
ফ্রান্সজুড়ে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর নতুন পেনশন আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত
মে দিবসে ইউরোপজুড়ে শ্রমিক ইউনিয়নগুলো বিক্ষোভের আয়োজন করেছিল। বিশেষ করে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতির কারণে যারা অর্থনৈতিকভাবে বেশি চাপের মাঝে পড়েছে, তারাই বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে। জার্মান ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন (ডিজিবি) জানিয়েছে, তাদের আয়োজিত ৩৯৮টি বিক্ষোভ মিছিলে ২ লাখ ৮৮ হাজার মানুষ যোগ দিয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা, বিমান পরিবহন, সড়ক পরিবহন, রেলওয়ে, ডাক বিভাগ, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ছাড়াও বিভিন্ন সেক্টরের শ্রমিকরা এ বছরে জার্মানিতে ন্যায্য পারিশ্রমিক ও কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন সুবিধা বৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘট পালন করেছে। বার্লিনে এক মিছিলে জার্মান শিল্পভিত্তিক ট্রেড ইউনিয়ন আইজি মেটালের নেতা জোর্গ হফমান ঘোষণা দেন, তারা ধর্মঘট করার অধিকারের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ সহ্য করবেন না।
তবে ফ্রান্সের সড়কগুলো ছিল সবচেয়ে উত্তপ্ত। ফ্রান্সজুড়ে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর নতুন পেনশন আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে। অবসরের বয়স ৬২ বছর থেকে বাড়িয়ে ৬৪ বছর করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ফরাসি শ্রমিক ইউনিয়নগুলো ৩শর বেশি মিছিলের ডাক দিয়েছিল। দিন যত গড়িয়েছে, বিক্ষোভগুলো ক্রমেই সহিংস এবং পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের সংঘর্ষ হয়েছে। ফরাসি বার্তা সংস্থা ‘এএফপি’ বলেছে, বিক্ষোভকারীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়েছে এবং রাস্তার পাশের বিভিন্ন দোকানপাট ও ব্যাংকের জানালা ভাঙচুর করেছে।
ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেরাল্ড ডারমেনিন বলেন, সহিংসতায় ১০৮ জন পুলিশ আহত হয়েছে এবং দেশজুড়ে ২৯১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ৮ লক্ষাধিক মানুষ এই বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিল। বার্তা সংস্থা এপি জানিয়েছে, একদিকে শ্রমিকরা বলছে, সরকারের নতুন আইনে তাদের অধিকার খর্ব হচ্ছে, অন্যদিকে সরকার বলছে, দেশের অর্থনীতি বাঁচাতে এটা প্রয়োজন; কারণ ফ্রান্সের জনগণের গড় বয়স বেড়ে যাচ্ছে। এবারে বামপন্থিদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল সাধারণ জনগণ; যারা অর্থনৈতিক সুবিচার চায় এবং প্রেসিডেন্টের ব্যবসায়ীবান্ধব নীতির বিরোধী।
এদিকে ইতালিতে ডানপন্থি সরকার কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি হবে-এই লক্ষ্য নিয়ে দরিদ্রদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কমিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি এক বিবৃতিতে বলেন, চার বছর আগে চালু করা দরিদ্রদের সুরক্ষা আইনে পরিবর্তন আনা হয়েছে; যাতে করে কারা কাজ করতে পারে, আর কারা কাজ করতে পারে না, তাদের মাঝে আলাদা করা যায়। অর্থাৎ যাদেরকে এই সুবিধা দেওয়া হবে, তাদের সংখ্যা কমিয়ে আনা হচ্ছে।
ইতালির বিরোধী দলগুলো ক্ষমতাসীনদের সামাজিক সুরক্ষা কমিয়ে ফেলার নীতির ব্যাপক সমালোচনা করছে। স্পেনের শ্রমিক ইউনিয়নগুলো ৭০টির বেশি মিছিলের আয়োজন করে; যেখানে বলা হয়, মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকদের বেতন না বাড়লে সামাজিক দ্বন্দ্ব তৈরি হবে। মাদ্রিদের ইলাসট্রিয়াস কলেজ অব লইয়ার্সের আইনজীবীরাও বিক্ষোভ করেন। তাদের দাবি ছিল ছুটির। স্পেনের আইন অনুযায়ী একজন আইনজীবীকে বছরে ৩৬৫ দিনই কাজের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। এমনকি তাদের কাছের কোনো ব্যক্তির মৃত্যুও হয়, অথবা তারা নিজেরা যদি অসুস্থও হন, তাহলেও তাদেরকে কাজ করতে হয়।
গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে হাজারো শ্রমিক বিক্ষোভ করেছে। মূলত বামপন্থি সংগঠনগুলোর আয়োজন করা এই বিক্ষোভে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতির মাঝে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান রক্ষা করার কষ্টটাকেই তুলে ধরা হয়। একই দিনে গ্রিসে রেল শ্রমিক, জাহাজ ও বন্দর শ্রমিকরা ধর্মঘট করে। মেসিডোনিয়ায় মন্ত্রীদের বেতন ৭৮ শতাংশ বৃদ্ধি করার প্রতিবাদে বিক্ষোভ হয়েছে। সে দেশে শ্রমিকদের বেতন সাড়ে ৩শ ডলার হলেও মন্ত্রীদের বর্তমান বেতন বাড়িয়ে ২ হাজার ৫৩০ ডলার করা হয়েছে।
ইউরোপের বিক্ষোভগুলো যে বিশ্বব্যবস্থার সমস্যা, তা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রধানের বক্তব্যতেই পরিষ্কার হয়ে যায়। আইএলওর ডিরেক্টর জেনারেল গিলবার্ট হুংবো মে দিবস উপলক্ষে এক বার্তায় বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করা, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও জলবায়ুগত নীতিতে পরিবর্তন আনার আহ্বান জানান; যাতে সকলের অধিকার নিশ্চিত করা যায়। তিনি হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, করোনা মহামারির সময়ে শ্রমিকদেরকে যেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের সত্যিকারের বেতন কমে গেছে, দারিদ্র্য বেড়ে যাচ্ছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য আগের চেয়েও আরও মারাত্মকভাবে জেঁকে বসেছে।
আইএলও প্রধান মনে করিয়ে দেন, ১৯৪৪ সালে আইএলও প্রতিষ্ঠার সময়ে বলা হয়েছিল, বিশ্ব অর্থনীতি শুধু প্রবৃদ্ধি ও কিছু পরিসংখ্যান টার্গেটের পেছনেই ছুটবে না; বরং সেখানে মানুষের চাহিদা ও ইচ্ছাকে প্রধান্য দেবে। বৈষম্য ও দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সামাজিক সুরক্ষা বৃদ্ধিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল; বিশেষ করে জনগণের জন্য এমন ধরনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, যাতে তারা নিজেদের দায়িত্ব নিজেরাই নিতে পারে।
কিন্তু তিনি হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, এখনো নীতির ঘুরপাকেই পড়ে থাকতে হচ্ছে; যেখানে বৈষম্য ও অস্থিরতাই স্বাভাবিক। আইএলও প্রধানের হতাশাগুলো ইউরোপের লিবারাল পুঁজিবাদী দেশগুলোর রাস্তায় শ্রমিক বিক্ষোভের মাঝেই প্রতিফলিত হচ্ছে। ন্যায্য বেতন, জীবনযাত্রার মান, ছুটি ইস্যুতে শ্রমিকদের বিক্ষোভ দেখিয়ে দেয় যে, ইউরোপের উন্নত দেশগুলো শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতে যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা রক্ষা করতে মোটেই মনোযোগী হয়নি।