Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

বিশ্ব শ্রমবাজারে লিঙ্গভিত্তিক বেতনবৈষম্য

Icon

শাহেরীন আরাফাত

প্রকাশ: ১৩ মার্চ ২০২৩, ০৯:৫০

বিশ্ব শ্রমবাজারে লিঙ্গভিত্তিক বেতনবৈষম্য

নারীর কাজের সুযোগ বাড়ানো বা পূর্ণকালীন পদে নিয়োগ প্রদান প্রয়োজন। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার নারীদের কর্মক্ষেত্র ও জনজীবনে অংশগ্রহণ বাড়ছে। তবে সামগ্রিক অগ্রগতিতে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি একটি বড় বাধা। এখনো সমাজে এমনটা দেখা হয় যে, নারী কম কাজ করেন।

অপরদিকে পুরুষের কাজ বেশি। তাই তার বেতনও হতে হবে বেশি। লক্ষণীয় বিষয় হলো- এ দৃষ্টিভঙ্গি শুধু স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটও এ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতার বাইরে আসতে পারেনি।

এমনকি সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রও এর বাইরে নয়। সেখানেও লিঙ্গভিত্তিক বেতনবৈষম্য খুব স্পষ্ট। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, জাপানের মতো শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলোও এ বৈষম্যের বাইরে আসতে পারেনি।

মার্কিন গবেষণা সংস্থা পিউ রিসার্চ সেন্টারের পক্ষ থেকে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চশিক্ষা ও উচ্চবেতনের চাকরিতে যোগদান এবং শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা ১৯৮২ সাল থেকে নারীদের কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে রেখেছে। তবে নারীরা শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জনে পুরুষদের ছাড়িয়ে গেলেও ২০০২ সাল থেকে তাদের বেতন একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে আটকে আছে। ১৯৮২ সালে নারীদের প্রতি ঘণ্টায় আয়ের পরিমাণ ছিল ৬৫ সেন্ট। প্রায় ৪০ বছরের ব্যবধানে আয়ের পরিমাণ বাড়লেও প্রত্যাশা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত হয়নি লিঙ্গভিত্তিক বেতন সমতা। ২০০২ সালে নারীদের এ আয়ের পরিমাণ ছিল ৮০ সেন্ট।

২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পুরুষরা যখন ঘণ্টায় গড়ে ১ ডলার উপার্জন করে, বিপরীতে পূর্ণ ও খণ্ডকালীন চাকরিজীবী নারীরা উপার্জন করে গড়ে ৮২ সেন্ট। গবেষণায় আরও বলা হয়, ২৫ থেকে ৩৪ বছরের নারীদের পুরুষের কাছাকাছি বেতনপ্রাপ্তির সম্ভাবনা বেশি থাকে। নারীদের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এ সম্ভাবনা কমতে শুরু করে। পুরুষদের ১ ডলার আয়ের বিপরীতে কমবয়সী নারীরা ৯০ সেন্ট আয় করতে পারেন।

তবে কর্মজীবনের পরবর্তী ধাপে নারীদের বেতনবৈষম্য বাড়তে থাকে। মাতৃত্ব অনেক নারীকে তাদের ক্যারিয়ার থেকে বিরতি নেওয়া কিংবা খণ্ডকালীন কাজের দিকে ঠেলে দেয়। তাছাড়া সন্তান রয়েছে, এমন ৩৫-৪৪ বছর বয়স্ক পুরুষরা উচ্চবেতন পেলেও একই ধরনের নারীদের বেতন তুলনামূলক কম।

ওই গবেষণায় দেখা যায়, কৃষ্ণাঙ্গ নারীরা গত বছর শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের তুলনায় মাত্র ৭০ শতাংশ উপার্জন করেছেন। হিস্পানিক নারীরা করেছেন ৬৫ শতাংশ। তবে সাদা নারীদের ক্ষেত্রে ব্যবধান কম ছিল, যা ৮৩ শতাংশ।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা দ্য ইনস্টিটিউট ফর ফিসকেল স্টাডিজের (আইএফএস) ২০২১ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, এর আগের ২৫ বছরেও যুক্তরাজ্যে নারী ও পুরুষের বেতনের ব্যবধানে খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। যেটুকু কমেছে তা মূলত নারীদের শিক্ষাগত দক্ষতা বৃদ্ধির কারণে। খণ্ডকালীন কাজে নিযুক্ত নারীদের একটি বড় অংশ এই ব্যবধান কমাতে সাহায্য করেছে; কিন্তু উচ্চ বেতনে স্নাতক ডিগ্রিধারী নারীদের বেতনবৈষম্যে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।

চাকরি করতে সক্ষম নারীরা সমবয়সী পুরুষদের তুলনায় মাসে ৫০ ঘণ্টারও বেশি বিনা বেতনে কাজ করেন। পরিবারে সন্তান পালনের দায়িত্ব আসার পরে কাজের সময়ের এই ব্যবধান আরও বেড়ে যায়। পাশাপাশি বেতনের ক্ষেত্রে বৈষম্যের কারণে একক মায়েরা অধিক দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে রয়েছেন। গবেষণায় আরও উঠে এসেছে, যুক্তরাজ্যে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা পুরুষের তুলনায় বেশি। তবে ২০১৯ সালেও দেশটির কর্মজীবী নারীরা তাদের সমবয়সী পুরুষদের তুলনায় ৪০ শতাংশ কম আয় করতে পারতেন। অর্থাৎ শিক্ষিত হলেও বেতনের পরিমাণ খুব একটা বাড়েনি নারীদের।

