
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিলের মতোই ব্রাজিলের কংগ্রেস, প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ ও সুপ্রিম কোর্ট দখল করে নেয় দাঙ্গাবাজরা। ছবি: রয়টার্স
দুই বছর আগে ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট ভবন ক্যাপিটল হিলে নজিরবিহীন দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। এবার একই ধরনের দাঙ্গার শিকার দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিল। এ দুই ঘটনার মধ্যে রয়েছে যেমন রাজনৈতিক যোগসূত্র, তেমনি রয়েছে মতাদর্শিক নৈকট্য। বিশ্লেষকদের মতে, ব্রাজিলের দাঙ্গায় কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছায়াই দেখা গেছে।
সদ্য ব্রাজিলের ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানো সাবেক প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারো মতাদর্শিকভাবেই ট্রাম্পের সঙ্গে যুক্ত। ট্রাম্পের ফ্লোরিডার বাসভবনে গত নভেম্বরে সাবেক এই প্রেসিডেন্ট ও বলসোনারোর ছেলে এদুয়ার্দো বলসোনারোর মধ্যে একটি বৈঠকের পর রাজনৈতিক যোগসূত্রের বিষয়টি সামনে আসে। ওই সফরে ব্যানন ও ট্রাম্পের উপদেষ্টা জ্যাসন মিলারের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছিলেন এদুয়ার্দো।
ট্রাম্প সরকারের হোয়াইট হাউসের প্রধান কৌশলবিদ ছিলেন ব্যানন। ক্যাপিটল হিল দাঙ্গার আগের দিন পডকাস্ট শ্রোতাদের উদ্দেশে ব্যানন বলেছিলেন, ‘আগামীকাল ক্ষুব্ধ জনতার আকস্মিক তাণ্ডব শুরু হতে যাচ্ছে।’ ওই হামলার তদন্তে গঠিত কংগ্রেসনাল কমিটির সামনে সাক্ষ্য দেওয়ার আদেশ মানতে অস্বীকার করায় তাকে চার মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পরে আপিল নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।
ব্রাজিলে গত অক্টোবরে প্রথম দফার নির্বাচনে কেউ ৫০ শতাংশ ভোট না পাওয়ায় নির্বাচন দ্বিতীয় দফায় গড়ায়। তখনো চূড়ান্ত ফল জানার ধারেকাছে কেউ নেই। কিন্তু নির্বাচনে কারচুপির ভিত্তিহীন গুজব ছড়ান ব্যানন। কয়েক সপ্তাহ ধরেই তিনি কাজটি করছিলেন। ব্যানন ও তার অতিথিরা পডকাস্টের কয়েকটি পর্ব এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘বেহাত নির্বাচন’ ও ছায়াশক্তির অভিযোগ তোলেন। ব্যানন ‘ব্রাজিলীয় বসন্ত’ হ্যাশট্যাগ চালু করেন। এমনকি বলসোনারো ফল মেনে নেওয়ার পরও তার সমর্থকদের উৎসাহ দিতে থাকেন তিনি।
ট্রাম্পের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ মিত্রদেরই একজন ব্যানন, যারা যুক্তরাষ্ট্রের ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টিতে একই কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। ওয়াশিংটনে ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারির ঘটনার মতো এসব ভুয়া প্রতিবেদন ও গুজব ব্রাজিলে নিজেদের দাবির সপক্ষে হামলাকারীদের সরকারি ভবনের জানালা ভাঙচুর ও ভেতরে ঢুকে তাণ্ডব চালাতে উসকে দিয়েছে।
এ উসকানির কুৎসিত রূপটি ব্রাজিলবাসী দেখেছে গত ৮ জানুয়ারি (রবিবার)। সেদিন দেশটির জাতীয় রঙের পোশাক পরে এবং গায়ে জাতীয় পতাকা জড়িয়ে দাঙ্গাবাজরা হামলায় অংশ নেন। দাঙ্গাবাজরা ব্রাজিলের পার্লামেন্ট ভবন কংগ্রেস, প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ ও সুপ্রিম কোর্ট দখল করে নেয়। সেখানে ভাঙচুর, তাণ্ডব চালায়। তবে এ ঘটনায় ব্যাননের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গেটাতে তিনি বারবার লিখেছেন, ‘লুলা নির্বাচনের ফল চুরি করেছেন... ব্রাজিলীয়রা এটা জানে।’ যুক্তরাষ্ট্রের ২০২০ সালের নির্বাচনের পর ‘চুরি বন্ধ করো’ নামের একটি আন্দোলনের সূচনা হয়। উগ্রপন্থি এই গোষ্ঠীটির নেতাদের একজন হিসেবে উত্থান হয় আলি আলেক্সান্ডারের। ব্রাজিলের বিক্ষোভকারীদের উসকানি দিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘যা যা করার করো।’
যুক্তরাষ্ট্রের ২০২০ সালের ফল অস্বীকারকারী দলবাজরা নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে শোরগোল তৈরির ওপর জোর দিয়েছিলেন। একইভাবে ব্রাজিলে তারা ভোট গণনার ইলেকট্রনিক মেশিন নিয়ে সন্দেহ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ৮ জানুয়ারি দাঙ্গাবাজদের বহন করা একটি ব্যানারে ইংরেজি ও পর্তুগিজ ভাষায় লেখা ছিল, ‘আমরা সোর্স কোড চাই।’ বলসোনারোকে হারাতে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন কোনো না কোনোভাবে প্রোগ্রামিং করা হয়েছিল কিংবা হ্যাক করা হয়েছিল, এমন গুজবের প্রতি ইঙ্গিত করে এটা লেখা হয়েছিল।
ব্রাজিলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি উসকে দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পবিরোধীদের কয়েকজন তাৎক্ষণিক সাবেক এই প্রেসিডেন্ট ও তার উপদেষ্টাদের দায়ী করেছেন। প্রতিনিধি পরিষদের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সদস্য ও ক্যাপিটল হিল দাঙ্গার তদন্ত কমিটির সদস্য জেমি রাসকিন এক টুইট বার্তায় লিখেছেন, ‘ট্রাম্পের ৬ জানুয়ারির দাঙ্গাবাজদের পর নিজেদের একইভাবে ফ্যাসিস্ট হিসেবে তুলে ধরেছেন’ ব্রাজিলের বিক্ষোভকারীরা।
ব্রাজিলের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস জানিয়েছে, দাঙ্গায় অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্রাসিলিয়ার সাবেক জননিরাপত্তা প্রধান অ্যান্ডারসন টরেস ও অন্য সরকারি কর্মকর্তারাও রয়েছেন, তবে ব্রাজিলের সাবেক বিচারমন্ত্রী টরেস তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ব্রাজিলের সামরিক পুলিশের সাবেক কমান্ডারকে এরই মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ব্রাসিলিয়াতে নিরাপত্তা নজরদারির দায়িত্বে থাকা রিকার্ডো ক্যাপেলি বলেছেন, সরকারি ভবনগুলোতে হামলার আগে টরেসের ‘কমান্ডের অভাব’ ছিল।
এ ছাড়া বলসোনারোর সমর্থকদের তাণ্ডবের পর পুলিশ কমান্ডার কর্নেল ফাবিও অগাস্টোকে তার পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত এক হাজার ৫০০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে ব্রাজিল পুলিশ। প্রেসিডেন্ট হিসেবে বামপন্থি নেতা লুই ইনাসিও লুলা দা সিলভার অভিষেকের মাত্র এক সপ্তাহ পর ব্রাজিলের রাজধানীতে এ হামলা চালিয়েছেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী বলসোনারোর সমর্থকরা।
এ হামলার নিন্দা জানিয়ে টুইট করেছেন বলসোনারো। তবে এ ঘটনার উসকানিদাতা তিনি নন বলে দাবি করেছেন। তবে এ গণতন্ত্রবিরোধী বিক্ষোভে উসকানি দেওয়ার অভিযোগে সাবেক এ ডানপন্থি প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে আদেশ দিয়েছেন ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্ট।
এক বিবৃতিতে ব্রাজিলের শীর্ষ সরকারি কৌঁসুলির দপ্তর জানিয়েছে, ব্রাসিলিয়ায় হওয়া অরাজকতা ও সহিংসতা যে গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের ফলে হয়েছে, তাতে প্ররোচনা ও এর বুদ্ধিবৃত্তিক কর্তৃত্ব বলসোনারোর ছিল কিনা সুপ্রিম কোর্টের তদন্তে কৌঁসুলিরা তা খতিয়ে দেখবেন। দাঙ্গাবাজরা সহিংসতা উসকে দিয়ে প্রেসিডেন্ট লুলাকে উৎখাত করে সদ্যবিদায়ী ডানপন্থি প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতায় ফেরাতে সামরিক বাহিনীকে অভ্যুত্থান করার আহ্বান জানায়।
অক্টোবরের নির্বাচনে লুলার কাছে হারার পর মেয়াদ শেষের আগেই বামপন্থি প্রতিদ্বন্দ্বীর অভিষেকে যোগ দেওয়া এড়াতে বলসোনারো ব্রাজিল ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় চলে যান। তার মিত্র সাবেক বিচারমন্ত্রী তোহিসও এখন ফ্লোরিডায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলসোনারো বলেছেন, তিনি দ্রুতই ব্রাজিলে ফিরবেন। ফ্লোরিডায় ট্রাম্প ও তার সহযোগীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পরই হামলার পরিকল্পনা হয় বলে ধারণা করা হয়।
এদিকে দেশের ক্ষমতার কেন্দ্রগুলোতে সরকারবিরোধী উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে তাÐব চালাতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা সহযোগিতা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সামরিক পুলিশের মধ্যে অনেকেই এতে সহযোগিতা করেছে। সশস্ত্র বাহিনীরও অনেকে সহযোগিতা করেছে বলে দাবি করেছেন লুলা। লুলা বলেন, ‘এই ফ্যাসিস্ট উগ্রবাদীরা যা ঘটিয়েছে, দেশের ইতিহাসে কখনো তা দেখা যায়নি।’
বিক্ষোভকারীদের ঠেকাতে প্রথমে ব্রাসিলিয়ার থ্রি পাওয়ার স্কয়ারে ব্যারিকেড তৈরি করে পুলিশ। কিন্তু সেই ব্যারিকেড ভেঙেই পার্লামেন্ট ভবন, সুপ্রিম কোর্টে ঢুকে পড়েন বলসোনারোর সমর্থকরা। পরে অবশ্য ঘোড়সওয়ার পুলিশ ও টিয়ার গ্যাস বোমা ব্যবহার করে পুলিশ। হেলিকপ্টারও ব্যবহার করা হয়।
সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরের সামনে বলসোনারোর সমর্থকরা শিবির স্থাপন করে দুই মাস ধরে অবস্থান করার পরও তাদের নিরস্ত করতে বাহিনীটির কিছু না করারও সমালোচনা করেছেন লুলা। এই শিবিরে অবস্থানকারীরা লুলাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে সামরিক বাহিনীকে অভ্যুত্থান করার আহ্বান জানিয়ে আসছিল।
তবে লুলার জ্যেষ্ঠ সহযোগীরা বলেছেন, নিরাপত্তা বাহিনীর যারা ওই ঘটনায় সহযোগিতা করেছেন তাদের শনাক্ত করে বাদ দেওয়ার কাজটি জটিল হবে। কিন্তু বলসোনারোর সমর্থকদের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে তাÐব চালাতে দেওয়ার জন্য কারা দায়ী তদন্তকারীরা তা খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, এ হামলায় যে ব্রাজিলে ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটানোটা মূল বিষয় ছিল না। এর মূলে ছিল জনগণকে সদ্য ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়া ডানপন্থিদের শক্তিপ্রদর্শন। যেহেতু খুব শিগগিরই অর্থনৈতিক সংকটের সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তাই সামনের দিনে এ ঘটনা উগ্রপন্থিদের কাছে জ্বালানির কাজ করবে। আর ব্রাজিলে ডানপন্থার উত্থানের ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের ডানপন্থিদের মতাদর্শিক সংযোগ থাকাটা খুব স্বাভাবিক। ব্রাজিলের দাঙ্গা বলসোনারো অস্বীকার করলেও বাস্তবতা ভিন্ন। মতাদর্শিক জোরেই দুই সাবেক প্রেসিডেন্ট এক সূত্রে গাঁথা।