ফিরে দেখা ২০২২

স্বপ্নছোঁয়া সাফল্য

রাজধানীতে শীতল আবহাওয়া দিয়ে শুরু হয়েছে নতুন বছর। ঘন কুয়াশায় ভোরে রোদ দেখা না গেলেও সূর্য হেসেছে বেলা বাড়ার পর পর। এ সূর্যকিরণের মধ্যেই থাকে নতুন করে যাত্রা শুরু করার আহ্বান। গেল বছরে নানা সংকটের মাঝে দেশ যা অর্জন করেছে. তা অভাবনীয়।

পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল চালু, বিভিন্ন সামাজিক সূচকে ঈর্ষণীয় সাফল্য, নারী ফুটবলারদের সাফ জয়, কৃষকদের অসামান্য অবদান, প্রবাসী শ্রমিকদের ঘাম-ঝরানো উপার্জন বাংলাদেশকে বিশ্বের সামনে এক বিস্ময়কর উদাহরণ হিসেবে হাজির করেছে। বিগত কয়েক বছরের নানা বন্ধুর পরিস্থিতিতেও এসব সাফল্য থমকে যায়নি। 

এ বছরটি শেষ হয়েছে রাজধানীর যোগাযোগ ব্যবস্থায় একটি নতুন পালক যুক্ত করে। উচ্ছ্বাস আর প্রত্যয়ী ঘোষণার মধ্য দিয়ে নগর যোগাযোগের মেট্রোরেল পর্বে যাত্রা করেছে বাংলাদেশ। যানজটের নগরীতে ঠিক সময়ে ও নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছানোর আশা দেখাচ্ছে আধুনিক এই গণপরিবহন। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৮ ডিসেম্বর এ স্বপ্নযাত্রার উদ্বোধন করেন। ৩৩ হাজার ৪৭১ কোটি ৯৯ লাখ টাকা ব্যয়ে উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ২১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই মেট্রোরেল নির্মাণের কাজ চলছে জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকার সহযোগিতায়। উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত এই লাইনের নাম দেওয়া হয়েছে এমআরটি-৬। সূচি ধরে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে ২০৩০ সাল নাগাদ ঢাকা যানজটের যন্ত্রণা অনেকটাই লাঘব হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

২০২২ সালে বাংলাদেশে অন্যতম আলোচিত ঘটনা হলো পদ্মা সেতুর উদ্বোধন। ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতু তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে। পদ্মা সেতু চালুর পর দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের ভোগান্তি দূর হয়েছে। রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হয়েছে। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এ সেতুর দীর্ঘমেয়াদি একটা প্রভাব রয়েছে বলেই মনে করা হয়। আশা করা যায়, শিগগিরই একই রেল যোগাযোগও স্থাপিত হবে।

এর আগে ৭ নভেম্বর দেশের ২৫ জেলায় নবনির্মিত ১০০ সেতু এবং গত ২১ ডিসেম্বর দেশের ৫০টি জেলায় ২০২১.৫৬ কিলোমিটার সম্মিলিত দৈর্ঘ্যকে ১০০টি সড়ক ও মহাসড়ক উদ্বোধন দেশের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে নতুন মাত্রা যোগ করে।

গত নভেম্বরে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চলের (ইজেড) ৫০টি শিল্প ইউনিট, প্রকল্প ও স্থাপনার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্যে চট্টগ্রামের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরে (বিএসএমএসএন) চারটি কারখানা এবং বেসরকারিভাবে পরিচালিত বিভিন্ন ইপিজেডে আটটি কারখানা খোলা হয়েছে। বিদায়ী বছরে দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে আরেকটি মাইলফলক ছিল পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। কয়লাভিত্তিক এই কেন্দ্রে প্রথমবারের মতো ব্যবহার করা হয়েছে আলট্রা-সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি। প্রধানমন্ত্রী গত ২১ মার্চ এই বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধন করেন।  

গত ১৯ সেপ্টেম্বর ছিল ক্রীড়ায় সাফল্যের ক্ষেত্রে দেশবাসীর জন্য একটি গর্বের দিন। এদিন সাফ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপ প্রতিযোগিতার ফাইনালে বাংলাদেশ ও নেপাল মুখোমুখি হয়। এতে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল দল নেপালকে ৩-১ গোলের ব্যবধানে পরাজিত করে তাদের প্রথম শিরোপা অর্জন করে।

এবার বিশ্বের খ্যাতনামা বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেট বিশ্বের ১০ বিজ্ঞানীর প্রোফাইল প্রকাশ করেছে। সেখানে আছেন বাংলাদেশের সেঁজুতি সাহা। ল্যানসেট তার সম্পর্কে বলেছে, ‘তিনি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য গবেষণা নিয়ে সমতার পক্ষে এক জোরদার কণ্ঠ। সেঁজুতি এবং সিএইচআরএফে তার দল মিলে জীবাণুর জিন নকশা উন্মোচন (জিনোম সিকোয়েন্সিং) কিংবা ভাইরাসের গবেষণায় রত থাকেন। বাংলাদেশের শিশুদের আক্রান্ত করে এমন কিছু রোগ, যেমন ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়া নিয়ে তাদের গবেষণা অব্যাহত আছে।’

আলোচিত ঘটনাগুলোর পেছনে থাকা ১০ বিজ্ঞানীর তালিকা প্রকাশ করেছে বিজ্ঞান জার্নাল নেচার। ১৫ ডিসেম্বর প্রকাশ হওয়া এই তালিকায় জায়গা পেয়েছেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী সালিমুল হক। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ধনী দেশগুলোর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ে চাপ তৈরিতে অবদানের জন্য এ তালিকায় তার নাম এসেছে।

পুরো বছর বিশ্ব অর্থনীতি ছিল টালমাটাল। তবে এমন সংকটেও এগিয়েছে বাংলাদেশের কৃষি। সবজি, ফলমূল ও মাছ থেকে শুরু করে নানা ধরনের খাদ্যের উৎপাদন বাড়ছে। দেশের প্রতিবেশের সঙ্গে কৃষকের উদ্ভাবনী ক্ষমতা আর প্রযুক্তির সম্মিলন এই সাফল্যের পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে।

কৃষি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বিশ্বের অনেক দেশে কৃষিপ্রযুক্তিতে যথেষ্ট অগ্রগতি আছে। কিন্তু কৃষিকাজের জন্য প্রয়োজনীয় আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য নেই। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। যেমন এদেশের বেশিরভাগ ভূমি পলিমাটি দিয়ে গঠিত আর সমতল। বর্ষা ও গ্রীষ্মকাল আমাদের ফসল উৎপাদনের জন্য বেশ অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করে।

সেই সঙ্গে হিমালয়ের ভাটি অঞ্চল হওয়ায় উজান থেকে নামা নদীগুলোর স্বাদুপানির যথেষ্ট প্রবাহ এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আর বাংলাদেশের কৃষিবিজ্ঞানীরা এখানকার প্রকৃতি ও জলবায়ুর উপযোগী ফসলের জাত উদ্ভাবন করেছেন। যে কারণে তা কৃষকের কাছে দ্রুত জনপ্রিয় হয়েছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবে স্বাধীনতার সময়ে দেশে ধানের উৎপাদন ছিল এক কোটি মেট্রিক টন। ২০২২ সালে তা বেড়ে হয়েছে চার কোটি মেট্রিক টন। সবজি, মাছ, ফল থেকে শুরু করে মসলা বা গবাদিপশুর সবকিছুর উৎপাদন তিন থেকে ছয় গুণ পর্যন্ত বেড়েছে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) বিজ্ঞানীরা ১৯৭১ সাল থেকে ২০২২ সালে মোট উচ্চফলনশীল ধানের ১১১টি জাত উদ্ভাবন করেছেন। এর বাইরে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিনা), বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা ফসল, মাছ ও গবাদিপশুর নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করে তা কৃষকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন।

এর বাইরে কৃষকেরাও নিজেরা স্থানীয় জাতগুলোর চাষ করে উৎপাদন বাড়িয়েছেন। বেসরকারি খাত বীজ উৎপাদন থেকে শুরু করে প্রাণিখাদ্যসহ প্রায় সব ধরনের কৃষি উপকরণ কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন। এ সবকিছু মিলেমিশে দেশে খাদ্যপণ্যের উৎপাদন অনেক বেড়েছে।

বছরজুড়ে রেমিট্যান্স কমলেও বছর শেষে এসেছে সুখবর। বাংলাদেশ গত ডিসেম্বরে ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছে, যা এর আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক ২৯ শতাংশ বেশি। অভিবাসী কর্মীরা এর আগের বছরের (২০২১ সাল) ডিসেম্বরে ১ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //