ইরানের পরমাণু প্রকল্প: ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাত আসন্ন

আহমেদ শরীফ
প্রকাশ: ১৩ মার্চ ২০২৩, ১০:৩৩

ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের পতাকা। ছবি: সংগৃহীত
আন্তর্জাতিক পারমাণবিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা (আইএইএ) জানুয়ারি মাসে ইরানের ‘ফোরদো’ পারমাণবিক স্থাপনায় ইউরেনিয়ামের মাঝে ৮৩ দশমিক ৭ শতাংশ বিশুদ্ধতা পেয়েছে। কয়েক বছর ধরে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাধ্যমে ইরান এই অবস্থানে পৌঁছেছে।
সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে সংস্থাটি এ তথ্য উল্লেখ করেছে। এর অর্থ হলো, পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে যতটা বিশুদ্ধ ইউরেনিয়াম প্রয়োজন, ইরান তার খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
ইউরেনিয়াম হলো এক প্রকারের খনিজ, যা বিশুদ্ধ বা এনরিচ করে পারমাণবিক বোমা তৈরি করা যায়। ‘সেন্ট্রিফিউজ’ নামের এক যন্ত্রের মাধ্যমে ইউরেনিয়াম থেকে ‘ইউ২৩৫’ অংশ আলাদা করে ফেলাকে বলা হয় ‘এনরিচমেন্ট’। যে ইউরেনিয়ামের মাঝে ৩ থেকে ৫ শতাংশ ‘ইউ২৩৫’ রয়েছে, সেগুলো পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত হয়। পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্যে ৯০ শতাংশের বেশি ‘ইউ২৩৫’ প্রয়োজন।
এর প্রতিক্রিয়ায় ইরান জানায়, আইএইএ’র প্রতিবেদনে আসা সংখ্যা মূলত অনিচ্ছাকৃত ওঠানামার কারণেই পাওয়া গেছে। ২০১৫ সালে ইরান পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তি করে পারমাণবিক প্রকল্প স্থগিত করে; বিনিময়ে ইরানের উপরে নিষেধাজ্ঞা অনেকটাই তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু ২০১৮ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকার চুক্তি থেকে বের হয়ে যায় এবং ইরানের উপরে পুনরায় অবরোধ আরোপ করে।
এর প্রতিবাদে ইরান আবারও ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা শুরু করে। প্রায় দুই বছর ধরে প্রকাশ্যেই তারা ৬০ শতাংশ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক ইস্যুতে আলোচনা পুনরায় শুরু করতে চাইলেও গত এক বছর ধরে তা থেমে রয়েছে।
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাসের কানানি জানান, ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পের ইস্যুগুলো ‘টেকনিক্যাল’ আলাপ এবং দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় না করে মিডিয়ার সামনে তুলে আনার অর্থ হলো আইএইএ তাদের পেশাদারিত্ব হারিয়েছে। এদিকে ইরানের আণবিক শক্তি সংস্থার মুখপাত্র বেহরুজ কামালভান্দি সরাসরিই বলেছেন, ইরান কখনোই ৬০ শতাংশের বেশি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করেনি।
১ মার্চ ইরানের বার্তা সংস্থা ‘ইরনা’কে দেশটির আণবিক শক্তি সংস্থার প্রধান মোহাম্মদ এসলামি বলেন, আইএইএ’র নমুনা এতটাই নগণ্য যে, তা খালি চোখে দেখাই সম্ভব নয়। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কী পরিমাণ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার পর মজুদ করা হয়েছে।
তবে ২৬ ফেব্রুয়ারি সিবিএসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সিআইএ’র প্রধান উইলিয়াম বার্নস বলেন, তাদের বিশ্বাস ইরানের সর্বোচ্চ নেতা এখনো পুনরায় পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সিদ্ধান্ত নেননি; যা তারা ২০০৩ সালের পর স্থগিত করেছে। তবে এর বাইরে আরও দুটি জায়গায় তারা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। প্রথমত ইরান যদি ইচ্ছা করে, তাহলে কয়েক সপ্তাহের মাঝেই ৯০ শতাংশ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ পেরিয়ে যেতে পারবে।
দ্বিতীয়ত তারা পারমাণবিক ওয়ারহেড বহনে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির দিকেও যথেষ্ট অগ্রগামী হয়েছে। যদিও ইরান এখনো পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়নি, তথাপি অন্যান্য ব্যাপার পুরো পরিস্থিতিকে চ্যালেঞ্জিং করে ফেলেছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরের কর্মকর্তা কলিন কাহল মার্কিন কংগ্রেসের কমিটির সামনে বলেন, ইরানের ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ অবস্থান থেকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করার সক্ষমতার মাঝে যে দূরত্ব, তা ১২ মাস থেকে কমে গিয়ে ১২ দিনে নেমে এসেছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস বলেন, বাইডেন প্রশাসনের নীতি হলো, ইরানকে কোনো অবস্থাতেই পারমাণবিক অস্ত্র পেতে না দেওয়া। এই লক্ষ্যে তাদের বিশ্বাস ক‚টনীতিই সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি। কারণ এই সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান হওয়া প্রয়োজন; যাতে করে ইরান কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র পাওয়ার মতো অবস্থানে যেতে না পারে।
তিনি আরও বলেন, ২৮ ফেব্রুয়ারির আইএইএ’র প্রতিবেদনে কী ছিল, সেটা নিয়ে তিনি কথা বলতে পারবেন না; কারণ সেই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি। তবে তারা ইরানের প্রায় ৮৪ শতাংশ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার ব্যাপারে মিডিয়ার প্রতিবেদনগুলো দেখেছেন। এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র তার ইউরোপীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে কথা বলেই এগোবে।
তবে ইসরায়েলি ও মার্কিন কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ‘ব্লুমবার্গ’ বলেছে, ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ ইরানের হাতে ১০টা পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্যে যথেষ্ট ‘এনরিচড’ ইউরেনিয়াম থাকবে। ইরান যদি রাশিয়ার কাছ থেকে ‘এস-৪০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ক্রয় করে তাহলে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনার ওপর ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের হামলার সিদ্ধান্ত এগিয়ে আসবে।
যদিও রাশিয়া ইরানের কাছে ‘এস-৪০০’ বিক্রি করার কথা প্রকাশ করেনি, তথাপি ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রাশিয়া ও ইরান কাছাকাছি চলে এসেছে। এরকম একটা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা ইরানে কার্যকর হতে দুই বছরের কম সময় লাগতে পারে। ইরানি পার্লামেন্টের এক সদস্য বলেছেন, মার্চ মাসেই ইরান রাশিয়ার কাছ থেকে অত্যাধুনিক ‘সুখোই-৩৫’ যুদ্ধবিমান পেতে যাচ্ছে।
ইরান ইতোমধ্যেই রাশিয়ার কাছ থেকে ‘এস-৩০০’ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পেয়েছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এক সপ্তাহ আগেই তেলআবিবের এক নিরাপত্তা আলোচনায় বলেছেন, যত বেশি সময় অপেক্ষা করা হবে, ইরানের উপর হামলার ব্যাপারটা ততটাই কঠিন হয়ে যাবে।
ব্রিটিশ সামরিক থিংকট্যাঙ্ক জেনসের জেরেমি বিনি বলেন, ২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ইসরায়েল আকাশ থেকে আকাশে জ্বালানি সরবরাহ করার বিমান পেতে চলেছে, যা ইরানের অভ্যন্তরে ইসরায়েলের হামলা করার সক্ষমতাকে অনেকটাই এগিয়ে নেবে।
‘ব্লুমবার্গ’ বলছে, ইসরায়েলের পক্ষ থেকে ইরানে হামলার কথা বলাটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। প্রেসিডেন্ট বাইডেনও ১৯ ফেব্রুয়ারি বলেছেন, ইসরায়েলের যা করা প্রয়োজন, তাদের তা করা উচিত এবং যুক্তরাষ্ট্র তাদেরকে সমর্থন দেবে। কিন্তু ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়েই হিসেব করে চলছে। কারণ ইরানের উপর যে কোনো হামলা পুরো অঞ্চলকে অস্থির করবে এবং বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটাবে। ইউক্রেন যুদ্ধ ও চীনের সঙ্গে ‘গ্রেট পাওয়ার’ দ্বন্দ্বের মাঝে মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটা যুদ্ধ কেউই চাইছে না।