চীনের সঙ্গে সম্পর্কের বিরোধ মেটাতে সচেষ্ট যুক্তরাষ্ট্র

জাফর খান
প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০২৩, ১৫:০৯

চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ছবি: সংগৃহীত
চীন ও যুক্তরাষ্ট্র- দুই দেশ ভৌগোলিক দিক থেকে যেমন বিশ্বের দুই প্রান্তে অবস্থিত, অনুরূপ রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের দিক হতেও যেন একে অপরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া দুই দেশের নীতি নির্ধারকদের রক্তের মধ্যেই মিশে রয়েছে। আর উভয় দেশ বিশ্বকর্তৃত্বে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে চিরায়ত নানামুখী অহিতকর সিদ্ধান্ত নিতেও বেশ পটু।
সম্প্রতি মার্কিন আকাশে চীনের গোয়েন্দা বেলুন ওড়ানোর ঘটনাটি অনেকটা আগুনে ঘি ঢালার মতোই। বহু যুগ ধরে চলে আসা দুই দেশের উত্তেজনা নিরসনে অন্য কারও দূতিয়ালিও এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো ফল বয়ে আনতে সক্ষম হয়নি। অথচ একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর অবিসংবাদিত নেতৃত্ব নিয়ে বিশ্ব মোড়লের তালিকায় নাম আসে যুক্তরাষ্ট্রের। সেই সময় পেরিয়ে এই সময়ে এসে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমৃদ্ধ অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রযুক্তি ও নানা দক্ষতার আঙ্গিকে চীনের কাছে সবাই বাঁধা। যুক্তরাষ্ট্র যেমন পশ্চিমা ও মধ্যপ্রাচ্যের কর্তৃত্বগিরির একটি ধাপ শেষ করে দক্ষিণ এশিয়া, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দিকে ঝুঁকতে চাইছে, তেমনি চীনও চাইছে না এত সহজেই এ অঞ্চলে মার্কিন আধিপত্যের বীজ বপন হোক। উল্টো চলমান ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার প্রতি নীরব সমর্থন, মধ্যপ্রাচ্যের প্রতি অগ্রসরমাণ ভূমিকার মধ্য দিয়ে চীন এখন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্র জোটদের জন্য।
অতীতের দিকে তাকাই। ১৯৬৪ সালের অক্টোবরে প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর পর যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নতুন দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় চীন। এরপর থেকেই পর্যায়ক্রমে ১৯৬৯ সালের সাইনো-সোভিয়েত সীমান্ত ইস্যু, ১৯৭১ সালের পিং পং কূটনীতিসহ অনেক ইস্যুতে মার্কিন প্রশাসনের কপালে চিন্তার বলিরেখা দেখা যায়। আর সেটি কিছুটা বুঝতে ১৯৭২ সালে চীনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সফর ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৯৮২ সালে রোনাল্ড রিগ্যান কিছুটা স্বস্তির পথ তৈরি করলেও ১৯৮৯ সালের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে গণতন্ত্রকামীদের ওপরে সেনা হামলায় কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর যুক্তরাষ্ট্র দেশটির সঙ্গে সব ধরনের সমরাস্ত্র বিক্রির চুক্তি বাতিল করে। আর সেখান থেকেই শুরু প্রকাশ্য বিরোধ। এখন অবধি সেই ধারাবাহিকতায় চলছে দুই দেশের কুটনৈতিক সম্পর্ক।
ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটাতে গত মাসের মাঝামাঝি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন চীন সফরে গিয়েছিলেন। পরিস্থিতির চাপে দুই দেশের মধ্যে যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হয়েছে তা এড়িয়ে আরও ভালো যোগাযোগ স্থাপনের জন্য মূলত বেইজিং যান তিনি। আর এটি ছিল মার্কিন প্রশাসনের পাঁচ বছর পর নেওয়া একটি পদক্ষেপ। তবে তাইওয়ান ইস্যুতে পাল্টাপাল্টি বিবৃতি ও নানা সাংঘর্ষিক পদক্ষেপে তারা একে অপরের মুখ দেখাই বন্ধ করে দেয়।
সফরের আগে অবশ্য ব্লিংকেন বলেছিলেন, চীন সফরের প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে- উন্মুক্ত ও ক্ষমতায়িত যোগাযোগ স্থাপন, যাতে উভয় দেশ দায়িত্বের সঙ্গে সম্পর্ক পরিচালনা করতে পারে। দ্বিতীয় লক্ষ্য- মার্কিন স্বার্থ ও মূল্যবোধ স্পষ্ট করার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, মাদক চোরাচালানের বিরুদ্ধে লড়াই এবং জলবায়ু ও স্বাস্থ্য সমস্যাসহ বিশ্বকে প্রভাবিত করে সম্ভাব্য সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। সফরে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিন গ্যাং, শীর্ষ কূটনীতিক ওয়াং ই এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন ব্লিংকেন। ব্লিংকেনের সঙ্গে বৈঠকের সময় ইয়াং চারটি দাবি তুলে ধরেন। ১. যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই ‘চীন থেকে আসা হুমকি তত্ত্ব’ ছড়ানো বন্ধ করতে হবে। ২. চীনের বিরুদ্ধে দেওয়া একপক্ষীয় নিষেধাজ্ঞা বাতিল। ৩. চীনের প্রযুক্তিগত বিকাশ রুদ্ধ করার কর্মকা- বন্ধ এবং ৪. চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলানো।
তবে ডিফেন্স টাইমসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়, ইয়াংয়ের চারটি দাবিই নাকচ করে দেন ব্লিংকেন। চীনের বিশ্লেষকরা বলেন, প্রযুক্তি নিষেধাজ্ঞা ও তাইওয়ান ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থান খুব তাড়াতাড়ি শিথিল করবে, সেটা ভাবা ঠিক হবে না। চীনের আরেক বিশ্লেষক ইয়ান ঝো এক নিবন্ধে লিখেছেন, টেসলা, জেপি মর্গান, মাইক্রোসফটের শীর্ষ নির্বাহীরাও চীন সফর করেছেন। তাদের এ সফর চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক সংঘাতের মাত্রা প্রশমনের ক্ষেত্র তৈরি করা। সফর শেষে ব্লিংকেন সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, দুই পক্ষই চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ফেন্টাইল জাতীয় রাসায়নিক পণ্য রপ্তানির ব্যাপারে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ প্রতিষ্ঠায় সম্মত হয়েছে। এছাড়াও দীর্ঘ মেয়াদে কৃষ্ণসাগর খাদ্য চুক্তিতে সহায়তা করে বিশ্ব খাদ্য সঙ্কটের ঝুঁকি এড়াতে চীন সহযোগিতা করবে।
দেশ দুটির মধ্যে সম্পর্ক পুনর্গঠন প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ৬ জুলাই চার দিনের বেইজিং সফরে যান মার্কিন অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন। ব্লিংকেনের সফরের পর এখন দ্বিতীয় কোনো জ্যেষ্ঠ মার্কিন কর্মকর্তা হিসেবে ইয়েলেন চীন সফরে গেলেন। তার এই সফর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্থিতিশীল করার প্রচেষ্টায় এক ধাপ অগ্রগামী পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করেন ইয়েলেন। তিনি চীনের সঙ্গে তার আলোচনাকে সরাসরি, বাস্তবসম্মত এবং ফলপ্রসূ বলে বর্ণনা করে বলেন, আলোচনা থেকে দুপক্ষই একে অপরের সম্পর্কে বেশিকিছু শিখেছে। তবে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রর মধ্যে এখনো গুরুতর কিছু মতবিরোধ আছে বলেও তিনি স্বীকার করেন।
মানবাধিকার, বাণিজ্য, তাইওয়ান ও দক্ষিণ চীন সাগরে বেইজিংয়ের আধিপত্যসহ নানা বিষয় নিয়েই চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কয়েক বছর ধরে অবনতির দিকে গেছে। এই সম্পর্ক মেরামতের চেষ্টা নিয়েই বেইজিংয়ে যান মার্কিন অর্থমন্ত্রী। তবে সেখানে গিয়েও বেইজিংয়ের সমালোচনা করেন তিনি। যদিও মার্কিন অর্থমন্ত্রীর সফর থেকে নতুন কোনো যৌথ ঘোষণা আসেনি। তবে ইয়েলেন মনে করেন, কিছু বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে এবং আমরা একটি সুস্থ অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারি। এছাড়া বাইডেন প্রশাসন যে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের বিরোধ মেটাতে সচেষ্ট, তার সর্বশেষ উদাহরণ এই সফর। আর চলতি মাসেই বাইডেনের জলবায়ু বিষয়ক দূত জন কেরি চীন সফর করবেন।
আগামী সেপ্টেম্বরে ভারতে অনুষ্ঠেয় জি-২০ সম্মেলন অথবা নভেম্বরে সানফ্রান্সিসকোতে এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কো-অপারেশন (অ্যাপেক) সম্মেলনে বাইডেন ও জিনপিংয়ের বৈঠক হতে পারে। এ লক্ষ্যে বেইজিংয়ের সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে ওয়াশিংটন।