। শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষকেই এর খেসারত দিতে হয়েছে ধন-সম্পদ হারিয়ে এবং জীবন দিয়ে। করোনা সংক্রমিত হয়ে হাসপাতালে গেলে দেখা গেছে, সিট খালি নেই। মুমূর্ষু অবস্থায় ঢাকার বাইরে থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসলে সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ নেই বলে রোগীকে ফেরত দেওয়া হয়েছে।

এদিকে বেসরকারি হাসপাতালগুলো বসেছিল টাকা কামানোর ধান্দায়। রোগীদের মধ্যে যাদের সামর্থ্য ছিল তারা বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে অন্তত অক্সিজেনের ব্যবস্থা করেছেন। এমনকি দেশের বাইরে থেকে মানুষ আসলেও তাদের যথাযথ কোয়ারেন্টিনও করতে পারেনি সরকার। সরকারি ব্যবস্থাপনায় কোয়ারেন্টিন থেকে করোনা সংক্রমিত ব্যক্তিরা পালিয়ে গেছে। এসব কারণে গত বছরের মার্চের পর থেকে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ দেখা গেছে দেশে।

টিকা ব্যবস্থাপনায় ছিল অদক্ষতা : এটা ঠিক বিশ্বে টিকা শুরুর এক মাস পরই বাংলাদেশে করোনার টিকা চলে আসে; কিন্তু সরকারি ব্যবস্থাপনায় না এনে বেসরকারি বেক্সিমকো গ্রুপকে টিকা আনার দায়িত্ব দেওয়া হলে দুই চালান (৭০ লাখ) আনার পরই ভারত থেকে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা পাঠানো বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এপ্রিল মাসের দিকে বাংলাদেশে টিকা ব্যবস্থাপনায় ধস নামে; কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কোভেক্স এগিয়ে আসে কিছু কিছু টিকা দিয়ে। দরিদ্র দেশ বলে বাংলাদেশকে বিনামূল্যে প্রায় চার কোটি টিকা দেওয়ার অঙ্গীকার করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তা দিয়ে টিকাকরণ কর্মসূচি চালিয়ে নেয় সরকার। পরে এগিয়ে আসে চীন সিনোফার্মের টিকা নিয়ে। এভাবে সংকটটা কাটিয়ে উঠতে পারে। এখনো যে হারে টিকা আসছে তাতে বড় ধরনের কর্মসূচি হাতে নিয়ে ব্যাপক সংখ্যক মানুষকে টিকা দেওয়ার মতো পরিস্থিতি সরকারের নেই।

এদিকে বাংলাদেশেই টিকা তৈরির একটি চেষ্টা হয়েছে। ইনসেপ্টা ফার্মা দেশেই টিকা তৈরির জন্য সিনোফার্মের সঙ্গে চুক্তি করেছিল; কিন্তু এ প্রক্রিয়াটিও চলছে ঢিমেতালে। বাংলাদেশের প্রায় চার কোটি মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে; কিন্তু বিপদটা এখানেই বলছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। টিকাধারী ও টিকাবিহীন মানুষ একত্রে বসবাস করায় এখান থেকে টিকা প্রতিরোধী অন্য কোনো করোনার ধরন সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে। সে জন্য খুব দ্রুততার সঙ্গে জনগোষ্ঠীর সবাইকে টিকার আওতায় নিয়ে আসার জন্য জনস্বাস্থ্যবিদরা বললেও, এ ব্যাপারে সরকারের কোনো পরিকল্পনা আছে বলে মনে হচ্ছে না।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি ছিল আলোচিত ঘটনা : স্বাস্থ্য খাতে নিয়োগে গত বছরটিতে ঘটেছে ঘুষ বাণিজ্য, হয়েছে কেনাকাটায় দুর্নীতি। আর নানা ধরনের অনিয়ম তো রয়েছেই। মহামারির এই বছরটিতে স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম ও দুর্নীতির পরিমাণ অনেক বেড়েছে বলে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবি উল্লেখ করেছে। করোনাভাইরাস মহামারিকে কেন্দ্র করে স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির মহোৎসব হয়েছে।

স্বাস্থ্যখাতে এক হাজার ৮০০ চাকরির নিয়োগ নিয়ে কোটি টাকার ঘুষের প্রস্তাব, স্বাস্থ্য খাতে সাড়ে তিনশ’ কোটি টাকার কেনাকাটায় অনিয়ম হয়েছে। করোনাভাইরাস সংকট শুরু হওয়ার পর স্বাস্থ্য খাতের নাজুক অবস্থার চিত্রটি প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে। দরকারি উপকরণের অভাব, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগ, হাসপাতালে সেবার অভাব, নিয়োগ আর কেনাকাটায় একের পর এক দুর্নীতির খবর যেন এই খাতের বেহাল দশাকেই তুলে ধরেছে। মাস্ক কেলেঙ্কারি, কোভিড টেস্ট নিয়ে জালিয়াতি, জেকেজি আর রিজেন্ট হাসপাতালের মতো বড় আর আলোচিত ঘটনার পরও, গেল বছরটিতে স্বাস্থ্য খাতে শত শত কোটি টাকার কেনাকাটায় অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অথবা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোনো কর্মকর্তা এসব বিষয়ে কথা বলতে চান না।

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব অভিযোগের ব্যাপারে তদন্ত বা ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো তথ্য তাদের জানা নেই। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ নতুন নয়। 

২০১৯ সালে একটি প্রতিবেদনে স্বাস্থ্যখাতে কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, চিকিৎসাসেবা ইত্যাদি মিলিয়ে দুর্নীতি বেশি হয়, এমন ১১টি খাত চিহ্নিত করে প্রতিবেদন দিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন।

দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবি একটি প্রতিবেদনে বলেছিল, করোনাভাইরাস সংকটের সময় অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে আস্থার সংকটে পড়েছে স্বাস্থ্য খাত। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ স্বাস্থ্য খাতে অনেক পুরনো, ব্যবস্থা না নেওয়ায় কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। 

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ ব্যাপারে বলেছেন, যেখানে সরকারি কর্মকর্তারা জড়িত, সেখানে দুর্নীতি বা অনিয়মের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা বা রাজনৈতিক ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, এরকম ক্ষেত্রে খুব কমই আমরা কোনো পদক্ষেপ দেখতে পাই। এ কারণে দুর্নীতির ব্যাপকতা বেড়েই চলেছে। আর এই মহামারিকে দুর্নীতির একটি মহোৎসবে পরিণত করা হয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //