Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

মার্কিন প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে ফিলিপাইন

Icon

আহমেদ শরীফ

প্রকাশ: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৩:৩৪

মার্কিন প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে ফিলিপাইন

গত ১১ ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইন ঘোষণা দেয়, দুই দশক আগে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ফিলিপাইনের স্বাক্ষরিত একটা নিরাপত্তা চুক্তি তারা বাতিল করতে যাচ্ছে।

ভিজিটিং ফোর্সেস এগ্রিমেন্ট (ভিএফএ) নামের ওই চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইনে তাদের সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখতে পারত।

ফিলিপাইন যে এই চুক্তি বাতিল করবে, তার আভাস আগেই পাওয়া যাচ্ছিল, যখন ২৩ জানুয়ারি ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতের্তে হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, যদি যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইনের সিনেটর রোনাল্ড ডেলা রসার ভিসা বাতিলের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না করে, তবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভিএফএ চুক্তি বাতিল করবেন। 

ফিলিপাইনের অনলাইন মিডিয়া র‌্যাপলার জানায়, সাংবাদিকদের সাথে এক টেলি-কনফারেন্সে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্র সচিব ক্লার্ক কুপার বলেছেন, এই চুক্তি বাতিল করা হলে দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মাঝে প্রতি বছর যে ৩০০ যৌথ কর্মকাণ্ড চালিত হয়, তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তবে তিনি আশা করেন, ফিলিপাইনের নীতিনির্ধারকদের মাঝে অনেকেই এসব যৌথ কর্মকাণ্ড বন্ধ করার বিপক্ষে থাকবেন। 

এই চুক্তি বাতিল করা হলে ২০১৪ সালে স্বাক্ষরিত এনহান্সড ডিফেন্স কোঅপারেশন এগ্রিমেন্ট (ইডিসিএ) চুক্তিও হুমকির মুখে পড়বে। ইডিসিএর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইনে সৈন্য রাখা ছাড়াও কিছু সামরিক ঘাঁটিতে আগে থেকেই স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদ মজুদ করে রাখতে পারে। 

তবে কুপার ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, ভিএফএ চুক্তি বাতিল করা মানেই ইডিসিএ বাতিল করা নয়। কারণ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিলিপাইন এখনো যথেষ্ট পরিমাণ অস্ত্র ক্রয় করছে। তবে ১৯৫১ সালে দুই দেশের মাঝে স্বাক্ষরিত মিউচুয়াল ডিফেন্স ট্রিটি হুমকির মাঝে পড়বে কিনা, এই প্রশ্নের জবাব কুপার এড়িয়ে যান। 

দুতের্তে সিনেটর ডেলা রসার ভিসা নিয়ে যে হুমকি দিয়েছিলেন, তা ছিল ফিলিপাইনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের টানাপড়েনের একটি অংশ। মার্কিন সিনেটে অনুমোদিত গ্লোবাল ম্যাগনিটস্কি অ্যাক্টের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র দুতের্তের মাদকবিরোধী ‘যুদ্ধের’ ওপর লাগাম টানতে চাইছিল। তবে মার্কিনিরা একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ রক্ষার্থে সামরিক চুক্তিগুলোকে সমস্যায় ফেলতে চাইছিল না। 

মার্কিন দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, দুতের্তের সরকার চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন করে তাদের সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দূরত্ব তৈরি করছিল। ভিএফএ চুক্তি বাতিল করে এই পথে আরো দৃঢ়ভাবে অগ্রসর হচ্ছে ফিলিপাইন। এই ঘোষণা এমন সময়ে এলো, যখন দক্ষিণ চীন সাগরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিযোগিতা আরো গভীর হচ্ছে। ফিলিপাইন এ ক্ষেত্রে চীনের সাথে সরাসরি সংঘাত এড়িয়ে চলতে চাইছে।

সাম্প্রতিক সময়ে চীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন ছাড়াও ফিলিপাইন তার পররাষ্ট্রনীতিতে বেশ কিছু পরিবর্তন এনেছে। এর অংশ হিসেবে গত এক দশকে ফিলিপাইন তার নৌশক্তিকে বহুগুণে বৃদ্ধি করেছে। ২০১১ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের কোস্টগার্ড থেকে হ্যামিল্টন-ক্লাসের একটি পুরনো জাহাজ পায় ফিলিপাইনের নৌবাহিনী। তিন হাজার ২০০ টনের এই জাহাজটি চার দশকের বেশি পুরনো হলেও এটা ছিল ফিলিপাইনের প্রথম বড় আকারের যুদ্ধজাহাজ, যা ফিলিপাইনের নিজস্ব সমুদ্রসীমা পার হয়ে দূরের সমুদ্রে যেতে সক্ষম। এ রকম মোট তিনটি জাহাজ তারা পায় যুক্তরাষ্ট্রের কোস্ট গার্ডের কাছ থেকে। 

