ফিরে দেখা ২০২২

প্রশাসনে নানা বিতর্ক-সমালোচনা

বিদায়ের ঘণ্টা বাজিয়ে চলে গেলো একটি বছর। গত বছরেও বিভিন্ন ক্ষেত্রের মতো প্রশাসনে নানা ঘটনার ঘনঘটা ছিল। নানা সমস্যায় খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে প্রশাসন, এর উপর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও কর্মকর্তাদের বাধ্যতামূলক অবসর নিয়ে বছর ভর প্রশাসনে ছিল বিতর্ক ও সমালোচনা।

চলতি বছর দফায় দফায় পদোন্নতিতে বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তার ভাগ্য খুলেছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের পদে পরিবর্তনও এসেছে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ বাড়ায় বছরের শুরুর দিকে কিছু বিধিনিষেধে থাকলেও বাকি সময়টা মোটামুটি স্বাভাবিক কেটেছে। এ বছর সরকারি অফিস সূচিতে দু-বার পরিবর্তন এসেছে।

শুরুটা বিধিনিষেধে
চলতি বছরের শুরুতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ফের বেড়ে গিয়েছিল, তাই কিছুটা সময় বিধিনিষেধে কেটেছে। বন্ধ ছিল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও।

নতুন ধরন ওমিক্রনসহ করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে থাকায় চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি সারা দেশে বিধিনিষেধ জারি করে সরকার। যা ১৩ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়। তখন ১১টি নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে ২১ জানুয়ারি থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। পরে ২৪ জানুয়ারি থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অর্ধেক জনবল নিয়ে সরকারি-বেসরকারি অফিস পরিচালনার নির্দেশনা দেয় সরকার। বিধিনিষেধের মেয়াদ ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

তথ্য সচিব ও পুলিশ কর্মকর্তাদের অবসর বিতর্ক
চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই গত ১৬ অক্টোবর তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মকবুল হোসেনকে অবসরে পাঠায় সরকার। এরপর পুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ ২০ ডিসেম্বর অপরাধ তদন্ত বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. মুনির হোসেনকে অবসরে পাঠিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

গত ১৬ অক্টোবর পুলিশ সুপার (এসপি) পদমর্যাদার কর্মকর্তা মো. আলী হোসেন ফকিরকে সরকারি চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। এরপর গত ১৮ অক্টোবর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) মীর্জা আবদুল্লাহেল বাকী ও মো. দেলোয়ার হোসেন মিঞা এবং পুলিশ সদর দপ্তরের এসপি (টিআর) মুহম্মদ শহীদুল্লাহ চৌধুরীকে চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই অবসরে পাঠানো হয়।

৩১ অক্টোবর দুই অতিরিক্ত ডিআইজিকেও বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। তারা হলেন ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মাহবুব হাকিম ও সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আলমগীর আলম। গত ২১ নভেম্বর সরকারি চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে এসপি ব্যারিস্টার জিল্লুর রহমানকে।

অতিরিক্ত সচিব ও কয়েকজন ইউএনওকে নিয়ে সমালোচনা
চলতি বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর বিকালে আলীকদম উপজেলার ২ নম্বর চৈক্ষ্যং ইউনিয়নের রেপারপাড়া এলাকায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে এক খেলায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইউএনও মেহরুবা ইসলাম। খেলায় সমাপনী বক্তব্যে এবং পুরস্কার বিতরণ করার একপর্যায়ে ইউএনও জনসাধারণের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে বিজয়ী ও রানার্সআপ দলের ট্রফি (কাপ) ভেঙে ফেলেন। এতে উপস্থিত দর্শকরাও ইউএনওর ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। পরে ইউএনও মেহরুবা ইসলামকে ঢাকায় বদলি করা হয়।

সরকারি কর্মকর্তাদের ‘জ্ঞানচর্চা ও পাঠাভ্যাস’ বাড়াতে লাইব্রেরির জন্য বই কেনার তালিকায় অতিরিক্ত সচিব মো. নবীরুল ইসলামের ২৯টি বই স্থান পাওয়ার বিষয়টি চরম বিতর্কের জন্ম দেয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। সমালোচনার মুখে গত ২৯ আগস্ট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তখনকার সিনিয়র সচিব কে এম আলী আজম সাংবাদিকদের জানান, নবীরুল ইসলামের বই থাকা সেই তালিকাটি বাতিল করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর নিয়ে খবর প্রকাশের জেরে কক্সবাজারের সাংবাদিক সাইদুল ফরহাদকে দাপ্তরিক মুঠোফোন নম্বর থেকে কল করে অকথ্য ভাষায় গালাগাল কক্সবাজারের টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কায়সার খসরুর। ঘটনাটি ২১ জুলাই রাত পৌনে ১০টার। গালিগালাজের এ অডিও রেকর্ড ফাঁস হলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। পরে এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন ইউএনও।

পরে ইউএনও কায়সার খসরুর ভাষা মস্তানের চেয়েও খারাপ বলে মন্তব্য করেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে সাংবাদিককে ইউএনওর অকথ্য ভাষায় গালাগালি দুঃখজনক ও অগ্রহণযোগ্য বলে জানান সর্বোচ্চ আদালত। শেষে ২৫ জুলাই মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, ইতোমধ্যে তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে।

চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে গুচ্ছগ্রাম- দ্বিতীয় পর্যায় প্রকল্পে দুর্নীতির কারণে গাইবান্ধা সদরের সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শফিকুর রহমানের পদাবনতি হয়েছে। সরকারি বাসভবনের প্রতিবেশী অন্য কর্মকর্তাদের হুমকি, মিথ্যা পরিচয়, খারাপ আচরণসহ নানা ধরনের অভিযোগে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে উপসচিব মো. লোকমান আহমেদকে শাস্তি দেয় সরকার।

এছাড়া মুন্সীগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (উপসচিব) থাকার সময় আবু জাফর রাশেদ (বর্তমানে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সচিব) তৎকালীন জেলা প্রশাসককে (মুন্সীগঞ্জ) দ্বিতীয় স্ত্রীর মাধ্যমে বিপদে ফেলা ও বিব্রত করার চেষ্টা করেছিলেন। এজন্য শাস্তি হিসেবে ৩ বছরের জন্য আবু জাফরের বেতন গ্রেডের নিম্নতম ধাপে নামিয়ে আনা হয়। 

একজন সাংবাদিককে হয়রানিমূলকভাবে মধ্যরাতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কারাদণ্ড দেয়ার ঘটনায় কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুলতানা পারভীনের পর তখনকার রেভিনিউ ডেপুটি কালেকটর (আরডিসি) নাজিম উদ্দীনের শাস্তি মাফ করে দেওয়া হয়। এ ঘটনা সমালোচনার জন্ম দেয়।

মামলা তুলে নেওয়ার হুমকি ও নারী নির্যাতনের অভিযোগে উপসচিব এ কে এম রেজাউল করিমকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে সরকার। গত ২১ নভেম্বর তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। 

শীর্ষ দুই পদ ও মাঠ প্রশাসনে বড় পরিবর্তন
প্রশাসনের শীর্ষ দুটি পদে এ বছরই পরিবর্তন এসেছে। জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে এ বছরই। বছরের শেষের দিকে এসে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব পদে পরিবর্তন আসে। পরিবর্তন এসেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব পদেও।

নতুন মন্ত্রিপরিষদ সচিব নিয়োগ পেয়েছেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার। গত ১১ ডিসেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এক আদেশে ২৩তম মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে কবির বিন আনোয়ারকে এ নিয়োগ দেয়। গত ১৫ ডিসেম্বর মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষ হয়।

এর আগে গত ৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর নতুন মুখ্য সচিব নিয়োগ পান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। একই দিন প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব নিয়োগ পান।

গত ২৩ নভেম্বর মাঠ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। ওই দিন রাতে ২৩ জেলার ডিসি পদে পরিবর্তন আনা হয়। ঢাকা, কুমিল্লা, পটুয়াখালী, টাঙ্গাইল, বরিশাল, সুনামগঞ্জ, খুলনা, গোপালগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কুড়িগ্রাম, রংপুর, সিরাজগঞ্জ, ঝালকাঠি, ফরিদপুর, খাগড়াছড়ি, ময়মনসিংহ, বগুড়া, কিশোরগঞ্জ, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কক্সবাজার, জয়পুরহাট ও মাগুরায় নতুন জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়।

পদোন্নতিতে খুলেছে কপাল
চলতি বছর যুগ্মসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব, উপসচিব থেকে যুগ্মসচিব ও সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব পদে বড় ধরনের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে গত ৬ এপ্রিল প্রশাসনে ৯৪ জন যুগ্ম সচিবকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেয় সরকার। চলতি বছরের ২৯ জুন জনপ্রশাসনে ৮২ জন উপসচিবকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

এরপর বছরের শেষের দিকে এসে গত ২ নভেম্বর ফের ১৭৫ জন উপসচিবকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। গত ১ নভেম্বর প্রশাসনে সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব পদে পদোন্নতি পান ২৫৯ জন কর্মকর্তা। 

বিদ্যুৎ সাশ্রয় ও শীতে অফিস সূচিতে পরিবর্তন
চলতি বছর সরকারি অফিসের সময়সূচিতে দু-বার পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রথমে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে গত ২৩ আগস্ট থেকে অফিসের সূচিতে পরিবর্তন আনে সরকার। ওই সময়ে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত অফিস করেন সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ব্যাংক লেনদেন পরিচালিত হয়েছে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত।

পরে শীতকাল বিবেচনায় ১৫ নভেম্বর থেকে অফিসের সময়সূচিতে ফের পরিবর্তন আনে সরকার। নতুন নিয়মে সকাল ৯টায় অফিস শুরু হয়ে শেষ হচ্ছে বিকাল ৪টায়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //