Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর

সরাসরি যুদ্ধে জড়াচ্ছে পশ্চিমারা

Icon

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১১:০৮

সরাসরি যুদ্ধে জড়াচ্ছে পশ্চিমারা

শিগগিরই শেষ হচ্ছে না যুদ্ধ, বাড়ছে সমরাস্ত্রের ব্যবহার। ছবি: এএফপি

গত বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া যখন ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ শুরু করে, তখন ধারণা করা হয়েছিল এ যুদ্ধ স্বল্পস্থায়ী হবে। তবে তেমনটি হয়নি। বরং বিভিন্ন পদক্ষেপ ও যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে ইউরোপের পরাশক্তিগুলোও এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। লেপার্ড আর আব্রামস ট্যাংক পেয়েছে কিয়েভ। দেওয়া হচ্ছে প্রশিক্ষণও।

ইউক্রেন ক্ষেপণাস্ত্র ও অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান দাবি করেছে পশ্চিমাদের কাছে। যুদ্ধ এভাবে চলতে থাকলে তা ইউরোপসহ বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা বিপন্ন করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এসব সতর্ক বার্তা-আশঙ্কা সত্ত্বেও পশ্চিমারা এ যুদ্ধে জড়িয়ে গেছে এবং ক্রমাগত তাদের প্রত্যক্ষ তৎপরতা বাড়ছে।

যুদ্ধের শুরু থেকেই পশ্চিমাদের কাছে এসব অস্ত্র চেয়ে আসছিল কিয়েভ। ১১তম মাসে এসে তাদের এই চাওয়া মিটেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ৩১টি আব্রামস ট্যাংক পাঠানোর ঘোষণা দেওয়ার পর জার্মানির পক্ষ থেকে ১৪টি লেপার্ড ট্যাংক পাঠানোর ঘোষণা আসে। এর আগে ট্যাংক পাঠাতে অসম্মতি জানিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি। ইউক্রেনে আব্রামস ট্যাংক সরবরাহ করার আগে যুক্তরাষ্ট্র দাবি করে, টারবাইনচালিত মার্কিন যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ অত্যন্ত জটিল এবং ব্যবহার করতে খুব বেশি জ্বালানির প্রয়োজন। প্রশিক্ষিত সৈন্য ছাড়া এই ট্যাংক পরিচালনা করা অসম্ভব।

এর আগে প্রতিরক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা কলিন কাহল ঠিক এই কারণগুলো উল্লেখ করে ইউক্রেনে ট্যাংক সরবরাহ করার কথা অস্বীকার করেছিলেন। এর আগে ইউক্রেনকে পদাতিক ফাইটিং যানের পাশাপাশি প্যাট্রিয়ট আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরবরাহ করতে সম্মত হয় বার্লিন। মূলত জার্মানিকে রাজি করানোর জন্যই যুক্তরাষ্ট্র এই আপত্তি তুলেছিল বলে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণে বলা হয়।

তবে রাশিয়ার বার্তা সংস্থা আরটির বিশ্লেষণে বলা হয়, অদক্ষ ক্রু দিয়ে এসব ট্যাংক পরিচালনা করার কারণে ফল নেতিবাচক হতে পারে। কৌশলগত সাফল্য পেতে হলে ইউক্রেনের অন্তত ২০০ থেকে ৩০০ মার্কিন ট্যাংক থাকা প্রয়োজন। এবার ইউক্রেনের চাওয়া আরও বেড়েছে। এ বিষয়ে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেস্কি রেজনিকভের উপদেষ্টা ইউরি সাক বলেন, পরবর্তী বড় চাওয়া হবে অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান।

জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ অবশ্য স্পষ্ট করে বলেছেন, ইউক্রেনে যুদ্ধবিমান পাঠানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। আমরা ফাইটার জেট নিয়ে কথা বলতে মোটেও আগ্রহী নই। এমনকি আমরা কোনোভাবেই ইউক্রেনে আমাদের সেনা পাঠাব না, কারণ এই যুদ্ধে ন্যাটো সেনাদের অংশগ্রহণের কোনো নির্দেশনা নেই।

এখন পর্যন্ত ইউক্রেনকে দুই দশমিক তিন বিলিয়ন ইউরো মূল্যের যুদ্ধাস্ত্র দিয়েছে জার্মানি। তবে তাদের ভারী অস্ত্র পাঠানোর ক্ষেত্রে বরাবরই সময় নিয়েছে জার্মানি। বার্লিন ও ইউরোপ ইউক্রেনকে নানা পদ্ধতিতে সাহায্য করে। নিজেদের দেশে যে অস্ত্র সম্ভার আছে, সেখান থেকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করা সবচেয়ে সহজ কাজ। যুদ্ধের শুরু থেকেই মজুদ অস্ত্র ইউক্রেনকে দিয়েছে ইউরোপীয় দেশগুলো। 

ইউক্রেনের যুদ্ধ বছরের পর বছর চলতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর মহাসচিব ইয়েন্স স্টলটেনবার্গ। এজন্য তিনি কিয়েভকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত থাকার জন্য পশ্চিমা দেশগুলোকে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই প্রস্তুত থাকতে হবে যে, এই যুদ্ধ কয়েক বছর ধরে চলতে পারে। ইউক্রেনকে সাহায্য করা থেকে আমাদের দমে গেলে চলবে না। যদিও যুদ্ধের জন্য চড়া মূল্য দিতে হচ্ছে, শুধু সামরিক সাহায্য দিতে গিয়ে নয়, জ্বালানি ও খাদ্যের মূল্যও বেড়ে যাচ্ছে।’

এদিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে সামরিক সহায়তার অংশ হিসেবে ইউক্রেনকে অত্যাধুনিক চ্যালেঞ্জার-২ ট্যাংকসহ আরও কিছু গোলাবারুদ পাঠাচ্ছে ব্রিটেন। এই ট্যাংক দিয়ে রুশ বাহিনীকে পিছু হটাতে সক্ষম হবে জেলেনস্কি বাহিনী, এমনটাই আশা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের। তবে কিয়েভকে চ্যালেঞ্জার-২ নামের এই ট্যাংক সরবরাহ করা হলে তা পুড়িয়ে ফেলার হুঁশিয়ারি দিয়েছে ক্রেমলিন। 

যুদ্ধের কারণে চরম সংকটের মধ্যে রয়েছে ইউক্রেনের বাসিন্দারা। যুদ্ধের ভয়াবহতা এড়াতে অনেকে পালাচ্ছেন দেশ ছেড়ে। অনেকেই আবার ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিচ্ছেন দেশের অন্যত্র। জাতিসংঘ বলছে, যুদ্ধের ভয়ে বাস্তুচ্যুত হওয়া এই ইউক্রেনীয়দের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ, যা দেশটির মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের বেশি।

ইউক্রেনের জনসংখ্যা প্রায় ৪ কোটি ১০ লাখ। জার্মানিতে নিযুক্ত জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের প্রতিনিধি ক্যাথারিনা লাম্প বলেন, এর মধ্যে ৭৯ লাখের বেশি মানুষ দেশটি ছেড়ে পালিয়েছেন। আর দেশের ভেতরেই অন্যত্র চলে গেছেন ৫৯ লাখ মানুষ। 

এদিকে ইউক্রেনে কয়েক মাস ধরে ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া। হামলার মূল লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে দেশটির বিদ্যুৎ অবকাঠামোগুলো। ফলে ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা প্রায় ধসে পড়েছে। অনেক এলাকা দিনের বড় একটা সময় থাকছে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন। এমন পরিস্থিতিতে চরম শীতের মধ্যে মহাসংকটে পড়েছেন রাজধানী কিয়েভসহ ইউক্রেনের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ।

মার্কিন বুদ্ধিজীবী নোম চমস্কি বলেন, যুদ্ধ চলতে থাকলে প্রাথমিক শিকার হবে ইউক্রেন। সংঘাতের অনেক মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর রাশিয়া এখন ইঙ্গো-মার্কিন স্টাইলে সরাসরি অবকাঠামো, জ্বালানি, যোগাযোগসহ একটি সমাজকে সচল রাখতে যা যা দরকার, তার সবকিছুতে হামলা করছে।

ইউক্রেনের সমাজ ঠিক কত দিন এসব হামলার বিপরীতে টিকে থাকতে পারবে, তা নিশ্চিত নয়। ইউক্রেন ইতিমধ্যেই একটি বড় অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকটের সম্মুখীন। যুদ্ধ অব্যাহত থাকায় ইউক্রেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন যে মানুষ ইউক্রেন থেকে পালিয়ে যেতে পারে, তাদের অর্থ নিজেদের সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে।

