
বাঁ থেকে- রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেন যুদ্ধের এক বছর পূর্তিতে চীন ঘোষণা দিয়েছে, তারা ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে কাজ করতে ইচ্ছুক। ২৪ ফেব্রুয়ারি চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক নীতিপত্রে যুদ্ধের ব্যাপারে তাদের অবস্থান তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়, এই যুদ্ধ কারোর জন্যই সুবিধা বয়ে আনছে না। কাজেই সবারই উচিত স্বাভাবিক চিন্তা প্রয়োগ করা, যাতে করে এই যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে না ফেলে।
আল জাজিরার এই বিশ্লেষণে চীনা প্রস্তাবের বিশেষ দিকগুলো তুলে ধরা হয়; যার মাঝে ছিল মানবিক করিডোরের মাধ্যমে বেসামরিক নাগরিকদের সরানোর ব্যবস্থা করা, খাদ্যশস্যের মূল্য স্থিতিশীল করতে শস্য রপ্তানি পুনরায় চালু করা। তবে এর মাঝে চীন বহুদিন ধরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের যে অবস্থান তুলে ধরেছে, সেগুলোই আবার সামনে নিয়ে আসা হয়; যেমন- যে কোনো দেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও ভৌগোলিক সীমানার নিশ্চয়তা দেওয়া।
একই সঙ্গে প্রস্তাবে পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়। প্রস্তাবে ‘ঠান্ডা যুদ্ধের মানসিকতা’ পরিহার করতে বলা হয়; যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা এবং অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপকেই বোঝায় চীন।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি চীনের এই প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন। তবে তিনি মনে করিয়ে দেন, এখানে শুধু ইউক্রেনের সীমারেখাই লঙ্ঘন করা হয়েছে। ইউক্রেনের ভূমি ছেড়ে যেতে রাশিয়াকে রাজি করাতে চীনকে তিনি সচেষ্ট দেখতে চান। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সিনিয়র উপদেষ্টা মিখাইলো পদোলিয়াক এক টুইটার বার্তায় বলেন, ইউক্রেনের সীমানা থেকে রুশ সেনা প্রত্যাহার না করেই যদি যুদ্ধবিরতির কথা বলা হয়, তাহলে সেটা শান্তি হবে না; হবে যুদ্ধকে একটা অবস্থানে থামিয়ে রাখা।
সিএনএন বলেছে, চীনা নীতিপত্রের অধিকাংশ অংশেই পশ্চিমাদের টার্গেট করা হয়েছে এবং পশ্চিমাদের সামরিক জোটের পরিধি বৃদ্ধি করার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টার বিরুদ্ধে বলা হয়েছে। মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেছেন, চীনা প্রস্তাবে যখন বলা হয়েছে সব দেশের সার্বভৌমত্ব মেনে চলতে হবে, তখনই ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দেয়া উচিত ছিল।
কারণ ইউক্রেন, ন্যাটো বা যুক্তরাষ্ট্র- কেউই রাশিয়ার উপরে হামলা করেনি; হামলা করেছেন পুতিন। অপরদিকে বেইজিংয়ে ইইউএর প্রতিনিধি বলেছেন, চীনের এই প্রস্তাব কোনো শান্তি প্রস্তাব নয়। তবে ইইউ এই প্রস্তাবকে খুঁটিয়ে দেখছে।
সিএনএন বলছে, এর আগের সপ্তাহেই মিউনিখে নিরাপত্তা আলোচনাতে চীনা শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ইয়ি এই নীতিপত্র নিয়ে কথা বলেন। একই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ওয়াং মস্কো সফর করে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করেন। পুতিন তাকে উষ্ণ সংবর্ধনা দেন এবং দুই দেশের সম্পর্ক নতুন মাইলফলকে পৌঁছেছে বলে মন্তব্য করেন।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে দুই দেশের সহযোগিতার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেন। তবে ওয়াং তার বক্তব্যে বলেন, দুই দেশ বিভিন্ন সময়ে সমস্যার মধ্য দিয়ে গেলেও যেখানে সম্পর্কোন্নয়নে নতুন সুযোগের সৃষ্টি হয়। তিনি উভয় দেশের পরিবর্তনগুলো স্বেচ্ছায় তুলে ধরে সেখানে অগ্রগামী ভূমিকা নেওয়ার ব্যাপারে সচেষ্ট থাকার কথা বলেন।
অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস ইউনিভার্সিটির আলেক্সান্ডার করোলেভ বলেন, ওয়াং তার ইউরোপ সফরে ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি ও হাঙ্গেরি গিয়েছেন; যে দেশগুলো ইউক্রেনকে সহায়তা করার ব্যাপারে কিছুটা হলেও দোদুল্যমান ছিল। চীন হয়তো দেখতে চাইছে, ইউরোপের কিছু অংশকে তাদের পক্ষে আনতে পারে কিনা।
যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ল স্কুলের পল সাই চায়না সেন্টারের ফেলো নিকোলাস বেকেলিন বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে চীন বড় ধরনের সমস্যায় পড়েছে। তার অর্থনীতি বিপদে রয়েছে এবং ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক টানাপড়েনে পড়েছে। একই সঙ্গে সামনের দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে একটা দ্ব›দ্ব হতে চলেছে সে বিষয়ে চীন নিশ্চিত। এমতাবস্থায় রাশিয়ার মতো একটা বন্ধুকে পাশে চাইছে চীন। তাই নিরপেক্ষ থাকার কথা বলেও চীন কিছুটা রাশিয়ার দিকেই ঝুঁকে রয়েছে।
সাংহাইয়ের ইস্ট চায়না নরমাল ইউনিভার্সিটির ঝাং শিন বলেন, যদিও পশ্চিমারা বলছে, চীন রাশিয়াকে অস্ত্র দিতে চাইছে, তথাপি সেটা যে চীনের স্বার্থের বিরুদ্ধে এবং সে বিষয়ে চীন অবগত রয়েছে। কারণ তাদের বেশিরভাগ বাণিজ্যই পশ্চিমাদের সঙ্গে। যেটা বরং সম্ভাব্য তা হলো, চীন রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চালিয়ে যাবে; যা রাশিয়ার উপর পশ্চিমা অবরোধের বিরুদ্ধাচরণ।
জার্মান মার্শাল ফান্ডের সিনিয়র ফেলো এন্ড্রু স্মল বলেছেন, চীন হয়তো পরোক্ষভাবে রাশিয়াকে সহায়তা দিতে পারে, যাতে করে তারা বলতে পারে যে, তারা ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে না। যেমন উত্তর কোরিয়ার মাধ্যমে এমন সব প্রযুক্তি তারা রাশিয়াকে সরবরাহ করতে পারে, যেগুলো সামরিক ও বেসামরিক উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়। তবে যুদ্ধ যেভাবে চলছে, তাতে একটা সময় চীনকে ঠিক করতেই হবে যে, তারা রাশিয়াকে সহায়তা দিতে আরও কতদূর যাবে।
বিবিসির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এক বছর ধরেই পশ্চিমারা চাইছিল চীন যেন ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করতে সহায়তা দেয়। এখন চীনের প্রস্তাব আসার পর সেটা পশ্চিমাদের মনঃপূত হয়নি। পশ্চিমারা হয়তো চীনের প্রস্তাবে খুশি হয়নি; তবে পশ্চিমাদের রাজি করানোটা বেইজিংয়ের লক্ষ্য ছিল না।
বেইজিং এই নীতিপত্রে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার কথা উল্লেখ করে উন্নয়নশীল বিশ্বকেই বুঝিয়েছে; যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের একটা বিকল্প হিসেবে চীন নিজেদের উপস্থাপন করতে চাইছে।
উন্নয়নশীল বিশ্ব যখন ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছে, তখন চীন মার্কিন নিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যবস্থার একটা বিকল্প দেখার চেষ্টা করছে। করোলেভ বলছেন, চীন আরও বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, পশ্চিমাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে রাশিয়া একা নয়; একইভাবে চীনের সঙ্গে পশ্চিমাদের দ্বন্দ্বের সময়েও বেইজিং একা থাকবে না।