
শি জিনপিং-ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: সংগৃহীত
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকেই মস্কোকে একের পর এক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে পশ্চিমা বিশ্ব। নিষেধাজ্ঞার এ পরিমাণ ইরানের চেয়ে বেশি, প্রায় উত্তর কোরিয়ার মতো। আর্থিক, ব্যবসা থেকে শুরু করে রাশিয়ার সরকারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হচ্ছে।
এ অবস্থায় দেশটির অর্থনীতি ইরান বা উত্তর কোরিয়ার মতোই চীনের দ্বারস্থ। বেইজিং জানে এ পরিস্থিতি বিশ্বের পরাশক্তি হিসেবে নিজেকে তুলে আনার ক্ষেত্রে এক মোক্ষম সময়। উভয় দেশ নিজ নিজ স্বার্থেই নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে ও হচ্ছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের ভাষ্য, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব সীমিত করতে বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে। এ প্রতিবেদন লেখার সময়ে শি রয়েছেন ঐতিহাসিক রাশিয়া সফরে। ২০ থেকে ২২ মার্চের এ সফরটি ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে চীনের রূপরেখা ও এ নিয়ে পুতিন-শি শীর্ষ বৈঠকের জন্য পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।
তবে এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়। এ সফরে যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক চুক্তি ও স্মারক স্বাক্ষর হওয়ার কথা তার জন্যও এ সফর ঐতিহাসিক। এতে রাশিয়ার অর্থনীতি খাদের দ্বারপ্রান্ত থেকে বাঁচবে ঠিকই, তবে বেশি লাভ হবে চীনের। চীনা অর্থনীতি ও কূটনীতির বিশ্বব্যাপী অবস্থান নিশ্চিত হবে। যা পরাশক্তির জায়গাটা আরও প্রবল করবে।
২০১২ সালে শি জিনপিং ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই মস্কোর সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক রেখে চলছেন। ওয়াশিংটনের সঙ্গে বিরোধ এ সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করেছে। সাংহাই ইউনিভার্সিটি অব পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড ল’র আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ লি জিন বলেন, ‘চীন-রাশিয়ার সম্পর্ক ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। তবে দুটি দেশ কোনো জোট নয়।’
পুতিন-শি মস্কো শীর্ষ সম্মেলনের আলোচ্য সূচিতে স্থান পেয়েছে আঞ্চলিক নিরাপত্তা, জ্বালানি, বাণিজ্য, অবকাঠামো উন্নয়ন, নতুন আর্থিক অর্থপ্রদান ব্যবস্থা এবং ইউক্রেন যুদ্ধ। রাশিয়া-চীন সম্পর্কের ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান অগ্রাধিকার লাভ করেছে এমন একটি বিষয় হলো সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (এসসিও)। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠিত এ জোটে এখন আটটি সদস্য রাষ্ট্র রয়েছে-চীন, ভারত, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, রাশিয়া, পাকিস্তান, তাজিকিস্তান এবং উজবেকিস্তান।
চারটি পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র যারা পূর্ণ সদস্যপদ পেতে আগ্রহী-আফগানিস্তান, বেলারুশ, ইরান এবং মঙ্গোলিয়া এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। রয়েছে ছয়টি ‘ডায়ালগ পার্টনার’-আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, কম্বোডিয়া, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং তুরস্ক। ২০২১ সালে, পূর্ণ সদস্য হিসেবে এসসিওতে ইরানের যোগদান প্রক্রিয়া শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তখন মিশর, কাতারের পাশাপাশি সৌদি আরব সংলাপ অংশীদার হয়েছিল।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ এবং এসসিওর মহাসচিব ঝাং মিং গত সপ্তাহে ইরান ও বেলারুশের সংগঠনে পূর্ণ সদস্যপদে যোগদানের পদ্ধতিগত দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। বাহরাইন, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, কুয়েত এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত হচ্ছে সংলাপ অংশীদার। এটি পূর্ব ইউরোপের ইউরেশীয় এলাকায় আঞ্চলিক বাণিজ্য ও নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করবে। সেই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে এতে অন্তর্ভুক্ত করবে।
এসসিও শুধু একটি নিরাপত্তা ব্লক নয়, এটির একটি উল্লেখযোগ্য বাণিজ্য উন্নয়ন পোর্টফোলিও রয়েছে। এ ছাড়াও ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন (ইএইইউ) এবং বিআরআইসিএস নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা শি-পুতিন শীর্ষ বৈঠকে। বর্তমানে ইএইইউতে আর্মেনিয়া, বেলারুশ, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান এবং রাশিয়া অন্তর্ভুক্ত রয়েছে এবং পূর্ব ইউরোপের সীমানা থেকে পশ্চিম চীন পর্যন্ত উত্তর ইউরেশীয় অঞ্চলে তা কার্যকর।
এ ছাড়াও এ জোটের মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে চীন, ইরান, সার্বিয়া ও ভিয়েতনামের সঙ্গে। ইএইইউ জোটের পরিসর বড় করার বিষয়েও আলোচনা চলছে। ভারত, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো বড় অর্থনীতির দেশ এ মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির জন্য আবেদন করেছে। গত বছর এ জোটের আন্তঃবাণিজ্য ছিল ৮০ বিলিয়ন ডলারের, যা বছরে ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
গত বছর রাশিয়ার সঙ্গে চীনের বাণিজ্য বেড়ে ১৪ হাজার ৬৯০ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। বাণিজ্যের এ পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর সঙ্গে চীনের মোট বাণিজ্য ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি ডলারের এক-দশমাংশেরও কম। রাশিয়া অবশ্য অনেক আগে থেকেই এ পরিস্থিতির প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। গত এক দশকে ভ্লাদিমির পুতিন সরকার ইউরোপীয় বাজারের ওপর নির্ভরতা কমাতে দূরপ্রাচ্যের রপ্তানি প্রসারিত করেছে।
মস্কো ও বেইজিং উভয়ই মার্কিন আর্থিক ব্যবস্থা ও আনুষ্ঠানিক চাপ কমাতে ডলারনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইএইচএস মার্কেটের প্রধান এশিয়া-প্যাসিফিকের অর্থনীতিবিদ রাজীব বিশ্বাসের মতে, চীন গত বছর রাশিয়ার মোট রপ্তানির প্রায় ১৭ শতাংশ কিনেছে। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই জ্বালানি তেল ও গ্যাস। এজন্য রুশ জ্বালানি রপ্তানির একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার হবে চীন।
বর্তমানে বেইজিং আরও জ্বালানি চায়, তবে চাইলেই মস্কো সরবরাহ বাড়াতে পারবে না। এরই মধ্যে দুই দেশের মধ্যে সংযোগকারী পাইপলাইন সর্বোচ্চ ক্ষমতায় পৌঁছেছে। গত মাসে দেশ দুটি ৩০ বছরের সরবরাহ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। তবে সেই গ্যাস সরবরাহের জন্য পাইপলাইনগুলো তিন বছরের মধ্যে সম্পন্ন হবে না। দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ২০২২ সালে মাত্র ২০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে যা শি-পুতিন ২০১৮ সালে নির্ধারণ করেছিলেন।
২০৩০ সালের মধ্যে ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের লক্ষ্য রয়েছে। চীনা অটোমোবাইল খাত গত পাঁচ মাসে রাশিয়ার বাজারের তার শেয়ার ২০ শতাংশ বাড়িয়েছে। অন্যান্য উৎপাদন খাত, যেমন-পশ্চিমা গৃহস্থালি যন্ত্রপাতি চীনা এবং অন্যান্য এশীয় ব্র্যান্ড দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে।
বেইজিংভিত্তিক উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান সাইনো অটো ইনসাইটের প্রতিষ্ঠাতা তু লে বলেন, ‘বড় বড় প্রতিষ্ঠান চলে যাওয়ায় বাজারে বড় একটা শূন্যতা দেখা দেয়। এবং চীনের প্রতিষ্ঠানগুলো খুশি মনে সেই ঘাটতি পূরণ করছে।’ এই ধারায় সবচেয়ে লাভবান হয়েছে শাওমি। এ বছর প্রতিষ্ঠানটির বিক্রি দ্বিগুণ হয়েছে। বেইজিং ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি এখন রাশিয়ার শীর্ষ স্মার্টফোন বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান। শাওমির রেডমি ফোনগুলো রাশিয়ায় খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছে, মূলত এর শক্তিশালী ক্যামেরার জন্য।
