
মানবিক করিডর দিয়ে হাজারও মানুষকে উদ্ধারের তৎপরতা চালাচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। ছবি: সংগৃহীত
সুদানের সেনাবাহিনী ও মিলিশিয়ার মধ্যকার সংঘর্ষ আঞ্চলিক সংঘাতে রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ দেশটির সঙ্গে সাতটি দেশের সীমানা রয়েছে। সুদানের রাজনৈতিক উত্থান-পতন এবং সংঘাতের প্রভাব পড়ে লিবিয়া, ইথিওপিয়া, দক্ষিণ সুদান, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক ও শাদসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর উপর পড়ে।
এপ্রিলের মাঝামাঝি শুরু হওয়া এ সংঘর্ষে কমপক্ষে ৫শ মানুষের প্রাণ গেছে এবং আরও ৪ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছে বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে। সুদান থেকে বিশ্বের অনেক দেশের নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সাময়িক যুদ্ধবিরতির কথা বলা হলেও সেটার বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
সংঘাতের এক পক্ষে রয়েছেন সুদানের সামরিক সরকারের প্রধান জেনারেল আব্দেল ফাত্তাহ আল-বুরহান; যিনি দেশের প্রেসিডেন্টও। আর তার বিরোধী পক্ষে রয়েছে সুদানের মিলিশিয়া র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্স (আরএসএফ); যার প্রধান জেনারেল মোহামেদ হামদান দাগালো, যিনি হামেদতি নামেও সমধিক পরিচিত। যুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত হামেদতি ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট।
২০১৯ সালে দুজন একত্রে একনায়ক ওমর আল-বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন। তবে পশ্চিমাদের প্রচেষ্টায় সুদানে বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টাকে তারা দুজনই বারংবার বাধাগ্রস্ত করেছেন। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করলেও সুদানের সামরিক শাসকের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো সুসম্পর্ক রেখে চলেছে।
আল জাজিরার বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে, ২০২১ সালের অক্টোবরে সুদানের সামরিক অভ্যুত্থানের পর সেনাবাহিনী চেয়েছিল বেসামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে আরএসএফ মিলিশিয়ার ক্ষমতাও খর্ব করতে। কাজেই অভ্যুত্থানের পর বুরহানের সঙ্গে হামেদতির যে দ্বন্দ্ব শুরু হবে, তা প্রায় জানাই ছিল।
দ্য গার্ডিয়ানের এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, লোহিত সাগর, আফ্রিকার সাহেল অঞ্চল এবং ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ অঞ্চলের মাঝে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থিত হওয়ার কারণে সুদানের গুরুত্ব অনেক। এখানকার কৃষি সম্পদের কারণে আঞ্চলিক শক্তিরা সর্বদাই সুদানের রাজনীতিতে জড়িয়েছে। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত এখানে তাদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে সুদানে রুশ নৌঘাঁটি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
সুদানে বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন আঞ্চলিক দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরবকে সঙ্গে নিয়ে ‘কোয়াড’ নামের একটা জোট গঠন করেছিল।
আল জাজিরার এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সুদানের উপরে মধ্যপ্রাচ্যের দুটি দেশ সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের কতটা প্রভাব রয়েছে, তা ফুটে উঠতে শুরু করেছে ২০১৯ সালে দেশটির একনায়ক ওমর আল-বশিরের ক্ষমতাচ্যুতির পর থেকে। ২০২২ সালে সুদানের সামরিক সরকার এবং আমিরাতের দুই কোম্পানির মধ্যে ছয় বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
চুক্তি মোতাবেক কোম্পানি দুটি লোহিত সাগরের তীরে ‘আবু আমামা’ নামের একটা সমুদ্রবন্দর তৈরি করবে। সুদানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক জিহাদ মাশামুন বলেন, আরব আমিরাত লোহিত সাগরের বন্দরগুলোর নিয়ন্ত্রণ চায়। লোহিত সাগরে তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে; আর মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকাতেও তাদের এই প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে।
লন্ডনের কিংস কলেজের সহযোগী অধ্যাপক আন্দ্রেয়াস ক্রিগ বলেছেন, কিছুদিন আগ পর্যন্তও আমিরাত সুদানের দুই জেনারেলকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এখন তারা তাদের নীতিতে পরিবর্তন আনতে পারে। কারণ একসঙ্গে দুজনকে সমর্থন দিয়ে যাওয়াটা একসময় সমস্যার জন্ম দিতই। সুদান আফ্রিকার দেশ হলেও মধ্যপ্রাচ্য সুদানকে আরব দেশ বলে গণ্য করে। কাজেই সুদানে যে কোনো সংঘাতের একটা আঞ্চলিক চেহারা রয়েছে।
জিহাদ বলেছেন, উত্তরের দেশ মিশর সুদানের সেনাবাহিনীকে মিশরের সেনাবাহিনীর প্রতিচ্ছবি মনে করে। তাদের ধারণা সুদানে স্থিতিশীলতা ধরে রাখার একমাত্র চাবি সেনাবাহিনীর হাতে। অপরদিকে হামেদতিকে তারা ভাড়াটে সেনা হিসেবে দেখে। আন্দ্রেয়াস বলেন, লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে আমিরাত ও মিশর উভয়েই জেনারেল খলিফা হাফতারের পক্ষে থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে তাদের মাঝে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে।
এছাড়াও ইথিওপিয়ার সংকটে কে কোন পক্ষ নেবে, সেখানেও তাদের দ্ব›দ্ব ছিল। এখন সেখানে সুদান যোগ হলো। তবে এখানে উল্লেখযোগ্য হলো যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান। যুক্তরাষ্ট্র সুদানের সামরিক নেতাদের নিয়ন্ত্রণ করতে মিত্র দেশ আমিরাত ও সৌদিকে পাশে রেখেছে। কিন্তু এখানেই প্রকাশ পেয়ে যায় যে, আফ্রিকায় যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি তার প্রভাব ধরে রাখতে পারছে না; বরং এ কাজে ওয়াশিংটন তার মিত্রদের উপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছে।
ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাঙ্ক রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের (রুসি) অ্যাসোসিয়েট ফেলো স্যামুয়েল রামানি বলেছেন, যদি সংঘাতে হামেদতি সমস্যা পড়েন, তাহলে আমিরাত হয়তো আরএসএফের পক্ষ নিতে পারে। সেক্ষেত্রে সরাসরি সহায়তা না দিয়ে তারা হয়তো লিবিয়াতে তাদের এজেন্ট জেনারেল হাফতারের হাত দিয়ে সহায়তা পাঠাতে পারে। হামেদতির সোশ্যাল মিডিয়ার পেজগুলো আমিরাত থেকেই পরিচালিত হচ্ছে। সেগুলোতে তারা আমিরাতের রাজনৈতিক দর্শনকেই প্রতিফলিত করছে এবং আমিরাত যে ধরনের কথা বলে, সেগুলোই তারা ব্যবহার করছে সুদানের সামরিক শাসক জেনারেল বুরহানের বিরুদ্ধে।
যুক্তরাষ্ট্রের দুই মিত্র দেশ আমিরাত ও মিশর লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে একই পক্ষে থাকলেও এখন তারা দুই পক্ষ হয়ে সুদানে রক্তপাত ঘটাতে ইন্ধন জোগাচ্ছে। বিশ্লেষক জিহাদের কথায়, যুক্তরাষ্ট্র সুদানের রাজনীতিকে তাদের মিত্রদের কাছে ‘আউটসোর্স’ করেছে। এর ফলশ্রুতিতে দুই জেনারেলের কেউই ক্ষমতা ছেড়ে দিতে চাইছেন না; যা দেশটির সংঘাতকে আঞ্চলিক সংঘাতে পরিণত করতে চলেছে।
কানাডাভিত্তিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক অ্যান্ড্রু ম্যাকগ্রেগর মার্কিন থিঙ্কট্যাংক জেমসটাউন ফাউন্ডেশনের এক লেখায় বলেছেন, আরএসএফের প্রধান জেনারেল হামেদতি যখন বলছেন যে, ক্ষমতার মালিক জনগণ অথবা এই সংঘাত হলো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য, তখন কথাগুলো কারও কাছেই বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না।
আবার এটাও ঠিক, জেনারেল বুরহানের অধীনে থাকা সেনাবাহিনী জানে, বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে তারা ক্ষমতা হারাবে। আর আরএসএফের জয়লাভ করার অর্থ হলো, আরএসএফ সেনাবাহিনীর স্থলাভিষিক্ত হবে। কাজেই সেনাবাহিনীর নেতৃত্বের ক্ষমতা ধরে রাখার একমাত্র পথ হলো সামরিক শাসন বজায় রাখা।