Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

ইলেকট্রনিক যুদ্ধে এগিয়ে রাশিয়া

Icon

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ০৮ জানুয়ারি ২০২৩, ১৫:৩১

ইলেকট্রনিক যুদ্ধে এগিয়ে রাশিয়া

দীর্ঘদিন ধরেই ধারণা করা হয়, রাশিয়ার কাছে অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক সমরাস্ত্র রয়েছে। তবে ইউক্রেন যুদ্ধে এর সর্বোৎকৃষ্ট ব্যবহার করেছে দেশটি। এবারই প্রথম ইলেকট্রনিক যুদ্ধ এতটা স্পষ্টভাবে সামনে এলো।

আর এজন্যও ২০২২ সালটি যুদ্ধের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্ব পাবে। কার্যত এ যুদ্ধে রাশিয়া টিকে আছে ওই বিশেষায়িত সমরাস্ত্রের জন্যই। ইউক্রেন হাজার হাজার ড্রোন ব্যবহার করেছে যুদ্ধের প্রথম দিক থেকে।

এর প্রায় ৯০ শতাংশই ধ্বংস করে দিয়েছে রুশ বাহিনী। যুদ্ধে দুপক্ষই ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। তবে ইলেক্ট্রনিক জ্যামারের জোরে এ যুদ্ধে খানিকটা এগিয়ে রয়েছে রাশিয়া। 

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ যতই দীর্ঘায়িত হচ্ছে, ইলেকট্রনিক যুদ্ধের নানা কৌশলের সুবাদে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী ক্ষেত্রবিশেষে বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে। যুদ্ধের একাধিক পর্যবেক্ষক বলছেন, আগ্রাসনের শুরুর দিনগুলোর চেয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে এখন বড় ভূমিকা পালন করছে রাশিয়ার ‘ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার (ইডব্লিউ)’ সিস্টেমগুলো।

ইডব্লিউ সিস্টেম

গত বছর ফেব্রুয়ারির শেষদিকে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। যুদ্ধের শুরুর দিকে কিয়েভের হাতে সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল তাদের আনম্যানড এরিয়াল ভেহিকল (ইউএভি) ড্রোনগুলো। এই ড্রোনগুলোর সাহায্যে তারা সহজেই রাশিয়ার বিশাল কামান আর রকেট লঞ্চারের অবস্থান নিখুঁতভাবে শনাক্ত করে এগুলোর বিরুদ্ধে নিজেদের ছোটখাটো আর্টিলারি দিয়েই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছিল।

রাশিয়া কয়েক সপ্তাহ সময় নেয় তাদের জ্যামিং ব্যবস্থা নির্মাণের জন্য। তবে একবার সেটি চালুর পরই তারা ইউক্রেনের কমান্ডারদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাশিয়ার ইলেকট্রনিক জ্যামারগুলো ইউক্রেনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র ড্রোনগুলোকে ঠিকভাবে কাজ করতে দিচ্ছে না, ফলে রাশিয়ার যুদ্ধাস্ত্রগুলো ঠিকভাবে শনাক্ত করতে পারছে না এসব ড্রোন। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, কার্যত ওই ইলেকট্রনিক জ্যামারগুলোই রাশিয়াকে যুদ্ধে টিকিয়ে রেখেছে এবং শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে এসবি-৬৩৬ এসভেত-কেইউ সিগনালস-ইন্টেলিজেন্স সিস্টেম, যেটি ইউক্রেনের ড্রোনগুলোর অবস্থান তাদের রেডিও সিগন্যাল ট্রেস করে নিখুঁতভাবে শনাক্ত করতে পারে।

এ ছাড়াও রয়েছে আরবি-৩৪১ভি লিয়ার-৩ সিস্টেম, যার মধ্যে রয়েছে সেলুলার-জ্যামিং পেলোড বহন করা অরলান-১০ ড্রোন এবং কামাজ-৫৩৫০ ট্রাকের ওপর থাকা কমান্ড পোস্ট। আর-৯৩৪বি সিনিৎসা রেডিও জ্যামার এবং স্যাটেলাইট সিগনাল আটকে দেওয়া আর-৩৩০জেডএইচ ঝিতসেলও রাশিয়ার এই জ্যামিং সিস্টেমের অংশ।

ক্রাসুকা-৪: এক্স-ব্যান্ড এবং কে ইউ-ব্যান্ড রাডারগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করে। বিশেষ করে যুদ্ধজাহাজ, ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্র এবং নিচু কক্ষপথের উপগ্রহগুলোর যোগাযোগব্যবস্থা ব্যাহত করতে এটি কাজে লাগানো হয়।

ক্রাসুকা-২: এস ব্যান্ড রাডারগুলোকে লক্ষ্যবস্তু বানায়। বিশেষ করে আকাশে থাকা বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের দুর্বলতা শনাক্ত করে এটি। ক্রাসুকা-৪-এর সঙ্গে এটি ব্যবহার করা হয়।

লিয়ার-৩: সামরিক রেডিও, সেলুলার যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে পারে। কয়েকশ কিলোমিটার পর্যন্ত এটি নেটওয়ার্ক জ্যাম করে দিতে পারে।

৩৩০ জেডএইচ জিটেল: জ্যামারটি ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত জিপিএস ও স্যাটেলাইট যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে পারে। এটি ট্রাক কমান্ড পোস্ট থেকেও চালানো যায়।

মুরমানস্ক-বিএন: দূরপাল্লার যোগাযোগ শনাক্তকরণ ও সামরিক রেডিও জ্যামে ব্যবহার করা হয়।

আর৯৩৪-বি ও এসপিএন ২, ৩, ৪: ওয়্যারলেস যোগাযোগ ও এয়ার টু সারফেস গাইডেন্স কন্ট্রোল রাডার জ্যাম করে দিতে সক্ষম।

রিপিলেন্ট-১: অ্যান্টিড্রোন সিস্টেম।

মস্কোভা-১: শত্রুর জাহাজ ও যুদ্ধবিমানের অবস্থান শনাক্ত করতে পারে।

ক্রিমিয়া থেকে ডনবাস

২০১৪ সালে ক্রিমিয়ার দখল নেওয়ার পর থেকেই রুশ সেনাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই ইডব্লিউ। ডনবাস অঞ্চলেও দীর্ঘদিন ধরেই রুশ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা লিয়ার-৩ ও অরল্যান্ড-১০ ড্রোনব্যবস্থা ব্যবহার করে আসছিলেন। এগুলো ব্যবহার করে ইউক্রেনীয় বাহিনীর রেডিও যোগাযোগ শনাক্ত এবং তাদের ওপর রকেট হামলা করে আসছিলেন বিচ্ছিন্নতাবাদীরা।

কিন্তু ইউক্রেনে রুশ হামলা শুরুর পর থেকেই এ যন্ত্রের ব্যাপক ব্যবহার চোখে পড়েনি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা ড্রোনবিধ্বংসী ব্যবস্থা ব্যবহার করে ইউক্রেনের সেনারা শত শত রুশ ড্রোনের জিপিএস সংকেত জ্যামিং করে তা ধ্বংস করেছেন। এরপরই রুশ সেনারা তাদের ইডব্লিউর ব্যবহার বাড়িয়ে দেন। লিয়ার-৩ ব্যবহার করে ইউক্রেনের যুদ্ধবিমান শনাক্ত করতে শুরু করেন।

রুশ সৈন্যরা ইউক্রেনের পূর্বে রাশিয়া নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল থেকে লড়াই করছেন। এখন ছড়িয়ে পড়ার বদলে তারা ইডব্লিউর সহায়তায় ইউক্রেনীয় সেনাদের অবস্থান বের করে সেখানে হামলা করছেন এবং সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন। আক্রমণে গতি আনতে বড় ব্রিগেডের বদলে ছোট ছোট দলে সেনাদের ভাগ করা হয়েছে। তাদের বলা হচ্ছে, ব্যাটালিয়ন ট্যাকটিক্যাল গ্রুপ (বিটিজি)।

এসব গ্রুপের হাতে আর-৩৩০জেডএইচ জিটেলের মতো স্বল্প দূরত্বে শত্রুসেনার অবস্থান শনাক্তকারী সিস্টেম তুলে দেওয়া হয়েছে। এই সিস্টেম বাইরাকটার টিবি২এস ও ডিজেআই ম্যাভিক ড্রোনের জিপিএস সংকেত জ্যাম করে দিতে পারে। বিটিজির কাছে থাকা আর-৯৩৪ বিভিএইচএফ ও এসপিআর-২ জ্যামার দিয়ে ইউক্রেনীয় বাহিনীর যোগাযোগ ব্যবস্থাও নষ্ট করে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। 

তড়িৎ প্রকৌশলীদের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ার্সের (আইইইই) প্রকাশনা স্পেকট্রামে সম্প্রতি রুশ সেনাদের ইলেকট্রনিক সমরাস্ত্র ও ইউক্রেন যুদ্ধে এর প্রভাব নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রুশ সেনাদের হামলার প্রথম দিকে ইডব্লিউ সিস্টেমগুলো তেমন কোনো কাজে লাগেনি। কিন্তু এখন যুদ্ধের মোড় রাশিয়ার দিকেই ঘুরিয়ে দিচ্ছে এই প্রযুক্তি।

রাশিয়ার হামলার মুখে ইউক্রেনের সেনারা শক্ত প্রতিরোধ গড়লেও অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক সমরাস্ত্রের কারণে তারা ঠিকভাবে পেরে উঠছেন না। রাশিয়ার এই ইলেকট্রনিক-ওয়্যারফেয়ার যন্ত্রগুলো এতটাই কার্যকর যে, ওএসসিই (অর্গানাইজেশন ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড কো-অপারেশন ইন ইউরোপ) তাদের নিজেদের ড্রোনই আকাশে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে।

ওএসসিই-এর ইউএভি ওড়ানোর সময় সিগন্যালে বাধা পাওয়ার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ফেব্রুয়ারিতে ১৬ শতাংশ, মার্চে ২৮ শতাংশ এবং এপ্রিলে ৫৮ শতাংশ। রাশিয়ার ইডব্লিউ সিস্টেম সবচেয়ে ভালো কাজ করে যখন তাদের অপারেটররা পুরো সিস্টেম ঠিকভাবে সেট-আপ করার জন্য পর্যাপ্ত সময় পায়। এ কারণেই পূর্ব ইউক্রেনের ডনবাস অঞ্চলে রাশিয়ার ইডব্লিউ সিস্টেম প্রতিপক্ষের জন্য আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে।

একই কারণে প্রথম কয়েক সপ্তাহেও রাশিয়ার জ্যামিং সিস্টেম ভালোভাবে কাজ করেনি। রাশিয়ার সৈন্যরা এগোলেও খুব দ্রুত পিছিয়ে এসেছে, যে কারণে তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারেনি ইডব্লিউর সৈন্যরা। ফলে জ্যামিং সিস্টেম ভালোভাবে কাজ করেনি। তবে মার্চ আর এপ্রিল মাসে অবস্থার পরিবর্তন হয়, যখন রুশ বাহিনী মধ্য ইউক্রেন থেকে সরে এসে পূর্ব অংশে ঘাঁটি গাড়ে।

পূর্বাঞ্চলে ধীরে ধীরে রাশিয়ান জ্যামারগুলোর পরিমাণ বাড়তে থাকে। ডনবাস অঞ্চলে রাশিয়া প্রতি ১৩ মাইলে ১০টি করে ইডব্লিউ কমপ্লেক্স তৈরি করে রেখেছে। একই সঙ্গে এই জ্যামারগুলো ফ্রন্টলাইনে থেকে আর্টিলারির অবস্থান শনাক্ত করা এবং ইউক্রেনের যুদ্ধবিমান ও ইউএভি জ্যাম করতে থাকে।

ইউক্রেনের ড্রোনের ওপর এই ধ্বংসযজ্ঞ ইউক্রেনের আক্রমণকে অনেকটাই অকার্যকর করে দিয়েছে, তাদের আর্টিলারিগুলো নিখুঁতভাবে অবস্থান শনাক্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছে এবং রুশ সৈন্যদের সময় দিচ্ছে পুনরায় তাদের শক্তি বাড়িয়ে আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হতে।

তবে যুদ্ধ এখানেই শেষ হয়ে যাচ্ছে না। পশ্চিমা মদদে ইউক্রেন ইলেকট্রনিক যুদ্ধে জয়ী না হলেও টিকে যে থাকবে, এটুকু নিশ্চিত। তবে রাশিয়া যুদ্ধের প্রথমদিকে কোণঠাসা হয়ে পড়লেও ইলেকট্রনিক জ্যামারগুলো তাদের এখনো টিকিয়ে শুধু রাখেনি, অগ্রসর অবস্থানে রেখেছে। তবে এর মানে যুদ্ধ জয় নয়।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