ফিরে দেখা-২০২১

মেগা প্রকল্পের কাজে গতি ছিল করোনাকালেও

২০২১ সালের একেবারে শেষ মুহূর্তে উপস্থিত আমরা। করোনাকালীন এই সময়ে কেমন ছিল আমাদের বাংলাদেশ? ভয়, অস্থিরতা আর অসংখ্য সমস্যার মাঝেও সামনের দিকে পা ফেলে এগিয়ে চলেছে দেশ।

এ বছর নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি ছিল এমন পরিস্থিতিতে সরকারের মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ চালিয়ে নেওয়া। আর এসব কাজে গতি ছিল বলেই ২০২২ সালে বড় কয়েকটি প্রকল্প জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য চালু করা হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। এর মধ্যে সবার আগে চালু হবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। সম্ভবত, ২০২২ সালের জুনের মধ্যেই পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হতে পারে। আর ঢাকায় মেট্রো রেলের আগারগাঁও থেকে দিয়াবাড়ী অংশে যাত্রী পরিবহন, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী টানেল খুলে দেওয়া, ঢাকায় বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েও চালু হবে ২০২২ সালে। মেগা প্রকল্পের কাজে গতি ছিল বিদায়ী ২০২১ বছরজুড়েই।

বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণ বিভাগ বলছে, বর্তমান সরকারের বিশেষ অগ্রাধিকারভুক্ত প্রকল্পগুলোর মধ্যে বহুল আলোচিত পদ্মা সেতুর কাজ ৯৪ দশমিক ২৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। আর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সার্বিক অগ্রগতি ৩৭ দশমিক ২৯ শতাংশ, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের অগ্রগতি ৪৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ এবং রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের অগ্রগতি ৬৮ দশমিক ৮৫ শতাংশের মতো। 

করোনার কারণে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজের গতি কিছুটা কমে গিয়েছিল। এখন পুরোদমে চলছে এর কাজ। ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে মেট্রোরেলের আনুষ্ঠানিক ট্রায়াল। এ ছাড়া এই প্রকল্পে ২৭ কিলোমিটার রেল ট্র্যাকের কাজ দৃশ্যমান হয়েছে। প্রকল্পের প্রথম অংশ উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে মিরপুর (আগারগাঁও) অংশের অগ্রগতি ৮৭ দশমিক ৮০ শতাংশ এবং আগারগাঁও থেকে মতিঝিলের অগ্রগতি ৬৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ। জাপানের সহায়তায় ২০১২ সালের জুলাই মাসে মেট্রোরেল প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয়। প্রায় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার প্রকল্পে জাপান সরকারের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা ঋণ দিচ্ছে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা।

অবশ্য এই মেগা প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়ে আইএমইডি সন্তুষ্ট নয়। আইএমইডি বলেছে, জাতীয় অতি গুরুত্বপূর্ণ বিশাল এ প্রকল্পে যে ধরনের গতি থাকা প্রয়োজন কার্যত তা নেই। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে বাস্তবসম্মত সময়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা করার সুপারিশ করেছে আইএমইডি। অবশ্য কর্তৃপক্ষ বলছে, মেট্রো রেল চালু হতে পারে ২০২৩ সালের জুনের পর। এই প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। এটি চালু হলে রাজধানীর ওপর যানবাহনের চাপ কমবে। এতে কমবে যানজট। ঢাকার যানজট নিরসনে এখন মেট্রোরেল ছাড়া আর বিকল্প নেই। তাই যত দ্রুত চালু হবে, ততই মানুষ উপকৃত হবে।

সূত্র বলছে, পদ্মা সেতুর মূল অংশের ২ হাজার ৯১৭টি রোডওয়ে স্লাবের সব কটি স্থাপনা সম্পন্ন হয়েছে। ফলে পূর্ণাঙ্গ রূপ পেয়েছে এই সেতু। এখন পিচঢালাই হয়ে গেলেই ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতুর সড়কপথ যান চলাচলের উপযোগী হয়ে যাবে। করোনার কারণে মাঝখানে কাজের গতি কমলেও বর্তমানে পুরোদমে কাজ চলছে। প্রায় ২০ বছর আগে ২০০১ সালে মাওয়া পুরান ফেরিঘাটে মাছবাজার-সংলগ্ন এলাকায় এ সেতুর ফলক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর সরকার বদল হলে কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৯ সালে আবার তোড়জোড় শুরু হয় পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজের গতি। তখন দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে বন্ধ থাকে এ সেতুর নির্মাণকাজ। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদক্ষেপে ২০১৪ সালের ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর মূল নির্মাণকাজ শুরু হয়।