২০১৪ সালে এমন একটি জাহাজ অস্ট্রেলিয়া যায় নৌমহড়ায় অংশ নিতে। ২০১৩ সালে ইন্দোনেশিয়া থেকে ম্যাকাসার-ক্লাসের দুটি বড় আকারের উভচর যুদ্ধজাহাজের ক্রয়াদেশ দেয় ফিলিপাইন। ২০১৭ সালের মাঝে ডেলিভারি পাওয়া সাড়ে ১১ হাজার টনের এই জাহাজগুলোর একেকটা ৫০০ সৈন্য, তাদের যানবাহন ও দুটি হেলিকপ্টার ১৩ হাজার কিলোমিটার দূরের সমুদ্র উপকূলে নিয়ে যেতে সক্ষম। 

২০১৮ সালের অক্টোবরে এমন একটি জাহাজ ‘টারল্যাক’ রাশিয়ার ভ্লাদিভস্টক বন্দর ও দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু আইল্যান্ড সফর করে; যা ছিল ফিলিপাইনের নৌবাহিনীর জন্যে দূরের সাগরে পাড়ি জমানোর নতুন এক অধ্যায়। 

২০১৯ সালের জুলাইয়ে আরেকটি জাহাজ ‘দাভাও দেল সুর’ ৩০০ সেনা ও ক্রু ও একটি হেলিকপ্টার নিয়ে রাশিয়ার ভ্লাদিভস্টক বন্দরে যায়। ২০১৮ সালের আগস্টে ফিলিপাইন দুটি জাহাজ হাওয়াই দ্বীপে পাঠায় একটা মহড়ায় অংশ নিতে। ২০১৩ সালে ডাকা টেন্ডার জেতার পর দক্ষিণ কোরিয়া দুই হাজার ৬০০ টনের হোজে রিজাল-ক্লাসের দুটি অত্যাধুনিক ফ্রিগেট বানিয়ে দিচ্ছে; যার প্রথমটি চলতি বছরের মার্চে ফিলিপাইনে পৌঁছানোর কথা রয়েছে। 

দক্ষিণ কোরিয়ার নৌবাহিনীর পোহাং-ক্লাসের একটা এন্টিসাবমেরিন কর্ভেটও ফিলিপাইনের কাছে হস্তান্তর করেছে কোরীয় সরকার। ফিলিপাইনের কোস্ট গার্ডও চারটি বড় অফশোর প্যাট্রোল জাহাজ কিনছে ফ্রান্স ও জাপান থেকে। আরো ছয়টি জাহাজ কেনার জন্যে অস্ট্রেলিয়া ও থাইল্যান্ডের সাথে কথা চলছে।

এই জাহাজগুলোর দূরের সাগরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নতুন মোড় নেয় যখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মাঝে উত্তেজনার ফলশ্রুতিতে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত ফিলিপিনোদের সরিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে উভচর যুদ্ধ জাহাজ ‘দাভাও দেল সুর’ ও হ্যামিল্টন-ক্লাসের জাহাজ ‘রেমন এলকারাজ’ জানুয়ারির ১৪ তারিখে ফিলিপাইন থেকে মধ্যপ্রাচ্যের উদ্দেশে রওনা হয়ে ১৫ দিন পর শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরে পৌঁছায়। এটি ছিল ফিলিপাইনের নৌবাহিনীর ইতিহাসে কোনো জাহাজের প্রথমবারের মতো শ্রীলঙ্কা ভ্রমণ। ৬ ফেব্রুয়ারি জাহাজগুলো ওমান পৌঁছায়। 

তবে ফিলিপাইন এখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয় থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে যাচ্ছে না, যা ক্লার্ক কুপারের কথায় বোঝা যায়। যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমলেও দেশটির কয়েকটি বন্ধু রাষ্ট্রের ওপর ফিলিপাইনের যথেষ্ট নির্ভরশীলতা রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ফিলিপাইনের চুক্তি বাতিল হোক আর না হোক, ফিলিপাইন যে আগের মতো যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া নিরাপত্তার চাদরে নিশ্চিন্ত থাকতে পারছে না, তা নিশ্চিত। 

চীনের সাথে সম্পর্কোন্নয়নও সে কারণেই। ফিলিপাইনের নৌবাহিনীর দূরের সাগরে পাড়ি জমানোর আকাক্ষা দেখিয়ে দেয় যে, দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের সাথে সংঘাত তাদের উদ্দেশ্য নয়। বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমার সাথে সাথে ফিলিপাইন তার নিজস্ব নিরাপত্তার জন্যে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিকভাবে বন্ধু খুঁজছে; যে কারণে অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত যুদ্ধজাহাজ পাঠাতে তারা সাহস করছে। 

আর চীনকে নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ফিলিপাইনকে নিজের প্রভাব বলয়ে রাখতে ফিলিপিনোদের আরো সুযোগ-সুবিধা ও ছাড় দিতে চাপের মাঝে থাকবে যুক্তরাষ্ট্র।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