নাচের জন্যই প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম: নাদিয়া আহমেদ

বিনোদন ডেস্ক
প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২০২৩, ১৪:২২

অভিনেত্রী নাদিয়া আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
অভিনেত্রী নাদিয়া আহমেদ। নাচেও সমান পারদর্শী। অভিনয় তার পেশা হলেও নাচ তার ভালোবাসা। অভিনয়, নাচ ও ব্যক্তিজীবন নিয়ে কথা বলেছেন ত্রৈমাসিক দেশকালের সঙ্গে...
ছোটবেলার কথা জানতে চাই। কখন থেকে মঞ্চে নাচ শুরু হলো?
স্কুলে ভর্তির আগেই আমাকে নাচের ক্লাসে ভর্তি করা হয়েছিল। শিশু একাডেমিতে নাচ শিখতাম। সেখানে প্রায়ই অনেক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দলীয় নাচ পরিবেশন করতে হতো। প্রথম কবে মঞ্চে নাচ পরিবেশন করেছি, সেটা নিশ্চিত হয়ে বলতে পারব না। তবে একদম ছোটবেলায় মঞ্চে একটা পরিবেশনের কথা আমার অল্প মনে আছে। সম্ভবত সেটিই আমার মঞ্চে প্রথম পরিবেশনা।

একুশে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠান ছিল ওটা। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানের সঙ্গে একটি দলীয় পরিবেশনা। খুব সম্ভবত এটি ১৯৮৫ সালের ঘটনা; কিন্তু সেই দলীয় পরিবেশনায় আমাকে কোনো নাচই করতে হয়নি। কারণ আমার চরিত্রটি ছিল মৃত ব্যক্তির। দলের এক বড় আপু আমাকে কোলে করে নিয়ে মঞ্চে ঢুকেছিলেন। মঞ্চে পুরোটা সময় আমাকে চোখ বন্ধ করে রাখতে হয়েছিল, হাত-পা নাড়ানোও বারণ ছিল।
ক্যামেরার সামনে প্রথম কবে?
নাচের জন্যই প্রথম ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। সেটা ছিল বিটিভির ‘শিশুমেলা’ নামের ছোটদের একটা অনুষ্ঠান। কী গানের সঙ্গে নেচেছিলাম মনে নেই। এমনকি বড় হয়ে অনুষ্ঠানটির ভিডিও দেখেছি। তখনো গানটি বুঝতে পারিনি। কারণ, ওই ভিডিওতে কোনো শব্দ ছিল না; কিন্তু ছোট্ট আমাকে হেলেদুলে নাচতে দেখে নিজের কাছেই বেশ মজা লাগছিল। শিশুশিল্পী হিসেবে কোনো একটা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে পারিশ্রমিক পেয়েছিলাম ৩০০ টাকা। ওটাই ছিল আমার প্রথম পারিশ্রমিক। ছোটবেলায় যেসব পারিশ্রমিক পেতাম মা আমার নামে সঞ্চয় করে রাখতেন। আমার নাচের অনেক অনুষ্ঠানের পোশাক ও অনুষঙ্গ কেনার কাজে খরচ করা হতো সেসব পারিশ্রমিক। প্রায় সবার জীবনে প্রেম আসে। প্রথম প্রেমের কথা জানতে চাই।
বেশির ভাগ মানুষের মতো আমার প্রথম প্রেমও হয়েছিল স্কুলে থাকতে। কৈশোরের প্রেম যেমন হয়, আমার সেই প্রেমও তেমনি ছিল। প্রথম প্রেমের উচ্ছ্বাস আর উৎকণ্ঠা মানেই অন্যরকম এক অনুভ‚তি। তার একটু দেখা পেলেই হৃৎস্পন্দন বেড়ে যেত। ল্যান্ডফোন থেকে চুরি করে ফোনে কথা বলতাম। আর মনে থাকত ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়। প্রথম প্রেম তেমন সিরিয়াস ছিল না, আসলে লুকোচুরির মজাটাই বেশি উপভোগ করতাম। কে ছিল সে, এটা এখন আর না বলি।

শৈশবে সিনেমা দেখার বাতিক ছিল?
হ্যাঁ, দেখতাম। সিনেমা হলে গিয়ে আমার দেখা প্রথম ছবি ‘দুই জীবন’। আমার বয়স তখন খুব কম; কিন্তু নিজে থেকেই আফজাল হোসেন ও দিতি অভিনীত এই ছবি দেখার বায়না ধরেছিলাম। তখন তো আফজাল হোসেনের একটা ভীষণ ক্রেজ ছিল। বড়দের দেখাদেখি তাই আমিও তাঁর ছবিটি দেখার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা সে সময় বিজয়নগরে থাকতাম। রাজমণি সিনেমা হলে পরিবারের সবার সঙ্গে সিনেমাটি দেখেছিলাম। একই হলে ‘আলীবাবা চল্লিশ চোর’ ছবিটিও খুব শখ করে দেখেছিলাম। রূপকথার গল্পের প্রতি আমার ছিল বিশেষ ঝোঁক। আলী বাবার গল্পে ‘চিচিং ফাঁক’ বলে গুহার দরজা খোলার বিষয়টা আমার খুব মজা লাগত।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারকাদের ছবিতে মানুষজন বিভিন্ন মন্তব্য করে। এ প্রসঙ্গে মূল্যায়ন কী?
ফেসবুক চালু হওয়ার পর পরিচিত বা অপরিচিত, যে কারও পোস্টে গিয়ে যে কেউ মন্তব্য করে আসে। ওই মন্তব্যে কারও খারাপ লাগল কি না, তা নিয়ে ভাবে না মন্তব্যকারীরা। ভাবে না যে তাঁর কটু মন্তব্যের কারণে কেউ বিব্রত হতে পারে, যার পোস্টে বা ছবিতে মন্তব্য করছে, তার সারাটা দিন খারাপ যেতে পারে। আমি যে পেশায় আছি, এখানে প্রতিদিনই আমাকে মেকআপ করতে হয়, মেকডাউন করতে হয়।
এসব না বুঝেই আমাকে ছোট করার জন্য তাঁরা এসব মন্তব্য করে। আজকাল তো মানুষ রাস্তাঘাটে বের হলেই মেকআপ করে। এটা তো মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার। শুধু আমি কেন, কেউ কারও পোস্টে খারাপ মন্তব্য করুক, এটা আমি চাই না। আমার নীতি কাউকে বাজে কথা বলব না, কেউ বললে তাঁকে বøক করে দেব। জীবনে শান্তি দরকার। চেষ্টা করি মানুষের সঙ্গে ভালোভাবে মিলেমিশে থাকতে। আমি চাই মানুষও আমার সঙ্গে ভালো থাকুক।
অভিনয়ের ব্যস্ততার মাঝে রান্না করার সুযোগ হয়?
সুযোগ করে নিতে হয়। দেশের বিভিন্ন পদ রান্না করতে পছন্দ করি। মাঝে মাঝে চাইনিজ রান্নাও করি। আমার রান্না করা গরুর মাংস ও কাবাব যারা খেয়েছে তারা প্রশংসা করেছে। চিংড়ি মাছ বিভিন্নভাবে রান্না করা হয়। নাঈম তো আমার হাতের রান্নাকে অমৃত বলে।
বর্তমানে টেলিভিশনে নাচের অনুষ্ঠানের মান কেমন?
নাচের প্রকৃত শিল্পীদের টিভি চ্যানেলগুলো যোগ্য সম্মান দিচ্ছে না। প্রায় চ্যানেলের প্রযোজকদের কাছে শুনতে হয় নাচের অনুষ্ঠানের জন্য বাজেট নেই। অথচ টেলিভিশনের বিনোদনমূলক বেশিরভাগ অনুষ্ঠানই শুরু হয় নাচ দিয়ে। আবার শেষও হয় নাচের মধ্য দিয়ে। এ ছাড়া অনেক সময় দেখা যায় নাচের প্রকৃত শিল্পীদের বাদ দিয়ে বেশি বাজেটে শোবিজের অন্যদেরকে দিয়ে নাচের অনুষ্ঠান করা হচ্ছে।

করোনার এ সময়ে শুটিংয়ের অভিজ্ঞতা কেমন হচ্ছে? ইউনিটের পরিবেশ কেমন?
আমার আউটডোরে শুটিং হচ্ছে বেশি। আমি আউটডোরের কাজকেই এই সময়ে একটু নিরাপদ মনে করছি। শুটি স্পটে একটু দূরে বসা যায়। শুটিং হাউসে একই রুমে সবাইকে থাকতে হয়; কিন্তু আউটডোরে তেমনটা হচ্ছে না। শুটিং স্পটে বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। আগে আমরা স্পটে মেকাপ নিতাম। এখন বাসা থেকেই মেকাপ নিয়ে আসছি। এছাড়া আমি যে ইউনিটগুলোর সঙ্গে কাজ করেছি তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কাজ করছেন।

অনেক অভিনয়শিল্পীকে টিভি ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করতে আগ্রহী হতে দেখা যায় না। আপনি তার ব্যতিক্রম। নিয়মিত ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করছেন। এর কারণ কী?
আমাদের এখন বিনোদনের অনেক মাধ্যম এসেছে। কাজের সংখ্যাও বেড়েছে; কিন্তু এটি সত্যি যে, উৎসবগুলোতেই খণ্ড নাটকের দিকে দর্শকদের আগ্রহ থাকে বেশি। বিভিন্ন উৎসবেই ভালো গল্পে একক নাটক নির্মাণ হচ্ছে বেশি; কিন্তু আমি শুধু উৎসবগুলোতেই দর্শকদের সঙ্গে থাকতে চাই না। দর্শকদের সঙ্গে থাকার জন্য ধারাবাহিক নাটকের বিকল্প নেই। তাই নিয়মিত ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করছি।

এই সময়ের শিল্পীরা কেন ধারাবাহিকে খুব বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না বলে মনে হয়?
একটা সময় বাংলাদেশ টেলিভিশনের ধারাবাহিক নাটকের মধ্য দিয়ে শিল্পীরা পরিচিতি পেতেন বেশি। পরবর্তীতে বেসরকারি টিভি চ্যানেলেও অনেক ধারাবাহিক নাটক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অনেক শিল্পীও পরিচিতি পেয়েছেন। তবে এখন সময়টা তার বিপরীত। এখন ইউটিউবের নাটকের প্রতি কারও কারও ঝোঁক বেড়েছে। অনেকেই রাতারাতি তারকা হতে চান। বেশি বেশি ভিউ, লাইক ও ফলোয়ারের জন্য তারা মরিয়া হয়ে উঠেছেন। এ ধরনের অভিনয় শিল্পীরাই ধারাবাহিক নাটক করতে চান না।
এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি। আপনার জীবনসঙ্গী অভিনেতা এফএস নাঈম। দুজন ব্যস্ত মানুষের সংসার জীবন কিভাবে কাটে?
ব্যস্ততার কারণে আমরা দুজনই দিনের বেলায় বাইরে থাকি। দু’জনই অভিনয়ের মানুষ, তাই শুটিংয়ের কারণে এটি মেনে নিতে হচ্ছে। তবে আমাদের বোঝাপড়ায় কোনো কমতি নেই। যেহেতু দু’জনেই অভিনয়ে আছি, তাই একে অপরকে সহজে বুঝতে পারি। সংসার পরিচালনার জন্য দু’জনের প্রতি দু’জনের আস্থা ও বিশ্বাস থাকতে হয়। আমাদের মধ্যে সেটি আছে। তাই কোনো সমস্যা হচ্ছে না। এভাবেই সংসার করতে চাই।
-19-02-2-64044c8862fa2.jpg)
শোবিজের অন্য জুটিদের দেখা যায় এক সঙ্গে জুটি বেঁধে কাজ করতে; কিন্তু আপনাদের সেভাবে খুব একটা দেখা যায় না। এ নিয়ে কী বলবেন?
এটি নির্মাতাদের ওপর নির্ভর করে। আমরা দু’জন কাউকেই বলি না আমাদের নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার জন্য।
ওটিটি প্ল্যাটফর্ম বেশ জমে উঠেছে গেল কয়েক বছরে। এ প্ল্যাটফর্ম নিয়ে ভাবনা কী?
শিল্পীদের সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। এ প্ল্যাটফর্ম সময়ের দাবি। ওয়েবের কাজে একটি ফিল্মি আমেজ পাওয়া যায়। এ ব্যাপারটি ভালো লাগে। গল্প ও চরিত্র পছন্দ হলে অবশ্যই কাজ করব।

অভিনয় ক্যারিয়ারে পার করেছেন দীর্ঘ সময়। নিজেকে মেলে ধরেছেন নানান চরিত্রে। টিভি নাটকে আপনার গ্রহযোগ্যতাও অনেক; কিন্তু সেই তুলনায় চ্যালেঞ্জিং চরিত্রে তেমন দেখা যায় না আপনাকে। এ নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?
এটা ঠিক চ্যালেঞ্জিং কাজের সংখ্যা আমার কম। এর কারণও আছে। গল্প তেমন না হলে তেমন কাজ করব কীভাবে? আমরা কথায় কথায় বলি, দর্শকের চাহিদার কথা। তবে এর সঙ্গে আমি একমত নই। আমরা দর্শকদের যা দেব তারা সেটিই উপভোগ করবেন। এখন কীভাবে দেব সেটি শিল্পী-নির্মাতার ওপর নির্ভর করে। ক্যারিয়ারে এই সময়ে এসে আমিও চাই ভিন্ন কিছু কাজ করতে। যেগুলো দর্শকের কাছে আমাকে অন্য মাত্রায় নিয়ে যাবে। এখানে এখন অন্য পেশার লোকজনও কাজ করে। তাই অনেক সময় প্রকৃত শিল্পীদের মূল্যায়ন হয় না।

আপনার বাবা, মা, বোন আমেরিকা থাকেন। তাই নিয়ম করে ওখানে যাচ্ছেন। ওখানে থিতু হবেন?
সত্যি বলতে কী আমি আমার দেশ বাংলাদেশকে ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি। আমি আমার কর্মক্ষেত্রকে, এখানকার মানুষগুলোকে ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি। জানি আমার দেশে নানান সমস্যা রয়েছে; কিন্তু তারপরও এই দেশে আমার দেশ, আমাদের দেশ। দেশকে ছেড়ে যাবার কোনো আগ্রহ নেই আমার। এখানেই আমার আজকের আমি হয়ে ওঠা। যেখানকার আলো বাতাসে বেড়ে উঠেছি, বড় হয়েছি, পরিণত হয়েছি সেখানকার আলো বাতাসেই স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে ভালোবাসি আমি। দেশের বাইরে আসলে নাঈমকে খুউব মিস করি।