২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে প্রথম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে দৃশ্যমান হয় সেতুর অবকাঠামো। এরপর একে একে ৪২টি পিলারে ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যর ৪১টি স্প্যান বসিয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু পুরোপুরি দৃশ্যমান হয়েছিল ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর। ২০২২ সালের জুন মাসের মধ্যেই এ সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার কথা রয়েছে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম টানেলের নামকরণ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’। এই টানেল নির্মাণের কাজ চলছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে। করোনা মহামারির কারণে এর কাজও থেমে নেই। ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ হতে পারে। এখন পর্যন্ত এ প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।

প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা জানান, বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্পটি বাংলাদেশ ও চীন সরকারের (জি টু জি) যৌথ অর্থায়নে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রকল্পটির মোট ব্যয় ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ৪ হাজার ৪৬১ কোটি ২৩ লাখ আর চীন সরকারের ঋণ ৫ হাজার ৯১৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা। মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩১৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে টানেলের প্রতিটি টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার এবং ব্যাস ১০ দশমিক ৮০ মিটার। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে স্বপ্নের টানেল নির্মাণ হলে বদলে যাবে চট্টগ্রামের চিত্র। আমূল পরিবর্তন আসবে অর্থনৈতিক আঙিনায়। প্রতিষ্ঠিত হবে বহুমুখী যোগাযোগব্যবস্থা।

দোহাজারী থেকে কক্সবাজার ও রামু থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের কাজ চলছে পুরোদমে। এই প্রকল্পটি চালু হলে কক্সবাজারের সঙ্গে রেলযোগাযোগ বাড়বে। প্রকল্প পরিচালক জানিয়েছেন, ২০২২ সালের জুনে না হলেও ডিসেম্বরের মধ্যেই রেলপথটি রেল চলাচলের উপযোগী করে গড়ে তোলা সম্ভব হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ে করিডোরের সঙ্গে বাংলাদেশের সংযোগ স্থাপন হবে। 

প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে। প্রায় ত্রিশটিরও বেশি দেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে পারমাণবিক প্রযুক্তির আর্থিক, কারিগরি ও পরিবেশগত সুবিধাদির বিষয়টি বিবেচনায় এ প্রযুক্তি ব্যবহারের গ্রহণযোগ্যতা আজ সর্বজনবিদিত। আজকের বিশ্বে ঘনবসতিপূর্ণ ও স্বল্প জ্বালানি সম্পদের অধিকারী উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত রাষ্ট্রসমূহ তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিতকল্পে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কর্মসূচিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি অন্যতম বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করেছে।

বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে। অর্থের বিবেচনায় এটি দেশের অন্যতম বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প। এই প্রকল্পের ব্যয় ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। এখন পর্যন্ত সার্বিক অগ্রগতি ৩৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এ পর্যন্ত ব্যয় করা হয়েছে ৪২ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা।

ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর নাগাদ প্রকল্পটির কাজ শেষ হবে। এ ছাড়া কক্সবাজারের মহেশখালীতে ১২০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রকল্পটি নেওয়া হয় ২০১৪ সালের জুলাই মাসে। মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র নামের এই প্রকল্পের কাজ এখন পর্যন্ত শেষ হয়েছে ৪৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ। ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকার প্রকল্পে এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১৭ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে জিওবি অংশে ২ হাজার ৪১০ কোটি টাকা, প্রকল্প সাহায্য অংশে ১৪ হাজার ৭৯৭ কোটি টাকা এবং সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন থেকে ২৫৮ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। জাপান সরকারের সহযোগিতায় এ প্রকল্পটি ২০২৩ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা।

বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ উদ্যোগে আরও একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে, যার নাম রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। এর কাজ শুরু হয়েছে ২০০৯ সালের জুলাই থেকে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি। এতে ব্যয় ধরা হয় ১৬ হাজার কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত প্রকল্পের অগ্রগতি ৬৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ।

করোনাকালেও মেগা প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে। আর এভাবেই বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ২০২২ সালেই জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প। এই প্রকল্পগুলোর সঙ্গে যুক্ত আছে দেশের সম্মান আর জনগণের আবেগ। ফলে যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গেই এসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //