২০২২ সালের আলোচিত ২২ ঘটনা

২০২২ সালে বাংলাদেশসহ বিশ্বে ঘটে গেছে নানা ঘটনা। বহু ঘটনা অঘটনের সাক্ষী হয়ে থাকবে বছরটি। আসুন জেনে নিই ২০২২ সালের আলোচিত ২২টি ঘটনা।

১. দ্বিতীয় এলিজাবেথের বিদায়
চলতি বছরে ৮ সেপ্টেম্বর বৃটিশ ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় দেশ শাসনকারী রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ৯৬ বছর বয়সে মারা যান। ফেব্রুয়ারিতে এলিজাবেথ সিংহাসনে আরোহণের ৭০ বছর বা প্লাটিনাম জুবিলি উদযাপন করেন। ১৯ সেপ্টেম্বর লন্ডনে জনাকীর্ণ রাস্তায় ঐতিহাসিক জমকালো রাষ্ট্রীয় অন্তেষ্টিক্রিয়ায় সারা বিশ্বের নেতারা অংশ নেন।  

২. ইউক্রেন যুদ্ধ
২০২২ সালে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল ইউক্রেন যুদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে শক্তিশালী করছে অভিযোগ তুলে রাশিয়া ২৪ ফেব্রুয়ারি দেশটিতে আক্রমণ শুরু করে। জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠন যুদ্ধ বন্ধ করতে বললেও বছরের শেষ দিকে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার হুমকি দেন। বিশ্ব অর্থনীতি করোনায় সংকট কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই এ যুদ্ধ শুরু হয়। যার ফলে অনুন্নত ও উন্নয়ন দেশগুলোতে খাদ্যমূল্য বেড়ে যায়। 

৩. ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন
১০ ও ২৪ এপ্রিল দুই দফায় ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। এতে মেরি লিপেনকে হারিয়ে নিজের অবস্থান অক্ষুণ্ন্ন রাখেন ইমানুয়েল ম্যাক্রঁ। 

৪. ব্রিটেনে এক বছরে তিন প্রধানমন্ত্রী
ব্রিটেনে প্রধানমন্ত্রীর পদে দুইবার রদবদল ঘটেছে। বরিস জনসন ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এরপর এ পদে আসেন লিজ ট্রাস। ৪৪ দিন ওই পদে থাকার পর তাকে ইস্তফা দিতে হয়। এরপর ক্ষমতায় আসেন প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রথম ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋশি সুনাক। মূলত অর্থনৈতিক কর্মসূচিতে ব্যর্থতা এবং নিজের দল কনজারভেটিভ পার্টিতে আস্থা হারানোর পর ২০ অক্টোবর পদত্যাগ করেন ট্রাস। এরপর দলীয় ভোটে জিতে সরকারের হাল ধরেন সুনাক। 

৫. ফিলিপাইনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন
ফিলিপাইনের জনগণ যে একনায়ক ফার্ডিনান্ড মার্কোসকে এক সময় গণ-আন্দোলনের মুখে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছিল তারই ছেলে দেশটিতে ক্ষমতার শীর্ষ পদে ফিরে এসেছেন। ৯ মে সে দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। এতে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ফার্ডিনান্ড মার্কোস জুনিয়র (বংবং মার্কোস) ও রেনি রোব্রেদোর। রোব্রেদো বিদায়ি প্রেসিডেন্ট রড্রিগো দুতার্তে ভাইস প্রেসিডেন্ট  ছিলেন।

৬. হংকংয়ে প্রধান নির্বাহী নির্বাচন
হংকংয়ের প্রধান নির্বাহী নির্বাচন ৮ মে অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন মূলত দুটি কারণে সবার নজর ছিল। একটি হলো গণতন্ত্রপন্থিদের দীর্ঘ আন্দোলনের প্রভাব পর্যবেক্ষণ করা। ২০১৯ সালে শুরু হওয়া ওই আন্দোলন যদিও পরের বছর করোনার থাবায় থিতিয়ে পড়েছিল কিন্তু তার রেশ এখনো রয়ে গেছে বলে মনে করা হয়। আরেকটি কারণ হলো স্বশাসিত অঞ্চলটি চীনের কাছে হস্তান্তরের ২৫ বছরের মাথায় এ নির্বাচন হয়। 

৭. ইমরান খান আবারও রাজপথে
পাকিস্তানে অনাস্থা ভোটে ক্ষমতা হারালেও নতুন শক্তি সঞ্চয় করে রাজনীতির মাঠে ফেরেন তেহরিক-ই-ইনসাফ। যার প্রধান ইমরান খান। ৯ এপ্রিল তার কোয়ালিশনের পতন ঘটে। এরপর থেকে বলতে গেলে প্রায় পুরোটা বছর তিনি রাজনীতির মাঠ গরম রাখেন। ৩ নভেম্বর পাঞ্জাবের ওয়াজিরাবাদে সমাবেশ চলাকালে তাকে হত্যার এক ব্যর্থ চেষ্টা চালানো হয়। 

৮. রাজাপক্ষে পরিবারের বিদায়
প্রবল গণজোয়ারের মুখে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজপক্ষ দেশছাড়া হন জুলাইতে। ৯ জুলাই প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে সাধারণ জনতা ঢুকে পড়ার দৃশ্যগুলো সামাজিক মাধ্যমে আলোড়ন তোলে।

৯. আম আদমি পার্টির উত্থান
ভারতের দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরভিন্দ কেরিওয়ালের নেতৃত্বাধীন আম আদমি পার্টি গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনে পাঁচটি আসন পায়। বিজেপি যথারীতি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন ধরে রাখে।

১০. শিনজো আবে হত্যা
জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো একটি রাজনৈতিক সমাবেশ চলাকালে ৮ জুলাই নিহত হন। শান্তিপ্রিয় দেশ হিসেবে পরিচিত জাপানে সে দেশেরই একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। 

১১. কাতার বিশ্বকাপ
২০ নভেম্বর থেকে ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত কাতারে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বকাপ ফুটবলের ২২তম আসর। সেই বিশ্বকাপে ৩৬ বছর পর মেসির দল আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হয় এবং রানার্স আপ হয় ফ্রান্স।

১২. ইরানের মাসা আমিনি
২২ বছর বয়সী মাসা আমিনি ইরানের তথাকথিত নৈতিকতা রক্ষার দায়িত্বে থাকা পুলিশ বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু ঘটে। পরে ইরানী নারীদের বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠে পুরো দেশ।

১৩. ৮ বিলিয়নে দাঁড়ালো বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা 
চলতি বছরে বিশ্বের জনসংখ্যা ৮ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। জাতিসংঘ বলছে, সাত বিলিয়নের মাইলফলক অতিক্রম করার মাত্র ১১ বছরের মধ্যেই আট বিলিয়নে পৌঁছে গেলো বিশ্বের জনসংখ্যা।

১৪. ইউক্রেন রকেটে প্রাণ গেল বাংলাদেশি হাদিসুরের
৯ মার্চ ইউক্রেনে রকেট হামলায় বাংলাদেশি নাবিক থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমান নিহত হন। তার মরদেহ ১৫ মার্চ দেশে আসে। ঘটনাটি দেশব্যাপী ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে।

১৫. সন্তানের সামনে মাকে হত্যা
দেশে আলোচিত ঘটনার মধ্যে ২৬ মার্চ রাজধানীর সবুজবাগের একটি বাসায় দুই শিশুসন্তানের মুখ বেঁধে তাদের মাকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। নিহত নারীর নাম মুক্তা আক্তার।

১৬. বুয়েট শিক্ষার্থীর ফারদিনে মৃত্যু রহস্য 
চলতি বছরের ৭ নভেম্বর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র ফারদিন নূর পরশের লাশ উদ্ধার করে নৌ-পুলিশ। লাশ ময়নাতদন্তের পর চিকিৎসক দাবি করেন-তিনি হত্যার শিকার হয়েছেন। পরবর্তীতে এই ঘটনা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভিন্ন আলোচনা সমালোচনার জন্ম হয়। এরপর গেল ১৪ ডিসেম্বর পুলিশ জানায়- ফারদিন নূর পরশ নিজেই আত্মহত্যা করেছে। অন্যদিকে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‍্যাবের দাবি- আত্মহত্যা নয়! ফারদিন নূর পরশ স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করেছে। 

১৭. আদালত থেকে জঙ্গী ছিনতাই
২০ নভেম্বর পুলিশের উপর হামলা ও পুলিশের চোখে স্প্রে করে প্রকাশক দীপন হত্যা মামলায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি আসামিকে আদালত প্রাঙ্গণ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় তাদের অন্যান্য জঙ্গিরা। পরে এই ঘটনায় রাজধানীসহ সারাদেশে রেড অ্যালার্ট জারি হলেও এখনো মূল অপরাধীরা গ্রেপ্তার হয়নি। তবে এই ঘটনায় অপরাধীদের সহযোগিতা করার জন্য মেহেদী হাসান অমিকে (২৪) গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