জার্মানির কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান অফিসের হিসাব অনুযায়ী, কর্মজীবী নারী এবং পুরুষের মধ্যে বেতনের ব্যবধান আগের তুলনায় কিছুটা কমলেও গড়ে এখনো নারীর বেতন ১৮ শতাংশ কম। আগে এটি ছিল ১৯ শতাংশ। গড় আয়ের পার্থক্যের প্রায় ৭১ শতাংশ কাঠামোগত কারণ। নারীরা যেসব ক্ষেত্রে বেশি কাজ করেন সেসব কাজের বেতন যেমন কম তেমনি উচ্চ বা নেতৃস্থানীয় পদেও নারীর সংখ্যা কম।

নারীরা খণ্ডকালীন ও কম বেতনের চাকরি বেশি করায় তাদের গড় আয় তুলনামূলকভাবে কম হয়ে থাকে। তা ছাড়াও পুরুষের মতো একই যোগ্যতা থাকা সত্তে¡ও ২০১৮ সালে নারীকর্মীরা পুরুষের তুলনায় প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ছয় শতাংশ কম আয় করেন।

জার্মানির ট্রেড ইউনিয়নের এক জরিপ অনুযায়ী, ২০১৯ সালে জার্মানিতে ২০ থেকে ৬৪ বছর বয়সী নারীর মধ্যে শতকরা ৪৭ জনই খণ্ডকালীন কাজ করেছেন। সে ক্ষেত্রে পুরুষদের অনুপাত ছিল মাত্র ৯ শতাংশ। তবে নারীদের খণ্ডকালীন কাজ করার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে সন্তানের দেখাশোনা ছাড়াও রয়েছে পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক নানা বিষয়।

বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে জাপানে লিঙ্গভিত্তিক বেতনবৈষম্য পরিস্থিতি অন্যতম উদ্বেগজনক। ১৯৮৬ সালে নারী-পুরুষ সবার জন্য সমান কর্মসংস্থানের সুযোগ বিষয়ক আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকে নারীদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশকে উৎসাহিত করার জন্য নেওয়া হয় বিভিন্ন পদক্ষেপ। এর মধ্যে রয়েছে পেশাজীবন ও পারিবারিক জীবনে ভারসাম্য আনতে সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকটি আইন প্রণয়ন ও তার ব্যবহার।

এরপর জাপানে নারীদের কর্মপরিবেশে অনেক পরিবর্তন এসেছে। দেশটির স্কুল বেসিক সার্ভে অনুসারে, ১৯৮৬ সালে উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডী পেরিয়ে চার বছরের স্নাতকে নারী শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার ছিল ১৩ শতাংশ। ২০২০ সালে তা বেড়ে যায় ৫১ শতাংশে। একইভাবে ২০২০ সালে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী নারীর মধ্যে প্রায় ৭১ শতাংশ কোনো না কোনো পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮৬ সালে যা ছিল ৫৩ শতাংশ।

তবে জাপানের লেবার ফোর্স সমীক্ষা অনুসারে খণ্ডকালীন, নিবন্ধিত এবং স্থায়ী কর্মী নয়, এমন পেশাজীবী নারীর সংখ্যা গণনায় দেখা যায় ১৯৮৬ সালে তাদের হার ছিল ৩২ শতাংশ, যা ২০২০ সালে বেড়ে ৫৬ শতাংশে পৌঁছায়। জাপানের ন্যাশনাল ফার্টিলিটি সার্ভে অনুসারে, ২০১০-এর দশকের শেষের দিকে প্রথম সন্তানের জন্মের পর ৭০ শতাংশ নারী কর্মী পুনরায় চাকরিতে ফিরে আসেন। যদিও আগের কয়েকটি দশকে তা ছিল প্রায় ৪০ শতাংশ। ২০২২ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের লিঙ্গ বৈষম্য বিষয়ক প্রতিবেদনে জাপানের অবস্থান ১৪৬টি দেশের মধ্যে ছিল ১১৬তম।

বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে এ অবস্থান অনেক নিচের সারিতে। শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ, পূর্ণকালীন কর্মীদের বেতন ও কর্মস্থলে নারী ব্যবস্থাপকদের উপস্থিতির অনুপাতের ক্ষেত্রে জাপান ও কোরিয়ায় লিঙ্গবৈষম্য অনেক বেশি। এসব দেশে নারীদের জন্য সন্তান ধারণ করাটা চ্যালেঞ্জিং, যা নারীর কর্মসংস্থান বা পেশাজীবনের ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতাও। যে কারণে সেখানে জন্মহার কমে গেছে আশঙ্কাজনক মাত্রায়। 

তবে আশার কথা হলো- আইসল্যান্ড প্রথম দেশ, যেখানে নারীর চেয়ে পুরুষকে বেশি মজুরি দেওয়া অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। সমান কাজের জন্য সেখানে কেউ ভিন্ন বেতন দিতে পারবে না। এর মানে এ নয় যে, সেখানে বেতনবৈষম্য নেই। করোনাকালের আগের হিসাব মতে, সেখানে প্রায় ১৯ শতাংশ বেতনবৈষম্য ছিল। দেশটির সরকার ২০২২ সালের মধ্যে এ বৈষম্য দূর করতে চেয়েছিল, করোনার ফলে যা সম্ভব হয়নি। তবু এমন বৈষম্যবিরোধী আইন নিশ্চিতভাবেই আশার আলো জাগায়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, লিঙ্গভিত্তিক বেতনবৈষম্য কমাতে শুধু নারীদের শ্রমে অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করাই যথেষ্ট নয়, বরং তাদের কাজের সুযোগ বাড়ানো বা পূর্ণকালীন পদে নিয়োগ প্রদান প্রয়োজন। যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাদের দক্ষতার পরিপূর্ণ ব্যবহার করা সম্ভব হবে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