বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে আলোচিত যে মন্ত্রীরা

শেষ হচ্ছে ২০২৩ সাল। চলতি বছরের বিভিন্ন সময়ে নানা বিতর্কিত বক্তব্য দিয়ে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছিলেন মন্ত্রিসভার পাঁচজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী। লিপস্টিক ‘তত্ত্ব’ দিয়ে খুব একটা ভালো যায়নি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির। আবার উল্টো স্রোতে গিয়ে ‘মন্ত্রীদের সিন্ডিকেট’ ও বেসামাল বাজার নিয়ে বক্তব্য দিয়ে অনেকের প্রশংসা কুড়ালেও শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদারকে সহকর্মীদের সমালোচনা সইতে হয়েছে।

বক্তব্যে ‘জান্নাত-জাহান্নাম’ বিভ্রাটের কারণে অনেক বড় মূল্য দিতে হয়েছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনকে। বছরভরই নানা বক্তব্যে আলোচনায় ছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তবে বছরের শেষে এসে ‘বিএনপি’ নিয়ে দেওয়া বক্তব্য বেশ ভোগাচ্ছে কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাককে।

লিপস্টিক ‘তত্ত্বে’ বেকায়দায় পড়েছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী
চলতি বছরের ৮ নভেম্বর সচিবালয়ে ন্যাশনাল ট্যারিফ পলিসি মনিটরিং ও রিভিউ কমিটির সভা শেষে আপনাদের তো এলাকায় গিয়ে ভোট চাইতে হবে, তারা তো দ্রব্যমূল্য নিয়ে অস্বস্তিতে আছে, এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার এলাকার মানুষের কষ্ট নেই। কারণ তারা আলুর দাম পাচ্ছে। আমার তো কৃষিপ্রধান এলাকা। একেকটা এলাকা একেক রকম। ঢাকা শহরে যে নির্বাচন করবে, তার অনেক সমস্যা। আজকে থেকে ২০ বছর আগে আমার এলাকায় ১০টা মোটরসাইকেল ছিল, ২০০১ সালে আমি প্রথম ভোট করি। আজকে হাজার হাজার মোটরসাইকেল। তারা প্রত্যেকে অ্যাফোর্ড করছে। তাদের কোনো কষ্ট নেই। তিনবার করে লিপস্টিক লাগাচ্ছে দিনে মহিলারা। চার বার করে স্যান্ডেল বদলাচ্ছে। অতএব আমার ভোট, আমি খুব ভালো জানি, আমার কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু সারা দেশের অবস্থাটা ডিফরেন্ট। এটা আমি বুঝি, বিশেষ করে শহরে যারা দিনমজুর, লো আর্নার গ্রুপ তাদের কষ্ট হচ্ছে।’

লিপস্টিক লাগানো ও স্যান্ডেল বদলানোর এ বক্তব্য মুহূর্তে ভাইরাল হয়। ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি করে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে পিষ্ট মানুষ মন্ত্রীর এ বক্তব্য খুবই নেতিবাচকভাবে নেয়।

‘বিএনপি’ নিয়ে বক্তব্য দিয়ে আলোচিত কৃষিমন্ত্রী
গত ১৭ ডিসেম্বর একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে সম্প্রচারিত সাক্ষাৎকারে কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘২০ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার না করলে কি বাংলাদেশে আজকে যে গাড়ি চলছে এই হরতালের দিন, আপনারা এই গাড়ি দেখতেন?... এ ছাড়া আমাদের জন্য কোনো গত্যন্তর ছিল না।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এই সদস্য বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন থেকে বারবার বলা হয়েছে তারা (বিএনপি) যদি আসে তাহলে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হবে। পিছিয়ে দেওয়া না, বলাও হয়েছিল যে সবাইকে জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হবে। তাদেরকে জেলে না রাখলে দেশ অচল হয়ে যাবে।’

কৃষিমন্ত্রীর এ বক্তব্যেও শোরগোল পড়ে যায়। বিব্রত হন তার দলের নেতারা। আব্দুর রাজ্জাকের এ বক্তব্য ‘সঠিক নয়’ দাবি করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, এ বক্তব্য আওয়ামী লীগ কিংবা সরকারের নয়, এটি তার নিজস্ব বক্তব্য।

‘বেকায়দায়’ পড়ে ১৮ ডিসেম্বর আব্দুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের কাছে তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন। পরে লিখিত বিবৃতিতে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, ওই বেসরকারি চ্যানেল কৃষিমন্ত্রীর পুরো বক্তব্য সঠিকভাবে উপস্থাপন করেনি। মন্ত্রীর খোলামেলা বক্তব্যকে কোনো কোনো মহল বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন।  কৃষিমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেন যে, তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং সত্য আপন জ্যোতিতেই উদ্ভাসিত থাকবে।

যেন ‘বোমা ফাটান’ শিল্প প্রতিমন্ত্রী
চলতি বছরের ১১ মে ইআরএফ আয়োজিত কর্মশালায় বক্তব্যে শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার বলেছিলেন, ‘আমি অনেককে দেখেছি বাজার করতে গিয়ে কাঁদছেন। কারণ বাজারের যে অবস্থা তার পকেটে সে টাকা নেই। এটার একমাত্র কারণ সিন্ডিকেট।’ পরে ওই মাসের ১৬ মে প্রকাশিত একটি দৈনিককে শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদারের দেওয়া সাক্ষাৎকার বিপুল আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়।

প্রতিমন্ত্রী হিসেবে তিনি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না জানিয়ে ওই সাক্ষাৎকারে বলেন, সচিবের কাছ থেকে মন্ত্রীর কাছে ফাইল চলে যায়। আমার কাছে ফাইল আসে না, কারণ কয়েকটি ফাইলে আমি উলটো নোট দিয়েছি। আমি নেত্রীকে সব জানিয়েছি।

আপনি বলেছেন অর্থনীতি ও বাজার- দুই জায়গাতেই সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। এই সিন্ডিকেট কারা তৈরি করেছে জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘খামাখা নামটাম জিজ্ঞাসা করে আমাকে ভেজালে ফেলবেন। শেয়ার কেলেঙ্কারিতে কারা ছিল? তাদের অনেকেই এখন মন্ত্রী। মন্ত্রীদের ভেতর একটা সিন্ডিকেট আছে।’

নিজে সরকারে থেকে এমন সত্য বক্তব্যের জন্য অনেকেই তাকে বাহবা জানিয়েছিলেন। তবে দলীয় নেতা ও সহকর্মীরা তার বক্তব্যে বিরক্ত হয়েছিলেন। 

‘জান্নাত-জাহান্নাম’ বিভ্রাট, সমালোচিত গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী
১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে কুড়িগ্রামের রাজীবপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম শাহাদত বার্ষিকীতে উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত কর্মসূচিতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের বক্তব্যের একটি অংশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ওই বক্তব্যে প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনকে বলতে শোনা যায় ‘আমরা কায়মনে দোয়া করবো বঙ্গবন্ধুকে যেন আল্লাহ জাহান্নামের ভালো জায়গায় স্থান করে দেয়।’

অনুষ্ঠানটি আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতাকর্মী ও সাংবাদিকরা ফেসবুকে লাইভ ও ভিডিও ধারণ করেছিলেন। মুহূর্তে এই বক্তব্য ভাইরাল হয়ে যায়। পরে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ভুলবশত তিনি ‘জান্নাত’ শব্দটি না বলে ‘জাহান্নাম’ উচ্চারণ করেছেন। এটি ‘স্লিপ অব টাং’। জাহান্নাম শব্দটি বলার সঙ্গে সঙ্গে আমি সংশোধন করে জান্নাত শব্দটি ব্যবহার করি এবং পরে কয়েকবার জান্নাত শব্দ উচ্চারণ করি।

পরে তাকে দলীয় মনোনয়ন না দিতে একই আসনের ১৫ জন আওয়ামী লীগ দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী এক হয়ে কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টারি বোর্ড ও দলীয়প্রধান শেখ হাসিনা বরাবর লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। কুড়িগ্রাম-৪ আসনের সংসদ সদস্য জাকির শেষমেশ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাননি।

নানা বক্তব্যে আলোচনায় ছিলেন ওবায়দুল কাদের
‘খেলা হবে’ ও ‘তলে তলে’ বক্তব্যের জন্য এ বছর আলোচিত ছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি এক অনুষ্ঠানে নেতাকর্মীদের প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘খেলা হবে ভোট চুরির বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে। আগামী জানুয়ারিতে ফাইনাল খেলা হবে।’

গত ৩ অক্টোবর আমিন বাজারে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সমাবেশে বক্তব্যে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, “বিএনপির নেতারা এখন পথ হারিয়ে- পথিক দিশেহারা, দিশেহারা। দুই সেলফিতেই বাজিমাত; এক সেলফি দিল্লিতে, আরেক সেলফি নিউইয়র্কে। শেখ হাসিনা দিল্লিতে, তারপরে গিয়ে নিউইয়র্কে বাজিমাত’। তিনি বলেন, “কোথায় স্যাংশন, কোথায় ভিসা নীতি! তলে তলে আপস হয়ে গেছে, আপস হয়ে গেছে।”

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ‘তলে তলে আপস’ হওয়ার বিষয়ে তোলপাড় করা বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে গত ৫ অক্টোবর সচিবালয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, সেই বক্তব্যে তিনি ‘ভুল কিছু বলেননি’। “তলে তলে আপস মানে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়ন বা আমাদের সম্পর্ক ভালো আছে, আমি সেটা বুঝাতে চেয়েছি।”

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //