
রাহুল গান্ধী। ছবি: সংগৃহীত
ভারতই শুধু নয়, গোটা উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম রাহুল গান্ধীর। বাবা রাজীব গান্ধী, দাদি ইন্দিরা গান্ধী এবং প্রমাতামহ জওহরলাল নেহরু ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। এর ধারাবাহিকতায় তিনিও দেশটির প্রধানমন্ত্রী হবেন বলে মনে করা হচ্ছিল।
তবে ভারতে হিন্দুত্ববাদের উত্থান, ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ এবং ভারতের রাজনীতি বোঝার ক্ষেত্রে রাহুলের সীমাবদ্ধতা ও কংগ্রেসের রাজনৈতিক-সংগঠনিক অব্যবস্থাপনার কারণে সেই আশা ক্রমশ ফিকে হয়ে আসে। তবে আদালতে দণ্ডিত ও লোকসভায় অযোগ্য ঘোষণা করার পর রাতারাতি আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসেন রাহুল।
অনেকে এ ঘটনাকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর জোটবদ্ধ হওয়া ও বিজেপির চলমান রাজনীতির সংকট হিসেবেও দেখছেন। কার্যত লোকসভা ভোটের আগের বছর এ ঘটনার ভেতর দিয়ে রাহুল গান্ধীই এখন মূল রাজনৈতিক ইস্যু।
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে রাফাল দুর্নীতি নিয়ে সরব হয়েছিলেন রাহুল। কর্নাটকের কোলারে দলীয় সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী মোদির বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে বংশগত পদবি তুলে মন্তব্য করেন তিনি। রাহুল বলেছিলেন, ‘কাকতালীয়ভাবে সব চোরের পদবি মোদি হয় কীভাবে?’ ওই সময় পলাতক হীরা টাইকুন নিরভ মোদি ও ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের প্রধান ললিত মোদিকেও নির্দেশ করেছিলেন রাহুল।
রাহুলের এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মানহানি মামলা করেন গুজরাটের সাবেক মন্ত্রী ও বিজেপি বিধায়ক পূর্ণেন্দু মোদি। দণ্ডবিধি ৪৪৯ ও ৫০০ ধারার ফৌজদারি এ মামলায় অভিযোগ ছিল, গোটা মোদি সম্প্রদায়কে অপমান করেছেন রাহুল।
ওই মামলায় সুরাট আদালত রাহুলকে দুই বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। তবে কংগ্রেস নেতার আইনজীবীরা বলছেন, মামলায় সঠিক আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। মোদিরই উচিত ছিল অভিযোগটি করা। কারণ পূর্ণেন্দু মোদি ওই বক্তৃতার লক্ষ্য ছিলেন না। রাহুলের আইনজীবী কিরিত পানওয়ালা বলেছেন, রায়ের সময় তার মক্কেল বিচারকদের বলেছেন ‘গণতন্ত্রের স্বার্থেই’ তিনি এই মন্তব্য করেছেন।
রাহুলের আত্মপক্ষে চারটি যুক্তি রয়েছে-প্রথমত রাহুল গুজরাটের বাসিন্দা নন এবং সে কারণে অভিযোগ দায়েরের আগে একটি তদন্ত অনুষ্ঠানের দরকার ছিল। দ্বিতীয়ত মোদি নামে কোনো সম্প্রদায় নেই। তৃতীয়ত মোদি পদবি রয়েছে এমন কোনো ব্যক্তির সঙ্গে এর কোনো সম্পৃক্ততা নেই এবং চতুর্থত রাহুলের মন্তব্যের পেছনে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নেই।
আইন বিশেষজ্ঞ গৌতম ভাাটিয়া এক টুইটে বলেছেন, ‘কোনো সাধারণ একটি শ্রেণির ব্যক্তিদের নিয়ে উদ্বৃতি-এ ক্ষেত্রে পদবি, শাস্তিযোগ্য নয় যদি কোনো এক বিশেষ ব্যক্তি এটা প্রমাণ করতে না পারে যে সেটি আসলে তার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। যদি কেউ বলে যে ‘সব আইনজীবীরাই চোর’, তাহলে আমি একজন আইনজীবী হিসেবে তার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করতে পারব না, যদি এটা প্রমাণ করতে না পারি যে এটি আমাকে উদ্দেশ করেই বলা হয়েছে।’
ভারতের ফৌজদারি মানহানি আইন ব্রিটিশ আমলে প্রণীত একটি আইন, যার অধীনে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে দুই বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানা বা দুটোই হতে পারে। মুক্তমতের পক্ষে যারা কাজ করেন প্রায়ই তারা অভিযোগ করেন, এই আইন স্বাধীনতার মূলনীতির পরিপন্থী এবং এটি রাজনীতিবিদেরা তাদের বিরুদ্ধে সমালোচনা প্রতিরোধ করতে ব্যবহার করে।
২০১৬ সালে রাহুলসহ শীর্ষ রাজনীতিবিদেরা মানহানিকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য না করতে একটি আইনি আবেদন করেছিলেন। কিন্তু ভারতের সুপ্রিম কোর্ট আইনের বৈধতা ধরে রাখেন এই যুক্তিতে, ‘মুক্তমতের স্বাধীনতার মানে এই নয় যে, একজন নাগরিক আরেকজন নাগরিকের মানহানি করতে পারে।’
ভারতে শুধু মানহানির কারণে কাউকে সংসদ সদস্য পদে বা নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা যায় না। একজন এমপিকে তার পদ থেকে অযোগ্য ঘোষণা করা যায় বিরোধিতামূলক প্রচারণা থেকে শুরু করে নির্বাচনে জালিয়াতিসহ বিভিন্ন কারণে। কিন্তু যদি কোনো অপরাধের দায়ে দুই বছর বা তার বেশি কারাদণ্ডে তিনি দণ্ডিত হন তাহলেও তাকে অযোগ্য ঘোষণা করা যেতে পারে।
গত ২৪ মার্চ লোকসভা সচিবালয় থেকে জারি করা এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘কেরালার ওয়েনাড সংসদীয় নির্বাচনী এলাকার প্রতিনিধিত্বকারী শ্রী রাহুল গান্ধী দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় আর্টিকেল ১০২(১)(ই)-এর বিধান অনুসারে লোকসভার সদস্যপদ থেকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। তা কার্যকর হবে ২০২৩ সালের ২৩ মার্চ থেকে।’
সংসদ সদস্য পদ খারিজের পর ২৫ মার্চ সংবাদ সম্মেলনে রাহুল বলেন, ‘আমার সদস্য পদ খারিজ হয়েছে কারণ আমার পরবর্তী ভাষণকে প্রধানমন্ত্রী ভয় পাচ্ছেন। ওই ভাষণটা আমি আদানির ব্যাপারে দিতাম। আমি তার চোখে আতঙ্কের ছাপ দেখেছি। তিনি কিছুতেই চাননি যেন ভাষণটা পার্লামেন্টের কক্ষে দিতে পারি।
আদানি গোষ্ঠীর সংস্থাগুলোর কাছে যে ২০ হাজার কোটি রুপি এসেছিল, কেউ জানে না এই অর্থের উৎস কী! প্রধানমন্ত্রী ভয় পাচ্ছেন যে, মোদি-আদানি সম্পর্কটা মানুষের সামনে ফাঁস হয়ে যেতে পারে। সেজন্যই আমাকে আটকানো হচ্ছে। কিন্তু আমি থামব না। মোদি-আদানি সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন আমি তুলবই।’
সংবাদ সম্মেলনে হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধেও কথা বলেছেন রাহুল। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, আদালতের রায়ের পর রাহুল ক্ষমা চাইবেন কিনা। রাহুল বলেন, ‘আমি সাভারকার নই, আমি গান্ধী। ক্ষমা চাইব না।’ এই উক্তিতে বিনায়ক দামোদর সাভারকারের কথা উল্লেখ করেছেন তিনি। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) যে হিন্দুত্ববাদের রাজনীতি, তার মূল দর্শন সাভারকারেরই লেখা থেকে আসা। তিনি আন্দামানের সেলুলার জেলে বন্দি থাকার সময়ে ব্রিটিশ সরকারের কাছে একাধিকবার ক্ষমাপ্রার্থনা করে চিঠি লিখেছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে সেই ক্ষমাপ্রার্থনার দিকেই ইঙ্গিত করেছেন রাহুল।
এত দিন রাহুল-সোনিয়া গান্ধীকেই নিশানা করে রাজনীতি করে এসেছে বিজেপি। এবার রাহুল না থাকলে বিজেপির রাজনীতি অনেকটা গতি হারাবে। ‘লোকসত্তা’ পত্রিকার সম্পাদক গিরীশ কুবের বলেন, ‘এটা কংগ্রেসের কাছে একটা বড় সুযোগ নতুন কোনো চেহারা সামনে নিয়ে আসার। রাহুল সবসময়ই বিজেপির পাঞ্চিং ব্যাগ হয়ে থেকেছেন। এখন তিনিই যদি না থাকেন, তাহলে বিজেপির তো নিশানা করারই কেউ থাকবে না। তাই কংগ্রেসকে খুব ভেবেচিন্তে এগোতে হবে।’
কংগ্রেস এবং বিরোধী দলগুলো যেমন একদিকে রাহুলকে ‘পরিস্থিতির শিকার’ বা তার এমপি পদ খারিজকে ‘গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ’ ধরনের শব্দ বন্ধে অভিহিত করছে, অন্যদিকে বিজেপি যে কোনোভাবে আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে মোদির সম্পর্ককে সামনে আসতে দিতে চায় না।
রাহুলের এমপি পদ খারিজের প্রতিক্রিয়া ছিল অনেক বড় এবং এর ফল দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এর প্রতিবাদে ২৫ মার্চ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কংগ্রেস কর্মীরা বিক্ষোভ করেছেন, পাঞ্জাবে হয়েছে রেল অবরোধ। কংগ্রেসের নেতৃত্বে ১৬টি বিরোধী দল যখন একত্রে কর্মসূচি নিচ্ছিল, তখনো তৃণমূল কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, বিএসআরের মতো রাজনৈতিক দলগুলো আলাদা ছিল।
রাহুলের এমপি পদ খারিজের ঘোষণাই সব দলকে মিলিয়ে দিল বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। যে তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের এখন অনেক দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, সেই তৃণমূল নেতা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন টুইট করে। তিনি লেখেন, ‘প্রধানমন্ত্রী মোদির নতুন ভারতে বিরোধী নেতারা বিজেপির প্রধান টার্গেট হয়ে উঠেছেন।
যেখানে অপরাধের অতীত থাকা বিজেপির নেতারা মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পেয়ে যান, সেখানে বিরোধী নেতারা তাদের ভাষণের জন্য ডিসকোয়ালিফাই হন। আমাদের সাংবিধানিক গণতন্ত্রের ইতিহাসে আজ এক ঘৃণ্য নজির প্রত্যক্ষ করলাম।’
কর্নাটকের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এইচ ডি কুমারস্বামী বলেন, ‘রাহুলের এমপি পদ খারিজ প্রতিহিংসামূলক রাজনীতির নজির।’ দিল্লির রাজনৈতিক মহল মনে করছে, লোকসভা ভোটের আগে রাহুলের ওপর এ রাজনৈতিক হামলা বিরোধীদের আরও একাট্টা করবে। যেসব অবিজেপি, অকংগ্রেসি রাজ্য পর্যায়ের দল এত দিন কংগ্রেসের থেকে দূরত্ব বজায় রাখছিল, এবার তারাও এই ইস্যুতে কংগ্রেসের কাছাকাছি চলে আসবে।