বছরের আলোচিত মেগা প্রকল্পগুলো

উন্নয়নশীল দেশের সরকারগুলো সাধরণত অবকাঠামোগত উন্নয়নকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে। মেগা প্রকল্প দীর্ঘস্থায়ী ও দৃশ্যমান বলে ক্ষমতা বা জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে তারা এসবেই বেশি আগ্রহ দেখায়। নির্বাচনী মাঠে এগিয়ে থাকতে ও জনতুষ্টির জন্য এসব উন্নয়ন তুলেও ধরা হয়। আওয়ামী লীগ সরকারও ক্ষমতায় এসেই পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ অনেকগুলো মেগা প্রকল্প হাতে নেয়। এর মধ্যে কোনো কোনোটার উদ্বোধনও হয়েছে। দেশে এখন ভোটের আমেজ। তাই বড় প্রকল্পের অনেকগুলো আবার মাঝপথেই উদ্বোধনের তোড়জোড় চলে। আংশিক উদ্বোধন করা হয়েছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের। বাকি কাজ শেষ করতে ক্ষমতাসীনরা ভোট চাইছে জনগণের কাছে। 

বঙ্গবন্ধু টানেল 
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম যোগাযোগ পথ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলটি ২৮ অক্টোবর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নদীর তলদেশে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম এ সড়ক পথটি যানচলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয় এর পরদিন। ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি ৭১ লাখ টাকায় নির্মিত টানেলটির সংযোগ সড়কসহ মোট দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার। প্রধান টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এছাড়া সংযোগ সড়ক ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার লম্বা। 

বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণের আগে চালিত সমীক্ষায় ২০১৭ সালকে সমাপ্তের বছর ধরে দৈনিক যানবাহন চলাচলের প্রাক্কলন করা হয়েছিল ১৭ হাজার ৩৭৪টি। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন না হয়ে সর্বশেষ চলতি বছরের ২৯ অক্টোবর থেকে যানবাহন চলাচল শুরু হয়। প্রাক্কলন অনুযায়ী এ বছর প্রতিদিন যানবাহন চলাচলের কথা ২০ হাজার ৭১৯টি। কিন্তু সর্বশেষ ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫৫ দিনে টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচল করেছে দৈনিক গড়ে ৫ হাজার ৮০৭টি, যা প্রাক্কলনের মাত্র ২৮ শতাংশ। টানেলকে ঘিরে সংযোগগত নানামুখী অবকাঠামো নির্মাণ না করা, নিরাপত্তা ইস্যুতে ধীরগতি ও ব্যবস্থাপনা সংকটে টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচলের হার খুবই নগন্য বলে মনে করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।  

জানতে চাইলে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহ-সভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, ‘পদ্মা সেতু কিংবা যমুনা সেতুর মতো কাঠামোগুলো জনপ্রিয় হয়েছিল এবং প্রাক্কলনের চেয়েও বেশি যানবাহন চলাচল করেছে। টানেলের একাধিক বিকল্প রয়েছে। ফলে টানেল ব্যবহারে সংযোগের নানামুখী সুবিধা, অবকাঠামো নির্মাণ জরুরি। শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, টানেল ব্যবহার শুরু হলেও এসব কাজ এখনো শুরুই করা যায়নি। একটি পরিকল্পিত প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের সবগুলো সংস্থা একযোগে কাজ না করায় টানেলের মতো বিশেষায়িত কাঠামো নির্মাণের পরও এর সুফল ভোগ করা যাচ্ছে না।’ 

টানেলের শতভাগ কাজ শেষ না হওয়ায় এমন পরিস্থিতি বলে মনে করছেন বঙ্গবন্ধু টানেলের প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশীদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘যানবাহন চলাচলের উপযোগী হলেও টানেল প্রকল্প ও টানেলকে ঘিরে একাধিক সংস্থার কাজ বাকি রয়েছে। ফলে এখনই প্রাক্কলন অনুযায়ী যানবাহন চলাচলের হিসাব মেলানো ঠিক হবে না। টানেলের সুবিধাগুলো শতভাগ স্থাপন হলে অবশ্যই টানেল ব্যবহারের হার বাড়বে। আপাতত আমরা প্রকল্পের বাকি কাজগুলো সম্পন্ন করার দিকেই মনোযোগ দিচ্ছি।’ 

পদ্মা সেতু রেল সংযোগ 
পদ্মা সেতু হয়ে দেশের দক্ষিণের পথে রেললাইন চালু হয়েছে। নতুন রেলপথটি ঢাকার গেন্ডারিয়া, কেরানীগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ থেকে পদ্মা সেতু হয়ে মাদারীপুর–ফরিদপুর গেছে। আগামী বছর এ রেলপথের বাকি অংশ ভাঙ্গা থেকে যশোর পর্যন্ত চালুর লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। ঢাকা-ভাঙ্গা রুটে পদ্মা সেতু হয়ে ১০ অক্টোবর নতুন ট্রেন সার্ভিস উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। 

প্রকল্পের বিবরণ অনুযায়ী, বাংলাদেশ রেলওয়ে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন রেল ট্র্যাক নির্মাণ করছে। এর ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এতে চীনের এক্সিম ব্যাংক ২১ হাজার ৩৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা ঋণ দিচ্ছে। কাজ শেষ হওয়ার পর রেল যোগাযোগ পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের মধ্য ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী শহরের প্রবেশ পথ আরও বর্ধিত হবে, যা মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও নড়াইল জেলার নতুন এলাকাকে যুক্ত করবে। তবে বিদেশি ঋণ নিয়ে বড় বিনিয়োগের এ প্রকল্প লোকাসানে থাকা রেলের আয় বাড়াতে পারবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।  

কক্সবাজার রেলপথ
বহুল প্রতীক্ষিত দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ উদ্বোধন করা হয় ১১ নভেম্বর। সেই সঙ্গে ওই প্রকল্পের অধীন নির্মিত দেশের একমাত্র আইকনিক রেলস্টেশনেরও উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। এ প্রকল্পের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে।  চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০১ কিলোমিটার রেললাইনটির কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালের জুলাইয়ে। ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকার এ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের অধীনে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের কলাতলী থেকে মাত্র ছয় কিলোমিটার দূরে ঝিলংজা ইউনিয়নের চান্দের পাড়ায় ২৯ একর জমিতে নির্মিত হয়েছে ১ লাখ ৮৭ হাজার বর্গফুটের দৃষ্টিনন্দন ছয়তলা ভবনের আইকনিক রেলস্টেশন। রেলস্টেশনটি নির্মাণে খরচ হচ্ছে ২১৫ কোটি টাকা।

শাহজালাল বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল
ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল গত ৭ অক্টোবর উদ্বোধন করা হয়। নতুন এ টার্মিনালে থাকবে বিশ্বমানের সব সুযোগ-সুবিধা ও যাত্রীসেবা। এটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ২১ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকা দিচ্ছে বাংলাদেশ। বাকি তহবিলের জোগানদাতা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। টার্মিনালটির নকশা করেছেন বিশ্বের অন্যতম সেরা ও ব্যস্ততম হিসেবে পরিচিত সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দরের নকশাকার রোহানি বাহারিন।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
তীব্র যানজটে ধুঁকতে থাকা ঢাকা শহরে তৈরি হচ্ছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত নির্মাণ করা হচ্ছে উড়াল এ পথ। ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে বিমানবন্দরের কাওলা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত অংশের কাজ। প্রথম ফেজের দুয়ার খুলে দেয়া হয় ২ সেপ্টেম্বর।

মেট্রোরেল
আগারগাঁও-মতিঝিল অংশের মেট্রোরেল ৪ নভেম্বর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগারগাঁও থেকে মতিঝিল সেকশনের দৈর্ঘ্য আট দশমিক ৭২ কিলোমিটার। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) মেট্রোরেল নির্মাণ করছে এবং প্রকল্পের জন্য ১৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা সহজ শর্তে ঋণ সহায়তা দিয়েছে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ সার কারখানা
নরসিংদীতে নভেম্বর ১২ উদ্বোধন করা হয় নবনির্মিত ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা (জিপিইউএফএফ)। আর এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এ ধরনের সর্ববৃহৎ কারখানা। পরিবেশবান্ধব, জ্বালানি সাশ্রয়ী ও আধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক কারখানাটিতে বার্ষিক ৯ লাখ ২৪ হাজার টন সার উৎপাদন করা যাবে। বর্তমানে স্থানীয় কারখানাগুলো ১০ লাখ টনের মতো সার উৎপাদন করে থাকে। ফলে বাকি চাহিদা আমদানির মাধ্যমে পূরণ করতে হয়। 

কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে এ প্রকল্পটি অতিগুরুত্বপূর্ণ হলেও গ্যাস সংকটকে আরো তীব্র করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

কালশী ফ্লাইওভার
রাজধানীর মিরপুরে ২ দশমিক ৩৪ কিলোমিটার কালশী ফ্লাইওভার যান চলাচলের জন্য ১৯ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওইদিন ইসিবি চত্বর থেকে কালশী পর্যন্ত ৩ দশমিক ৭০ কিলোমিটার প্রসারিত রাস্তাও তিনি উদ্বোধন করেন, যা চার থেকে ছয় লেনে উন্নীত ও প্রশস্তকরণ করা হয়েছে। এর ফলে মিরপুর, ডিওএইচএস, পল্লবী, কালশী, মহাখালী, বনানী, উত্তরা ও বিমানবন্দরের মধ্যে যোগাযোগ অনেকটাই সহজ করেছে। 

দাশেরকান্দি পয়ঃশোধনাগার
দাশেরকান্দিতে নির্মিত দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম একক পয়ঃশোধন কেন্দ্র (স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট-এসটিপি) ১৩ জুলাই উদ্বোধন করা হয়। শুরুতে প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ ও খরচ বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৭১২ কোটি টাকায়। রাজধানীর আশপাশের নদীগুলোকে দূষণের হাত থেকে রক্ষায় সুদৃশ্য এ অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। সমন্বিত আধুনিক ব্যবস্থাপনার কারণে প্রতিদিন ৫০ মিলিয়ন পয়ঃশোধন করা সম্ভব হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //