বছরজুড়ে আলোচনায় নতুন পাঠক্রম

ভুলে ভরা বিনামূল্যের পাঠ্যবইয়ের নানা সমালোচনা নিয়ে চলতি বছর শুরু হয়েছিল। বছরটি শেষ হচ্ছে নতুন পাঠক্রমের বিতর্ক নিয়ে। এভাবে বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নতুন পাঠক্রম নিয়ে আলোচনা ছিল বিদায়ী বছরে। একই সঙ্গে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের আন্দোলন, এসএসসি ও এইচএসসিতে খারাপ ফল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অস্থিরতাসহ শিক্ষা খাতে নানা ঘটনা ঘটেছে বিদায়ী বছরে। বছরের শুরুতে ভুলে ভরা পাঠ্যবই দিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। বছর শেষে রাজনৈতিক উত্তাপ পড়ে শিক্ষাঙ্গনে।

এ ছাড়া সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের নির্বাচনী উপহার হিসেবে বিশেষ বিবেচনায় ৯১টি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হয়। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে এক ছাত্রীকে বিয়ে করে আলোচনায় আসেন গভর্নিং বডির ৬০ বছর বয়সী এক সদস্য। ভিকারুননিসায় এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করে বহিষ্কার হন শিক্ষক। এমন নানা ইস্যুতে এ বছর শিক্ষাঙ্গনে ছিল নানা আলোচনা, সমালোচনা।

ভুলেভরা পাঠ্যবই 
গত জানুয়ারি মাসের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেয় সরকার। সেসব বইয়ে ‘ইতিহাস ও তথ্য বিকৃতি’, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা গদ্যে ‘চৌর্যবৃত্তি’, মুক্তিযুদ্ধের ‘ভুল ইতিহাস’ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে শুরু হয় শিক্ষাবর্ষ। ২০২৩ সালে নতুন কারিকুলামের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বইয়ে অসংখ্য ভুল ধরা পড়ে। যা গণমাধ্যমে আসার পর টনক নড়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি)। শুরু হয় ভুল চিহ্নিত করার কাজ। প্রায় চার মাস পর এপ্রিলের শেষে এসে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ২২টি বইয়ে ৪২১টি ভুল-ভ্রান্তির সত্যতা পায় এনসিটিবি। ভুলগুলো সংশোধন করে ২৯ এপ্রিল এনসিটিবির ওয়েবসাইটে সংশোধনী দেওয়া হয়।

জানুয়ারির বই এপ্রিলে
২০২৩ শিক্ষাবর্ষে বিনামূল্যের পাঠ্যবই জানুয়ারির ১ তারিখ তুলে দেওয়ার কথা থাকলেও নানা সংকটে সেটি হয়নি। এপ্রিল মাসে গিয়ে শেষ হয় জানুয়ারি মাসের বই বিতরণ। করোনা মহামারি ও কাঁচামাল সংকটের কারণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বই ছাপানোর কাজ শুরু হয় বেশ দেরিতে। তাই ১ জানুয়ারি বই উৎসব হলেও সব বই হাতে পায়নি শিক্ষার্থীরা।

এসএসসি-এইচএসসিতে খারাপ ফল
২০২৩ সালে এসএসসি ও এইচএসসিতে খারাপ ফল হয়েছে। এ দুটি পরীক্ষার পাসের হার ও জিপিএ-৫ দুটোই কমেছে। এ ছাড়া অন্যান্য সব সূচকও নেতিবাচক ছিল। যদিও মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা বোর্ড বলছে, এ ফলাফল স্বাভাবিক, খারাপ নয়। করোনার আগের বছরগুলোর সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে পাসের হার সাধারণত ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশের ঘরে ছিল। মাঝে ২০২১ ও ২০২২ শিক্ষাবর্ষে পাসের হার বেড়ে ৯০ শতাংশের বেশি হয়। কারণ সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে কম বিষয়ে পরীক্ষা নেওয়া। এ বছর আগের মতো স্বাভাবিক নিয়মে পরীক্ষায় ফেরায় ফল ৮০ শতাংশের ঘরে নেমে এসেছে।

ওই দুই পরীক্ষার ফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, করোনার সময়ের প্রভাব এবারের ফলে পড়েছে। এ ছাড়া, দুই বছর পর চলতি বছর পূর্ণ নম্বরে পরীক্ষা এবং ইংরেজি ও গণিতে শিক্ষার্থীরা খারাপ করায় এর প্রভাব সার্বিক ফলাফলের ওপর পড়েছে।

বছর শেষে রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়ায় শিক্ষাঙ্গনে
দ্বাদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো মুখোমুখি অবস্থান নেয়। এ কারণে অক্টোবর মাস থেকে রাজনীতির মাঠে উত্তাপ ছড়ায়। ফলে বছরের শেষ সময়ে সব শ্রেণিতে বার্ষিক পরীক্ষা, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির অর্ধবার্ষিকী (ষাণ্মাসিক) মূল্যায়ন, এসএসসির প্রস্তুতি, এইচএসসির প্রাক-নির্বাচনীসহ বিভিন্ন ভর্তি পরীক্ষায় ব্যাঘাত ঘটে। দাবি ওঠে, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রত্যাহার করার। যদিও সেই দাবি মানেনি বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো। শেষ পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন বন্ধের দিন অর্থাৎ শুক্র-শনিবার পরীক্ষা নেয়। বাকি পরীক্ষাগুলো হরতাল-অবরোধের ফাঁকা দিনগুলোতে অনুষ্ঠিত হয়।

বিশেষ বিবেচনায় এমপিওভুক্ত হয় ৯১ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান 
জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের নির্বাচনী উপহার হিসেবে বিশেষ বিবেচনায় ৯১টি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা হয়। এমপিও নীতিমালা-২০২১-এর বিশেষ ২২ ধারা ব্যবহার করে এমপিওভুক্ত করা হয় প্রতিষ্ঠানগুলো। অভিযোগ ওঠে, প্রতিষ্ঠানগুলো এমপিও নীতিমালার শর্ত পূরণ না করলেও সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ বিবেচনায় এমপিওভুক্ত করা হয়। এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০২১-এর কোনো শর্তই মানা হয়নি। শুধু রাজনৈতিক বিবেচনায় যাচাই-বাছাই ছাড়াই তালিকা চূড়ান্ত করা হয়।

এমপিওভুক্তির দাবিতে রাজপথে শিক্ষকরা 
এমপিওভুক্তির দাবিতে নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা জুন থেকে আন্দোলন শুরু করেন। রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে শিক্ষক সংগঠন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (বিটিএ) সদস্যরা অবস্থান নেন। ১৯ জুলাই আন্দোলনরত শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি।

আটকে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘একক’ ভর্তি পরীক্ষা 
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি কার্যক্রমে জটিলতা, দীর্ঘসূত্রতা, শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের নিরাপত্তাহীনতা, দুর্ভোগ, অতিরিক্ত টাকা ব্যয় ও সময়ক্ষেপণ কমাতে ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ‘একক’ ভর্তি পরীক্ষার উদ্যোগ নেয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। শেষ পর্যন্ত সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। নতুন পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নিতে ইউজিসি গত ৩১ অক্টোবর ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক পর্যায়ে কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ অধ্যাদেশ, ২০২৩’-এর খসড়া চূড়ান্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠালেও সেটি চূড়ান্ত হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় নানা জটিলতায় সেটি চূড়ান্ত করতে না পারায় এবারও আগের মতো গুচ্ছ ভিত্তিতেই ভর্তি পরীক্ষা হবে বলে জানায় ইউজিসি।

একাদশের ছাত্রীকে বিয়ে করে আলোচনা
ঢাকার মতিঝিলের আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রীকে বিয়ে করে আলোচনায় আসেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের সদস্য খন্দকার মুশতাক আহমেদ। ৬০ বছর বয়সী মুশতাককে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। বিষয়টি তদন্ত করতে ঢাকা জেলা প্রশাসন অফিস ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ড আলাদা তদন্ত কমিটি করে। এটি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //