যুক্তরাষ্ট্র-চীনের প্রযুক্তি দ্বন্দ্ব আরও উত্তপ্ত

আহমেদ শরীফ
প্রকাশ: ১৭ মার্চ ২০২৩, ১০:০৯

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা। ছবি: সংগৃহীত
যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করে গত ৮ মার্চ নেদারল্যান্ডস সরকার উন্নত মাইক্রোচিপ প্রযুক্তি রপ্তানির ওপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে। দেশটির বাণিজ্যমন্ত্রী লিসিয়ে শ্রেইনেমাশের ডাচ পার্লামেন্টের উদ্দেশে লেখা এক চিঠিতে বলেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে এই প্রযুক্তিকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিয়ন্ত্রণে আনা জরুরি।
তবে তিনি সেখানে চীনের নাম উল্লেখ করেননি। নেদারল্যান্ডসের সেমিকন্ডাক্টর তৈরির যন্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ‘এএসএমএল’ এই নিয়ন্ত্রণের অন্তর্ভুক্ত হবে। বৈশ্বিক মাইক্রোচিপ সরবরাহ চেইনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কোম্পানি হিসেবে এএসএমএলকে বিবেচনা করা হয়। বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত চিপ উৎপাদক যন্ত্র এদেরই তৈরি।
কোম্পানিটি বলছে, তাদের ‘ডিপ আলট্রা ভায়োলেট (ডিইউভি)’ প্রযুক্তির ‘লিথোগ্রাফি’ যন্ত্র রপ্তানি করতে হলে সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। ‘লিথোগ্রাফি’ যন্ত্রের মাধ্যমে সিলিকনের ওপর লেজার ব্যবহার করে সার্কিট ছাপানো হয়, যার ফলে সেমিকন্ডাক্টর মাইক্রোচিপ তৈরি হয়। সেমিকন্ডাক্টর হলো এমন সরঞ্জাম, যা ছাড়া মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে সর্বশেষ প্রযুক্তির সামরিক যন্ত্রপাতি তৈরি করা অসম্ভব।
চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং বলেন, চীন আশা করবে নেদারল্যান্ডস ‘অন্যান্য দেশকে’ অনুসরণ করে রপ্তানির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবে না। এখানে চীন ‘অন্যান্য দেশ’ বলতে যুক্তরাষ্ট্রকেই বুঝিয়েছে।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত জানুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্র ডাচ ও জাপানের সঙ্গে একটা সমঝোতায় পৌঁছায়, এর মাধ্যমে চীনে সেমিকন্ডাক্টর তৈরির সর্বশেষ প্রযুক্তি রপ্তানির ওপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হবে। তবে সর্বশেষ প্রযুক্তি না পেলেও চীন অপেক্ষাকৃত পুরনো প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারবে। শুধু তাই নয়, সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি বলছে, চীন এএসএমএলের আগের প্রযুক্তি কিনতে পারবে। একমাত্র চীনই পুরনো প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেমিকন্ডাক্টর তৈরি করছে।
অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র, তাইওয়ান, জাপান ও কিছু ইইউ দেশ উন্নততর ‘১০ ন্যানোমিটারের নিচের’ প্রযুক্তিতে চলে যাচ্ছে। এএসএমএলের প্রযুক্তি ‘৩ ন্যানোমিটারের নিচে’। নতুন মার্কিন আইন নিশ্চিত করতে চাইছে যে, চীন যেন ‘১৪ ন্যানোমিটারের নিচের’ প্রযুক্তি বা ‘১২৮ লেয়ার ৩ডি এনএএনডি’র চেয়ে উন্নততর প্রযুক্তি না পায়। তবে বিবিসি মনে করিয়ে দিচ্ছে, ডাচ সরকার ২০১৯ সাল থেকেই চীনে এএসএম লের ‘এক্সট্রিম আলট্রা ভায়োলেট (ইইউভি)’ প্রযুক্তির যন্ত্র রপ্তানির ওপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে।
২০২২ সালের অক্টোবরে মার্কিন সরকার চীনে প্রযুক্তি রপ্তানির ওপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। এই নিয়ন্ত্রণের ফলে বিশ্বের যে কোনো দেশে মার্কিন প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা সেমিকন্ডাক্টর চীনে রপ্তানি করতে গেলে সরকারের অনুমতি লাগবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্ত তাদের বন্ধু দেশগুলোকে খুশি করতে পারেনি। দক্ষিণ কোরিয়ার বাণিজ্যমন্ত্রী এক সপ্তাহ আগেই বলেছেন, সেমিকন্ডাক্টরের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার ফলে তা একদিকে যেমন ব্যবসায়িক অনিশ্চয়তা বৃদ্ধি করবে, তেমনি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তি ব্যবহারের অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করবে।
এছাড়াও তা যুক্তরাষ্ট্রকে প্রযুক্তিগত বিনিয়োগের ক্ষেত্র গুরুত্বহীন করবে। চীনা কোম্পানিগুলো এখন সেমিকন্ডাক্টর তৈরির যন্ত্র জোগাড় করতে মরিয়া। একই সঙ্গে এএসএমএলের যথেষ্ট ব্যবসায়িক স্বার্থ এখানে জড়িত। কোম্পানিটার ৩৪ শতাংশ আয় আসে ‘ডিইউভি’ প্রযুক্তি বিক্রি করে; আর ৪৬ শতাংশ আয় আসে এর আগের ‘ইইউভি’ প্রযুক্তি থেকে। উভয় প্রযুক্তিই এখন চীনে যাচ্ছে না।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে চীন সোলার প্যানেলের যন্ত্রপাতি রপ্তানির ওপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ১০টি সোলার প্যানেল প্রস্তুতকারক কোম্পানিই চীনা। সোলার প্যানেল তৈরির কাজের ৮০ শতাংশই চীনের নিয়ন্ত্রণে। মার্কিন থিঙ্কট্যাঙ্ক দ্য আটলান্টিক কাউন্সিলের এক লেখায় জেনিফার লি বলেন, চীনাদের এই সিদ্ধান্ত ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তির ওপরে নিয়ন্ত্রণ আরোপের একটা প্রত্যুত্তর। মার্কিন কংগ্রেসে মুদ্রাস্ফীতি কমাতে আইন পাস করে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপরে নির্ভরশীলতা কমাতে বলা হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, সোলার ও বায়ুশক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে।
এখন সমস্যা হলো, চীন শুধু সোলারই নয়, বায়ুশক্তির ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহকারী। যার ফলে মার্কিন নীতি বাস্তবায়ন এখন চীনের সিদ্ধান্ত দ্বারা প্রভাবিত হবে। এছাড়াও কিছুদিন আগেই চীন বিদ্যুৎচালিত গাড়ির ব্যাটারির প্রযুক্তি যাতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে চলে না যায়, সে বিষয়ে কিছু নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। এগুলো প্রমাণ করে যে, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মার্কিন সরকার চীনকে নিয়ন্ত্রণে যে পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা বিভিন্ন সেক্টরকে প্রভাবিত করবে।
মার্কিন থিংকট্যাঙ্ক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ডিরেক্টর গ্রেগোরি এলেন এক লেখায় বলেছেন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যে প্রতিযোগিতাকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রযুক্তি যুদ্ধের অংশ বলা হচ্ছে, তার একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে একা নয়। চীনের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বে যুক্তরাষ্ট্রের বড় সুবিধা তার সম্পদ বা অস্ত্র নয়; বরং তা হলো বিশ্বব্যাপী তার বন্ধু। চীন এ ক্ষেত্রে বিশ্বকে বিকল্প কোনো আদর্শ দিতে পারেনি; যা কিনা চীনের বন্ধুর সংখ্যা বাড়াতে পারে।