জাতীয় মুদ্রাব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়তে পারে। জলবায়ু বিপর্যয় এড়াতে যে মূল্যবান সম্পদের প্রয়োজন, ধ্বংসযজ্ঞে তা নষ্ট হচ্ছে; রাশিয়া-ইউরোপ স্বাভাবিক সম্পর্ক পুরোপুরি ভেঙে পড়ছে এবং একই সঙ্গে রুশ সহযোগী হিসেবে চীনের সঙ্গেও ইউরোপের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। 

চীনের বিরুদ্ধেও ভার্চুয়াল যুদ্ধ ঘোষণা করেছে বাইডেন প্রশাসন। ওয়াশিংটন বেইজিংয়ে প্রযুক্তি রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় ইউরোপীয় শিল্প, বিশেষ করে নেদারল্যান্ডসের উন্নত চিপ-উৎপাদন শিল্প ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়েছে। আর লাভবান হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। পুতিনের আত্মঘাতী যুদ্ধবাজির সিদ্ধান্তে ইউরোপ পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্রের পকেটস্থ হয়েছে। সঙ্গে মার্কিন অর্থনীতিতেও হাওয়া লেগেছে। সে দেশের সামরিক উৎপাদন, জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান, কৃষিশিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর মুনাফা বাড়ছে। 

ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, ‘মার্কিন এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) ক্রয় করে ইউরোপ এবার যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা বাড়িয়েছে। কিন্তু এ সম্পর্কে তেমন পারস্পরিক আদান-প্রদান নেই। মূলত এতে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেরই লাভ হচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ইউরোপীয়দের রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত করার আকাঙ্ক্ষা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক ও হাস্যকর। এটা একধরনের পাগলামি। কারণ ইউরোপের ওই সিদ্ধান্তের কারণে তারা প্রতিদিন বিলিয়ন বিলিয়ন ইউরো হারাচ্ছে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার উপার্জন করছে।

এই যুদ্ধে রাশিয়া যদি জিতে যায় সেটি শুধু রাশিয়া নয়; চীন, উত্তর কোরিয়া ও ইরানের মতো দেশগুলোর মনোবলকেও চাঙ্গা করবে। যুদ্ধে এখন ইরানের ড্রোন দিয়ে রুশ বাহিনী কিয়েভে আক্রমণ করছে। ইউক্রেন যুদ্ধ ইরানের প্রতিরক্ষা শিল্পে যেন নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করেছে। পশ্চিমা দেশগুলোকে নতুন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। সব মিলিয়ে বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি। 

আর রাশিয়ার হেরে যাওয়াটা মানব সভ্যতার বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্য আর নিজেদের শক্তিক্ষয় রাশিয়া মেনে নেবে না। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বিশ্বকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, রুশ ডকট্রিন অনুযায়ী ‘যখন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে’ তখন তারা পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করতে প্রস্তুত। বাইডেনও স্বীকার করেছেন, পুতিনের বক্তব্যকে তিনি তামাশা হিসেবে দেখছেন না। পুতিন হুমকি দিয়েছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বের জন্য আসছে দশক হতে চলেছে ‘সবচেয়ে বিপজ্জনক’। 

রাজনীতি বিশ্লেষক মেডেয়া বেঞ্জামিন ও নিকোলাস জে এস ডেভিস মার্কিন সংবাদমাধ্যম জিনেটে এক বিশ্লেষণে বলেন, রাশিয়া যদি নিজেদের সীমানায় ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে যায় তবে তারা তাদের ঘোষিত ডকট্রিন অনুযায়ী একে পরমাণু হামলার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। তা সত্ত্বেও বাইডেন যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বের জনসাধারণের জন্য কোনো সতর্কতা জারি করেননি বা মার্কিন নীতিতে কোনো পরিবর্তন ঘোষণা করেননি।

নোম চমস্কি আরও বলেন, ঐতিহ্যবাহী দুই যুদ্ধবাজ রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য রাশিয়াকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করার জন্য যুদ্ধ অব্যাহত রাখার ওপর জোর দিচ্ছে; যদিও তাদের অভ্যন্তরীণ বৃত্তেও এ নিয়ে বিরোধিতা রয়েছে। সব মিলিয়ে মানব প্রজাতির ভাগ্য হুমকির মুখে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