তুরস্ক ও সিরিয়ার ভূমিকম্পে ত্রাণ সহায়তার কূটনীতি

আহমেদ শরীফ
প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:৪৩

ভূমিকম্পে বেঁচে যাওয়া মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণও হয়েছে চ্যালেঞ্জিং। ছবি: সংগৃহীত
তুরস্ক ও সিরিয়ার ভয়াবহ ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ইতিমধ্যেই ৪২ হাজার ছাড়িয়েছে। তুরস্ক সরকারের হিসেবে ৮০ হাজার মানুষ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে, আর ১০ লাখের বেশি মানুষ অস্থায়ী তাঁবুতে বাস করছে। প্রচণ্ড শীত ও বৃষ্টির মাঝে উদ্ধারকাজ যেমন কঠিন হয়েছে, তেমনি বেঁচে যাওয়া মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণও হয়েছে চ্যালেঞ্জিং। বিশ্বের বহু দেশ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে দেশটির সরকারি সংবাদমাধ্যম টিআরটি জানিয়েছে, ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশ্বের ১০০ দেশ আঙ্কারাকে সহায়তা দিতে চেয়েছে। এই মুহূর্তে তুরস্কে ৮১টি দেশের ৯ হাজার ৪৫৬ জন উদ্ধার ও ত্রাণকর্মী কাজ করছে।
এছাড়াও আরও ৭৪৭ জন ত্রাণকর্মী আসার পথে রয়েছে। এই সহায়তা কতটা মানবতার জন্য, আর কতটা জাতীয় স্বার্থ বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে, সেটা নিরূপণ করা না গেলেও এই সহায়তার সঙ্গে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের কথা আলোচনায় আসা শুরু হয়েছে। একইসঙ্গে রাজনৈতিক কারণেই আবার সিরিয়ার অভ্যন্তরে ক্ষয়ক্ষতি ও উদ্ধারকাজ নিয়ে আলোচনা প্রায় নেই বললেই চলে।
তুরস্কের ভূমিকম্পে জরুরি সহায়তা দিয়েছে সুইডেন ও ফিনল্যান্ড। উভয় দেশই ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ন্যাটোর সদস্যপদ পাওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু এই পথে বাধা হয়েছে তুরস্ক। তুরস্ক বলছে, এই দুই দেশ তাদের দেশের অভ্যন্তরে বিচ্ছিন্নতাবাদী বামপন্থি সংগঠন কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি বা পিকেকে’কে বিভিন্নভাবে সমর্থন করে যাচ্ছে।
যদিও পিকেকে’কে শুধু তুরস্ক নয়, পশ্চিমা দেশগুলোও সন্ত্রাসী সংগঠন বলে আখ্যা দিয়েছে। কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থক অনেককেই নরডিক এই দেশগুলো আশ্রয় দিয়েছে এবং সেখান থেকে তারা রাজনৈতিক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এদের মাঝে কেউ কেউ আবার সুইডেনের পার্লামেন্ট সদস্যও হয়েছে। তুরস্ক চাইছে, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থক ১৩০ জনকে এই দেশগুলো তুরস্কের কাছে হস্তান্তর করুক। এখন পর্যন্ত তুরস্কের দাবি, ফিনল্যান্ড তাদের শর্ত মানার ক্ষেত্রে অগ্রগামী হয়েছে; তবে সুইডেন পিছিয়ে রয়েছে।
ইউরোনিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তুরস্কের দুর্যোগে সহায়তাদানের পর আঙ্কারার পররাষ্ট্রনীতিতে এর প্রভাব কতটুকু পড়বে, তা নিয়ে সুইডেন ও ফিনল্যান্ডে মতবিরোধ রয়েছে। ফিনল্যান্ডের তুর্কি বংশোদ্ভূত রাজনীতিবিদ ওজান ইয়ানার বলেন, ভূমিকম্পে তুরস্কের যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তাতে সামনের বেশ অনেক দিন তুরস্কে অন্য কোনো ইস্যু নিয়ে কথা বলা যাবে না। অর্থাৎ এক্ষেত্রে ন্যাটোর সদস্যপদ পাওয়া থেকে সুইডেনকে বঞ্চিত করার তুর্কি যে কোনো পরিকল্পনাকে ভূমিকম্প থেকে দেশটির জনগণের দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়ার প্রয়াস হিসেবেই দেখবে।
অপরদিকে সুইডেনের স্টকহোম ইউনিভার্সিটির প্রফেসর পল লেভিন মনে করছেন, ভূমিকম্প তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ানের চিন্তাকে পরিবর্তন করাতে পারবে না। কারণ ভূমিকম্প পরবর্তী উদ্ধারকাজে ধীরগতি নিয়ে তুরস্কে যথেষ্ট পরিমাণে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। এমতাবস্থায় জনগণের ক্রোধকে ক্ষমতাসীন দলের উপর থেকে সরাতে এরদোয়ান হয়তো আবারও সুইডেনের বিরুদ্ধাচরণে সোচ্চার হবেন। এমনকি খুব কঠিন পরিস্থিতিতে পতিত হলে তিনি নির্বাচনের দিনও পরিবর্তন করতে পারেন।
মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্সের (সিএফআর) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিরিয়ার অভ্যন্তরের রাজনীতিকে এই ভূমিকম্প যথেষ্ট প্রভাবিত করতে পারে। সিরিয়ায় ভূমিকম্পের সবচেয়ে বড় আঘাতটা এসেছে ইদলিব অঞ্চলে; যার অনেকটাই যুদ্ধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এবং এখন তা বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর হাতে রয়েছে।
এখানে আবার তুর্কি সেনারা সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের সরকারি বাহিনী আর বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর মাঝে বাফার জোন তৈরি করেছে। সিরিয়ার বাশার সরকারের প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্ক দেশটির সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা করছে। ত্রাণকর্মীদের হিসেবে সিরিয়ায় নিহত সাড়ে ৩ হাজার মানুষের মাঝে শুধু ইদলিবেই ১৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দুই হাজার ২৫০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া গিয়েছে। জাতিসংঘের হিসেবে সিরিয়াতে ৫৩ লাখ মানুষ বর্তমানে গৃহহারা।
এদিকে কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে ‘রয়টার্স’ বলছে, ১৩ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে সংস্থার ত্রাণ কর্মকাণ্ডের প্রধান মার্টিন গ্রিফিথস জানিয়েছেন, সিরিয়ার বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চলে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার সুবিধার্থে সিরীয় সরকার তিন মাসের জন্য তুরস্কের সঙ্গে আরও দুটি সীমান্ত সংযোগ চালু করার অনুমতি দিয়েছে।
জেরুজালেমের হিব্রু ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ইয়োনাটান ফ্রিম্যান বলছেন, জরুরি সহায়তা দেওয়ার ব্যাপারগুলো একটা রাষ্ট্রের সক্ষমতাকে যেমন তুলে ধরে, তেমনি আন্তর্জাতিকভাবে তার প্রভাবও বৃদ্ধি করে। এই সহায়তাগুলো নিঃশর্ত হলেও এর মাধ্যমে দুটি রাষ্ট্রের জনগণের মাঝে সুসম্পর্ক গড়ার একটা সুযোগ তৈরি হয়।
তবে বিশ্লেষকেরা সবাই একমত যে, সহযোগিতার এই উদাহরণগুলো কত দিন এই দেশগুলোর মাঝে সম্পর্ককে উষ্ণ রাখবে, তা বলা মুশকিল। পশ্চিমা চিন্তার উপরে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সেক্যুলার বিশ্বব্যবস্থায় সব রাষ্ট্রই জাতীয় স্বার্থকে সবকিছুর উপরে স্থান দেয়; যেখানে মানবতার দিকগুলো সর্বদাই থাকে পিছনের সারিতে।