যুদ্ধের আগে রুশ স্মার্টফোন বাজারে চীনের ফোনগুলো জনপ্রিয় ছিল। ২০২১ সালের ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, স্মার্টফোন বাজারের ৪০ শতাংশ চীনের প্রতিষ্ঠানগুলোর দখলে ছিল। ঠিক এক বছর পর এই হার বেড়ে ৯৫ শতাংশ হয়েছে। ২০২১ সালে অ্যাপল ও স্যামসাংয়ের হাতে যৌথভাবে ৫৩ শতাংশ বাজার থাকলেও এখন তা ৩ শতাংশে নেমে এসেছে। দুটি প্রতিষ্ঠানই রাশিয়া থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে।
গাড়ির ক্ষেত্রেও একই ধারা দেখা যাচ্ছে। এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল মবিলিটি থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ব্যক্তিগত গাড়ির শীর্ষ ১০ তালিকায় স্থান করে নিয়েছে চীনের চেরি ও গ্রেট ওয়াল মোটর। জার্মানির বিএমডব্লিউ ও মার্সিডিজ ইতোমধ্যে বাজার থেকে সরে গেছে। রুশরা গত বছর রেকর্ড সংখ্যক চীনে নির্মিত গাড়ি কিনেছেন। ২০২২ এ চীনে নির্মিত নতুন গাড়ির বিক্রি ৭ শতাংশ বেড়ে ১ লাখ ২১ হাজার ৮০০ হয়েছে। রাশিয়ার নিজস্ব ব্র্যান্ড লাদার বিক্রিও বেড়েছে। যুদ্ধের আগেও এটি জনপ্রিয় ছিল। ২০২২ সালে তাদের মোট বাজার ২২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৮ শতাংশ হয়েছে।
আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড ফিরে এলেও চীনের সংস্থারা তাদের আধিপত্য ধরে রাখতে পারেন। বিশেষত, প্রতিদ্ব›দ্বীদের সরবরাহ শৃঙ্খল আবারও গড়ে তুলতে অনেক সময় লেগে যেতে পারে। তুলে বলেন, ‘একটু রূঢ়ভাবে বলতে হয়, প্রকৃত খেলোয়াড়রা মাঠে না থাকায় রুশ ও চীনা ব্র্যান্ডগুলো বাজারে বদলি খেলোয়াড় হিসেবে উপস্থিত রয়েছে। তবে কিছু বদলি খেলোয়াড় তাদের আসন পাকাপোক্ত করে নিতে পারে।’
রাশিয়ার সরকারের তথ্যমতে, রুশ অর্থবছরে রাজস্ব আরও বেড়েছে, যেখানে প্রধান ভূমিকা রেখেছে উচ্চমূল্যে জ্বালানি বিক্রি। চীন ও ভারতের মতো অন্যান্য ইচ্ছুক ক্রেতা দেশের সঙ্গে রপ্তানি বাণিজ্য আবার চালু হয়েছে। এ বিষয়ে ইউরেশিয়া গ্রুপের চীন ও উত্তরপূর্ব এশিয়ার জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক নিল থমাস বলেন, ‘রাশিয়ার যুদ্ধে চীনের আর্থিক সমর্থনের অর্থ হলো, চীন রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য বাড়িয়েছে, যা পশ্চিমাদের মাধ্যমে রাশিয়ার সামরিক শক্তি দুর্বল করতে ব্যর্থ হয়েছে।’
২০২২ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চীন রাশিয়া থেকে ৫০ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের অপরিশোধিত জ্বালানি তেল কিনেছে, যা এর আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৫ শতাংশ বেশি। কয়লা আমদানি ৫৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি পাইপ গ্যাস এবং এলএনজিসহ ১৫৫ শতাংশ বেড়ে ৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের পৌঁছেছে।
কিছু রাশিয়ার ব্যাংক সুইফট থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর রাশিয়ার কোম্পানিগুলো চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সুবিধার্থে বেশি ইউয়ান ব্যবহার করেছে। মস্কো এক্সচেঞ্জের তথ্যমতে, গত নভেম্বরে রাশিয়ার বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে ইউয়ানের ব্যবহার ৪৮ শতাংশ বেড়েছে, যদিও জানুয়ারিতে ছিল মাত্র এক শতাংশ।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং রাশিয়ার প্রেশিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ‘সর্বোৎকৃষ্ট বন্ধু’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে চীনের কূটনৈতিক ও আর্থিক কাঠামোগত সহযোগিতা এ বন্ধুত্বকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। এবারের সফরে পুতিন যে কারণে শির সঙ্গে সম্পর্ককে বলেছেন ‘বন্ধুত্ব সীমাহীন’।