১৮. ঢাবি শিক্ষককে গণপিটুনি 
চলতি বছরের ২ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) এলাকায় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক সহযোগী অধ্যাপকের গাড়ির নিচে চাপা পড়ে এক নারীকে এক কিলোমিটার টেনে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। ওই নারীকে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এসময় গাড়িচালক ঢাবি শিক্ষক গণপিটুনির শিকার হন। আহত গাড়িচালক আজহার জাফর শাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক সহকারী অধ্যাপক। 

১৯. আলোচিত ১০ ডিসেম্বর
চলতি বছরের বিএনপির ১০ ডিসেম্বর এর গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপি ও পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এদিন নয়াপল্টনে বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে একজন নিহত হন। এই ঘটনায় শতাধিক মানুষ আহতও হয়। নিহতের নাম মকবুল হোসেন (৩০)। দেশে উত্তেজনা বিরাজ করার ফলে যুক্তরাজ্যর নিজস্ব ওয়েবসাইটে বাংলাদেশে ভ্রমণের বিষয়ে সতর্কজারি করে।

২০. দেশের দীর্ঘতম সেতু
পদ্মা সেতু বা পদ্মা বহুমুখী সেতু হচ্ছে বাংলাদেশের পদ্মা নদীর উপর নির্মিত একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু। এর মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের সাথে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলা যুক্ত হয়েছে। সেতুটি ২০২২ সালের ২৫ জুন উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই সেতুটি পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং নির্মাণ প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত ছিল। সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিমি (৩.৮২ মাইল)। এটি বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু, স্প্যান সংখ্যা ও মোট দৈর্ঘ্য উভয়ের দিক থেকে গঙ্গা নদীর উপর নির্মিত দীর্ঘতম সেতু এবং ১২০ মিটার (৩৯০ ফুট) গভীরতাযুক্ত বিশ্বের গভীরতম পাইলের সেতু। সেতুটি চালু হওয়ার পর বাংলাদেশের জিডিপি ১.২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

২১.দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম ও দীর্ঘতম সুড়ঙ্গপথ বা টানেল 
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল বা বঙ্গবন্ধু টানেল বা বঙ্গবন্ধু সুড়ঙ্গ বা কর্ণফুলী সুড়ঙ্গ হল কর্ণফুলী নদীর নিচে অবস্থিত নির্মাণাধীন সড়ক সুড়ঙ্গ। এই সুড়ঙ্গটি কর্ণফুলী নদীর দুই তীরের অঞ্চলকে যুক্ত করবে। এই সুড়ঙ্গ মধ্য দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক যুক্ত হবে। বঙ্গবন্ধু টানেলের দৈর্ঘ্য ৩.৪৩ কিলোমিটার। এই সুড়ঙ্গটি নির্মাণ হলে এটিই হবে বাংলাদেশের প্রথম সুড়ঙ্গ পথ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় নদী তলদেশের প্রথম ও দীর্ঘতম সড়ক সুড়ঙ্গপথ। চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন এ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) এই সুড়ঙ্গ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। চট্টগ্রাম শহরপ্রান্তের নেভাল একাডেমির পাশ দিয়ে শুরু হওয়া এই সুড়ঙ্গ নদীর দক্ষিণ পাড়ের আনোয়ারা প্রান্তের চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড এবং কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার লিমিটেড কারখানার মাঝামাঝি স্থান দিয়ে নদীর দক্ষিণ প্রান্তে পৌঁছাবে। কর্ণফুলী নদীর মধ্যভাগে কর্ণফুলী সুড়ঙ্গ অবস্থান করবে ১৫০ ফুট গভীরে।

২২.দেশে প্রথম মেট্রোরেল
দেশে প্রথম মেট্রোরেল যাত্রা শুরু হয়েছে। বুধবার ২৮ ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটি উদ্বোধন করেন। শুরুতে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চলবে মেট্রোরেল। মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রায় ১২ কিলোমিটার এই পথ পাড়ি দিতে মেট্রোরেলের সময় লাগবে ১০ মিনিট ১০ সেকেন্ড। যানজটের নগরী ঢাকায় বাস কিংবা অন্য যানবাহনের চেয়ে এত দ্রুত যাতায়াত ঢাকাবাসীকে স্বস্তি দেবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //