২০২২ সাল ছিল দেশের স্বাস্থ্য খাতে ব্যর্থতার আরও একটি বছর। খাতটি যে খুঁড়িয়ে চলছে তা দেখিয়ে দিয়েছে করোনা ভাইরাস মহামারি এবং এর তিন বছর অতিক্রম হয়ে গেলেও যেসব বিষয়ে নজর দেওয়ার প্রয়োজন ছিল তা এখনো অবহেলায় পড়ে আছে। স্বাস্থ্য খাতে এখনো শুধু নেই আর নেই।
প্রতিবছরই নতুন নতুন ভবন নির্মাণ ও কেনাকাটা করা হলেও শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা নিতে গিয়ে মানুষকে দেখতে হয় এটা নেই, ওটা নেই। কোথাও কোথাও কিছু জনবল ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না।
বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে প্রতিবছর কিছু হারে বরাদ্দ বাড়লেও চিকিৎসার যে উন্নতি হওয়ার কথা তা হয়নি। এটি পরিণত হয়েছে বাংলাদেশের সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাতের একটি। কেনাকাটা, নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, পদায়ন, চিকিৎসাসেবা ইত্যাদি মিলিয়ে ১১টি খাতে দুর্নীতি বেশি হয় চিহ্নিত করে সরকারের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রতিবেদন দিয়েছিল। সরকারি হাসপাতালে গেলে রোগীকে প্রয়োজনীয় পরীক্ষাগুলোও বাইরে থেকে করিয়ে আনতে হয়। প্রতিবেদন দিলেও এর বিরুদ্ধে দুদক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
বাস্তবায়ন হয়নি সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা
স্বাস্থ্যবান জাতি শক্তিশালী অর্থনীতি উপহার দিতে পারে। এই লক্ষ্যে বিশ্বের সব নাগরিকদের জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর জাতিসংঘ একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। বাংলাদেশে এই ব্যবস্থাটি চালু করতে কয়েক বছর আগে টাঙ্গাইলে একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়।
কিন্তু এখনো পর্যন্ত এ প্রকল্পের কাজ শেষ করতে পারেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ফলে চিকিৎসা খরচ বেশিরভাগই এখন ব্যক্তিনির্ভর। ২০১২ সালে স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় ছিল ৬০ শতাংশ। ওই কৌশলপত্রে বলা হয়েছিল, সরকারের নেওয়া পদক্ষেপে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় কমে আসবে এবং ২০৩০ সালে তা কমে ৩২ শতাংশ হবে। কিন্তু বর্তমানে নিজ পকেট থেকে ব্যক্তিকে স্বাস্থ্য খাতে ৬৩ শতাংশ ব্যয় করতে হয়।
একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতিবছর ৬০ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে। দারিদ্র্য দূর করতে স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় কমিয়ে আনতে সরকার সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচির প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়নে রয়েছে অনীহা।
স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি
সরকারি কার্যক্রমে অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকার বদ্ধপরিকর বলে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। সেই আলোকে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের আওতাধীন স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন কার্যক্রমে অনিয়ম ও দুর্নীতি যেন না হয়, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিন্তু দুর্নীতি বন্ধ হয়নি।
আর দুর্নীতির বিষয়টি স্বীকারও করা হয় না উপর মহল থেকে। যেমন- ট্রান্সফারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) স্বাস্থ্যে যে দুর্নীতির অভিযোগ করে থাকে তা মন্ত্রী পর্যায় থেকেও প্রত্যাখ্যান করা হয়। এর সঙ্গে এমন প্রভাবশালীরা জড়িত যাদের বিরুদ্ধে কথা বলতেও সাধারণ মানুষকে কয়েকবার চিন্তা করতে হয়।
২০২২ সালেও সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে করোনা সংক্রান্ত কেনাকাটায়। সেই মাস্ক, গ্লাভস, পিপিই ইত্যাদি সামগ্রী চিকিৎসায় ব্যবহৃত অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রীতে। এসব কেনাকাটায় ১৯৩ কোটি টাকার ঘাপলা তৈরি হয়েছে। নিরীক্ষা অধিদপ্তরের নিরীক্ষায় এসব কেনাকাটায় আপত্তি উত্থাপন করা হলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দেয়া হয়নি।
হাসপাতাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় করুণ অবস্থা
চিকিৎসা বর্জ্যে মারাত্মক জীবাণু থাকলেও হাসপাতালের কর্মীদের একাংশ ও ঠিকাদারদের একটি চক্র অপরিশোধিত চিকিৎসা বর্জ্য ধুয়ে বিক্রি করে দিচ্ছে। এসব বর্জ্য পরিষ্কার করে ব্যবহার করা হচ্ছে চিকিৎসায়। বর্জ্য বিক্রিতে এক শ্রেণির ওষুধ দোকানদারও জড়িত। এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের হুমকি। এসব দেখা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লোকদের কাজ হলেও তারা এসব কখনোই দেখেন না।
একটি জেলার বিভিন্ন হাসপাতালের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কেজি প্লাস্টিক চিকিৎসা বর্জ্য অবৈধভাবে বিক্রির অভিযোগ করেছে টিআইবি। বিধিমালা ২০০৮-এর তফসিল ১ অনুযায়ী- চিকিৎসা বর্জ্য পুনঃব্যবহার রোধে রাবার, প্লাস্টিক নল ও বিভিন্ন ব্যাগ টুকরো করে কাটার নির্দেশনা থাকলেও তা পালনে ঘাটতি রয়েছে বলেও টিআইবির অভিযোগ। দেশের ২৮ শতাংশ হাসপাতালে রাবার, প্লাস্টিকের ব্যাগ কাটা হয় না। বেসরকারি হাসপাতালের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ২৯ শতাংশ ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের ব্যাগ কাটা হয় না এবং ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে রাবার, প্লাস্টিকের নল কাটা হয় না।
বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তিগত সক্ষমতার ঘাটতিও রয়েছে। বিধি অনুযায়ী বর্জ্য পরিশোধনের জন্য অটোক্লেভ যন্ত্র ব্যবহারের নির্দেশনা থাকলেও ৪৯ শতাংশ হাসপাতালে এ যন্ত্র নেই। ফলে এসব হাসপাতালে চিকিৎসা উপকরণ পরিশোধন না করেই পুনঃব্যবহার করা হয়। পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ১৯৯৭ অনুযায়ী ‘লাল’ শ্রেণিভুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে হাসপাতালে তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) থাকা বাধ্যতামূলক হলেও ৮৩ শতাংশ হাসপাতালে ইটিপি নেই।
বাজেটে স্বাস্থ্য খাত
সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই স্বাস্থ্য খাতে রোগীর নিজস্ব অর্থ খরচ সবচেয়ে বেশি এবং এ খরচ ক্রমেই বাড়ছে। বর্তমানে দেশের মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের মাত্র ২৩ শতাংশ বহন করে সরকার। মাঝখানে খুবই অল্প সময়ের জন্য স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয় কিছুটা বেশি ছিল। কেবল ১৯৯৭ সালে এই ব্যয় ছিল ৩৭ শতাংশ।
বেসরকারি এনজিও ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলো ৩ শতাংশ এবং দাতা সংস্থাগুলো ৭ শতাংশ পর্যন্ত ব্যয় বহন করে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বাংলাদেশের মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় মাত্র ২৭ ডলার। এটি বিশ্বে সর্বনিম্ন। যেখানে ভারতে ৬১ ডলার ও মালয়েশিয়ায় ৪১০ ডলার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সেবার মানোন্নয়নের জন্য এ খাতে ব্যয় ৪০ ডলারে উন্নীত করতে হবে।
বর্তমানে ব্যয়ের ২৩ শতাংশ বহন করে সরকার। অন্যদিকে পাশের দেশ ভারত ব্যয় করে ৩৩ শতাংশ ও নেপাল ৪০ শতাংশ। ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যয় বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ৬৩ শতাংশ (কেউ বলেন ৬৭ শতাংশ), ভারতে ৫৭.৩ শতাংশ ও নেপালে ৪৯.২ শতাংশ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, ভালোমানের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে দেশের জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ হওয়া উচিত। কিন্তু দেশের স্বাস্থ্য খাতের বাজেটে টাকার পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়লেও তা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুপাতে হয় না। গত বছরগুলোর স্বাস্থ্য খাতের বাজেট পর্যালোচনায় দেখা যায়, এটি জাতীয় বাজেটের ৬ শতাংশের বেশি কখনো হয় না। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিল ৬ হাজার ১৯৬ কোটি টাকা, যা জাতীয় বাজেটের ৬.১৩ শতাংশ।
২০২০-২১ অর্থবছরে তা বাড়িয়ে ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও তা ছিল জাতীয় বাজেটের ৫.১৫ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেটের ৫.২ শতাংশ বরাদ্দ ছিল। ফলে স্বাস্থ্যে দেওয়া হয় ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। এ বছর সামগ্রিক বাজেট টাকার পরিমাণ প্রায় ১৪.২৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ মাত্র ১২.৬২ শতাংশ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই বৃদ্ধি সামান্য। এটা করা হয়েছে মূল্যস্ফীতি সামঞ্জস্য রাখার জন্য।
স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন এবং জনগণের দোরগোড়ায় সেবা নিয়ে যেতে বিশেষজ্ঞরা বহুদিন যাবৎ কিছু সুপারিশ করে আসছেন। এগুলো হলো- স্বাস্থ্য বাজেটে বরাদ্দকৃত অর্থের অসমতা দূর, অঞ্চলভিত্তিক চাহিদা ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে বাজেট বরাদ্দ, সারাদেশে দক্ষ ও নিরবচ্ছিন্ন চিকিৎসা সেবা দিতে আরও চিকিৎসক ও নার্স তৈরি করা, জনগণের ক্রয়ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে নয়, বরং চাহিদার ওপর ভিত্তি করে তাদের জন্য মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্যসেবাকে ব্যক্তিমালিকানাধীন করে পণ্যে পরিণত করা বন্ধ করা, সবার জন্য সরকারিভাবে স্বাস্থ্যবীমা চালু করা, জাতীয় স্বাস্থ্য ও ওষুধ নীতি গ্রহণ ও এর বাস্তবায়ন এবং ওষুধের মূল্য সাধারণ মানুষের নাগালে রাখা।
নতুন বিপদ
করোনা এখনো শেষ হয়নি। চীন ও ভারতে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্টের উদ্ভব হয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ আসা চারজন চীনা নাগরিককে শনাক্ত করা হয়েছে করোনা আক্রান্ত হিসেবে। তারা করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে এসে থাকলে বাংলাদেশের জন্য অপেক্ষা করছে নতুন এক বিপদ। বর্তমানে করোনার যে ভ্যারিয়েন্টটির (এটা ওমিক্রনের একটি বংশধর। নাম দেয়া হয়েছে বিএ.৭) উদ্ভব হয়েছে তা ওমিক্রনের চেয়ে ৪ গুণ বেশি শক্তিশালী।
এটা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়লে আবারও দেখা দেবে মহামারি। এই মহামারি মোকাবিলায় সরকারের পক্ষ থেকে খুব বেশি প্রস্তুতি নেই বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। আর যেসব খাতে সরকারের নজর দেওয়ার দরকার ছিল এর বেশিরভাগই আগের মতোই পড়ে রয়েছে বলে জানা গেছে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : স্বাস্থ্য খাত করোনা স্বাস্থ্যসেবা দুর্নীতি বাজেট টিআইবি
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh