আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ২০২১ সালের ব্যর্থতাগুলো

নতুন আরেকটি বছর শুরু হয় ১২ মাসের প্রতিটি দিনের ঘটনার আমন্ত্রণে। এই আমন্ত্রণ সফলতার, ব্যর্থতার। সফলতার গুণগান ও ব্যর্থতা কাটিয়ে ওঠার প্রত্যয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়াই কালের রীতি।

গত বছরের মতো ২০২১ সালও সংকটে ছিল কোভিড-১৯ মহামারি নিয়ে। বছরজুড়ে কিছুটা স্থিতাবস্থা থাকলেও, সম্প্রতি নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনে পুনরুজ্জীবিত হয়েছে কোভিড-১৯। সেইসঙ্গে চলতি বছর ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের অবিচল ধারা, যা প্রকৃতিকে ক্রমেই করে তুলছে জীববৈচিত্র্যের প্রতিকূল। আর ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা, বিশেষ করে বিশ্বের দুই ক্ষমতাধর দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের পরস্পরের প্রতি বৈরী মনোভাব। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ২০২১ ছিল অপকর্ষতার বছর।

২০২০ সাল যতটা কঠিন ছিল, ঠিক ততটাই আশার আলো জ্বেলে শেষ হয়। ওই বছর কার্যকরী কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন পেয়েছে বিশ্ব। যুক্তরাষ্ট্রবাসী পেয়েছিল নতুন প্রেসিডেন্ট, যিনি তার পূর্বসূরির মতো নন। জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি ও আমেরিকার মিত্রদের গুরুত্ব দিয়েছেন। ন্যাটোবাহিনী নতুন ‘স্ট্র্যাটেজিক কনসেপ্ট’ তৈরি করেছিল। সব কিছু মিলিয়ে ২০২০ সালে চ্যালেঞ্জ থাকলেও শেষ হয় ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত চলতি বছর চ্যালেঞ্জগুলো কেবল বেড়েছে, এখনো বাড়ছে। মহামারি ঠেকাতে অভূতপূর্ব বৈশ্বিক সামাজিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় গোটা বিশ্বে মারাত্মক চাপ এ বছরও ছিল। এই সামাজিক পরীক্ষায় ছিল ঘরবন্দি মানুষের আর্তি। এ ছাড়া গভীর মেরুকরণে বিচ্ছিন্ন হয়েছে গণতন্ত্রের স্তর।

লকডাউনের অনস্বীকার্য মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতি ছাড়াও ক্ষমতার অপব্যবহারে সামাজিক চুক্তি সম্পর্কে নাগরিকদের ধারণার মতো বিষয়গুলোয় জনগণের সমর্থন ভবিষ্যতে আর নাও থাকতে পারে। এ অবস্থা বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের জন্য হুমকি বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে এক ভার্চুয়াল শীর্ষ সম্মেলন আহ্বান করেছেন। এই ভার্চুয়াল সম্মেলনের অতিথিদের তালিকাও প্রশ্নবিদ্ধ; কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, গণতন্ত্র নবায়ণের জন্য আরও কিছু মৌলিক বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। 

২০২১ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতেও ছিল সামঞ্জস্যহীনতা। কিছু দেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ইতিবাচক জানালেও অন্যরা রয়ে গেছে লাইফ সাপোর্টে। এখন সরবরাহ ঘাটতি, জ্বালানি মূল্যের ঊর্ধ্বগতি, কোভিডের নতুন ভ্যারিয়েন্টকে দূরে রাখতে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞার নতুন ঢেউ, লকডাউন-সার্বিক পরিস্থিতি নতুন করে নীতিনির্ধারকদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া ক্রমবর্ধমান আর্থিক ঝুঁকি এবং মূল্যস্ফীতির চাপের মধ্যে নীতিনির্ধারক এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভারসাম্যমূলক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হচ্ছে। 

মহামারি চলাকালে কার্যকর বহুপক্ষীয় পদক্ষেপের অভাব, ভ্যাকসিন বণ্টনে অসঙ্গতি, চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলায় ঐক্যের অভাবে বৈশ্বিক সিস্টেমের অপর্যাপ্ত সক্ষমতা আরও প্রকটভাবে গোটা বিশ্বের সামনে উঠে এসেছে। আর এর সমাপ্তি ঘটেছে যুক্তরাজ্যের গ্লাসগোয় অনুষ্ঠিত জাতি সংঘের হতাশাজনক জলবায়ু সম্মেলনের মধ্য দিয়ে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার প্রতি আস্থা কমে যাওয়ার বিষয়টি খারাপ সময়ে আসতে পারে না। রাশিয়া এখন ইউক্রেন সীমান্তে সৈন্য জড়ো করছে। সেইসঙ্গে চীনের আচরণও বেশ বৈরী। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সংঘাতের ঝুঁকি আরও বাড়ছে।

ধারাবাহিকভাবে অনুষ্ঠিত ভার্চুয়াল সামিটগুলো উদ্বেগ কমাতে ব্যর্থ হয়েছে। এ ছাড়া নতুন নিরাপত্তা ব্যবস্থা- বিশেষ করে কোয়াড, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের চারটি প্রধান গণতন্ত্রের জোট এবং অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের এইউকেইউএস প্রতিরক্ষা চুক্তিতে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। অতএব, কোয়াড ও এইউকেইউএস চুক্তির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা জরুরি। ধারণা করা হয়, চীনকে মোকাবেলা করার জন্যই এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ঐতিহাসিক এইউকেইউএস নিরাপত্তা চুক্তি করেছিল যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়া। চুক্তিটি নিয়ে আশাবাদী ছিলেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এইউকেইউএস জোট সম্ভবত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তিন দেশের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা সংক্রান্ত পদক্ষেপ। এই পটভূমিতে ২০২২ সালে আরও অসম যুদ্ধ এবং ভূরাজনৈতিক উদ্বেগের আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। আগামী বছরের অক্টোবরে ২০তম ন্যাশনাল কংগ্রেসের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি। এর নেতারা জলবায়ু পরিবর্তনের মতো চ্যালেঞ্জিং বিষয়ে সহযোগিতার প্রস্তাব দেবেন। এ পরিস্থিতি চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবেলার সব পশ্চিমা চেষ্টাকে জোরালোভাবে প্রতিহত করবে।

শক্তির অবস্থান থেকে আলোচনা করতে হলে এক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্বকে অবশ্যই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে ট্রান্সআটলান্টিক সম্পর্কে। নির্বাচনি প্রচারকালে বাইডেনের পুনরাবৃত্তি করা স্লোগান ছিল ‘আমেরিকা ফিরে এসেছে’ (আমেরিকা ইজ ব্যাক)। এই স্লোগান সেই সময়ে বাইডেনের পূর্বসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ মতবাদের প্রত্যাখ্যান বলে মনে করা হয়েছিল। তবে এখনো ট্রান্সআটলান্টিক সম্পর্ক শক্ত অবস্থানে নেই। এক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইউরোপিয়ান ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামে শুল্ক বসানোর উদাহরণটি তুলে ধরা যায়। বাইডেন প্রশাসন এই শুল্ক তুলে নেওয়ার ঘোষণা দিলেও গত মাস পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সাম্প্রতিকতম ট্রান্সআটলান্টিক স্কোরকার্ড অনুযায়ী, ইউএস-ইউরোপিয়ান সম্পর্কের মানসূচক চলতি বছরের জুনের শেষ নাগাদ গড়ে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ থাকলেও, তা সেপ্টেম্বর শেষে ৫ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। ট্রান্সআটলান্টিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে হোয়াইট হাউসের দৃঢ় সংকল্প প্রদর্শনের বিষয়টি পুরোপুরি বাইডেনের ওপর নির্ভরশীল; কিন্তু এটা শিগগিরিই হবে বলে মনে হয় না। আমেরিকান রাজনৈতিক পরম্পরার ইতিহাস দেখলে বোঝা যায়, প্রেসিডেন্টরা তাদের দ্বিতীয় মেয়াদে পররাষ্ট্র নীতির দিকে বেশি মনোযোগ দেন। কারণ সেই সময় পুনরায় নির্বাচনের মুখোমুখি হতে হয় না।

সেই হিসাবে, বাইডেন এখন নভেম্বরের মধ্যমেয়াদি কংগ্রেশনাাল নির্বাচন ও রিপাবলিকান পার্টির ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে ট্রাম্পের সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তন নিয়ে ব্যস্ত। এ কারণেই ২০২২ সালে ইউরোপকে অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বৃহত্তর কৌশলগত স্বাধীনতা সুরক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে। তবে ইউরোপের সফলতা সহজে আসবে না। কারণ দীর্ঘ ১৬ বছর পর ইউরোপের বিদেশ নীতি জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেলের ছত্রছায়ায় থাকছে না। অতএব, ইউরোপকে নিজের অবস্থান ঠিক রাখতে নতুন পথ খুঁজতে হবে। 

মের্কেলের উত্তরসূরি ওলাফ স্কোলজ সম্প্রতি ফ্যান্সের রাজধানী প্যারিসে বৈঠক করেছেন প্রেসিডেন্ট ইম্যানুয়েল ম্যাখোঁর সঙ্গে। বৈঠকে দু’জনই আনুষ্ঠানিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ‘কৌশলগত সার্বভৌমত্ব’ শক্তিশালী করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন; কিন্তু কথা ও কাজের মধ্যে বিস্তর ফারাক দেখা যায় ইউরোপজুড়ে। এক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় হবে না। কারণ ফ্রান্স ও জার্মানি ইইউর প্রধান চালিকাশক্তি নয়। ব্রেক্সিট পরবর্তী ইউরোপে ইতালীয় প্রধানমন্ত্রী মারিও দ্রাঘি ইতালিকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যেতে কাজ করছেন। ইউরোপের জন্য তার কৌশলগত স্বাধীনতা শক্তিশালী করা গুরুত্বপূর্ণ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের দিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //