নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রের আধুনিক মডেল কম্বোডিয়া

স্বর্ণা চৌধুরী
প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০২৩, ১২:১২

কম্বোডিয়ায় স্বৈরতন্ত্রের দ্বিতীয় প্রজন্ম হুন মানেট। ছবি: সংগৃহীত
২০২৩ সালে কে কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন, তা কার্যত ২০২১ সালেই নিশ্চিত করে দেওয়া হয়েছিল। ৩৮ বছর দেশটির ক্ষমতা ধরে রাখার পর ২০২৩ সালে নতুন নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা ছাড়ার ব্যাপারে আগে থেকেই পরিকল্পনা করেছিলেন সদ্যসাবেক প্রধানমন্ত্রী হুন সেন। আর পরবর্তী নেতাও বাইরের কেউ নন, তার ছেলে হুন মানেট। তবে ছেলেকে নেতৃত্ব শেখাতে এখনই সব ছেড়ে দিচ্ছেন না। আপাতত প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে থাকবেন। একই সঙ্গে দলীয় প্রধানের পদও হুন সেনের হাতেই থাকছে।
কম্বোডিয়ার শক্তিশালী প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উত্তরসূরি কে হতে চলেছেন, বছরের পর বছর ধরে তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা ছিল। ২০২১ সালের ২৪ ডিসেম্বর হুন সেন তার দল কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টির (সিপিপি) একটি সভায় তার বড় ছেলে হুন মানেটকে ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সামনে তুলে ধরেন। সেখানে সর্বসম্মতভাবে হুন মানেট নির্বাচিত হন। ছেলের বয়স এখন ৪৫, আর বাবার বয়স ৭০। তাদের দল ১৯৭৯ সাল থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এ দেশটি শাসন করছে। এশিয়ার অন্য অনেক দেশের মতো কম্বোডিয়ায়ও নির্বাচনের মান যাচ্ছেতাই। তবে গত ২৩ জুলাই অনুষ্ঠিত নির্বাচন একটি মাইলফলক। যেখানে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কোনো কারচুপি ছাড়াও যে একটি স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ধাবিত হতে পারে, তা নিশ্চিত করা যায়। ১৭টি মেরুদ-হীন, দুর্বল ও অনুগত বিরোধী দলের বিপরীতে নির্বাচন করে তাই হুন সেনের দল খুব সহজেই গর্ব করে বলতে পারে- তারা ‘নিরঙ্কুশ জয়’ পেয়েছে। সিপিপি নির্বাচনী দৌড়ে একাই লড়েছে, একাই নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করেছে। বিগত তিন দশক ধরে গণতন্ত্রকে সংকুচিত করে, প্রতিপক্ষকে নিপীড়ন-নির্যাতনের জাঁতাকলে পিষ্ট করে প্রধানমন্ত্রী হুন সেন দৃশ্যত বিরোধী দলকে প্রতিযোগিতার বাইরে ঠেলে দিয়েছেন। ফলে নির্বাচনে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করতে হয়নি।
দুই মাস আগে প্রধান বিরোধী দল ক্যান্ডেল লাইট পার্টিকে নিবন্ধন সংক্রান্ত কাগজপত্রের ঘাটতি দেখিয়ে, আইনের কৌশলে নিষিদ্ধ করে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য করে তোলে। অর্থাৎ ক্যান্ডেল লাইট পার্টির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। গত বছর স্থানীয় নির্বাচনে যারা সরকারের প্রচণ্ড ভয়-ভীতি প্রদর্শন, ভোট জালিয়াতি, হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করেও ২২ শতাংশ ভোট পায়। তাদেরকেই নিষিদ্ধ ও অবৈধ ঘোষণা করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। পুরো নির্বাচনটি নিপীড়িত নাগরিকদের ওপর রাজনৈতিক বাস্তবতা চাপিয়ে দেওয়ার কৌশল। এটা হুন সেনের বিশাল আত্মবিশ্বাসের প্রদর্শনী ছাড়া আর কিছু নয়। নির্বাচন প্রক্রিয়াটি জনগণের সম্মতি ছাড়াই প্রণয়ন করা হয়েছিল এবং তাদের অনুমোদন ছাড়াই প্রয়োগ করা হয়েছিল।
এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি ‘নির্বাচিত স্বৈরশাসক’ হুন সেন ১৯৮৫ সাল থেকে ক্ষমতা ধরে রেখেছেন। ফ্যাসিবাদ-নাৎসিবাদকে যেভাবে চিহ্নিত করা যায় কম্বোডিয়ার ‘নির্বাচিত স্বৈরাচার’ও একটা ভিন্ন মডেল। বিরোধী দলের ওপর জেল, জুলুম, মামলা, কারণে-অকারণে গ্রেপ্তার ও কঠোর ব্যবস্থা প্রয়োগ, সামরিক বাহিনী, পুলিশসহ রাষ্ট্রের প্রশাসনকে হাতের মুঠোয় রেখে হুন সেন অপকীর্তির ওপর নির্ভর করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করছেন। এমনকি দেশের আদালতকেও ব্যবহার করছেন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে। এর ধারাবাহিকতায় এবারের নির্বাচনেও কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টি ১২৫ আসনের পার্লামেন্টে জিতেছে ১২০ আসনে আর সরকারের পাতানো বিরোধী দল ফানসিনপেক পার্টি পেয়েছে পাঁচটি আসন।
গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক লি মরগেনবেসার দি কনভারসেশন ম্যাগাজিনে হুন সেনের স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে লিখেছেন, ক্যামেরুনে পল বিয়া, ইরাকে সাদ্দাম হোসেন এবং উগান্ডার ইদি আমিনের মতো অন্যান্য শক্তিশালী ব্যক্তির দেখানো পথ অনুসরণ করে হুন সেন প্রথম যে কাজটি করেন তা হলো ক্ষমতার ব্যক্তিগতকরণ। চার দশকজুড়ে কর্তৃত্ববাদ তার কর্মের মধ্যে ছিল। সেই প্রক্রিয়ার একজন দারোয়ান হিসেবে কাজ করা, যার মাধ্যমে লোকেরা উচ্চ পদে নিযুক্ত হয়; দল, সামরিক বাহিনী ও সরকারের উচ্চ পর্যায়ের পদে আত্মীয়দের নিয়োগদান; রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ এবং সামরিক কমান্ডের সাধারণ চেইনের বাইরে নিজস্ব আধা-সামরিক গোষ্ঠী তৈরি; ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ আরোপের পাশাপাশি এর কার্যনির্বাহী কমিটিতে কে ঢুকবে এবং কে তা থেকে বেরিয়ে যাবে তা নিয়ন্ত্রণ করা। ২০০৫ সাল নাগাদ কম্বোডিয়ার রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কর্মী নিয়োগ নীতি এবং হালুয়া-রুটি বিতরণ বিষয়ে হুন সেন বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হন। দ্বিতীয় যে কাজটি তিনি করেছেন তা হলো- কম্বোডিয়ায় কঠোর একনায়কত্ব প্রবর্তন। যার ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটি একটি সত্যিকারের একদলীয় রাষ্ট্রে রূপান্তর হয়।
২০১৫ সালের জুলাই মাসে সরকার একটা বিল পাসের মাধ্যমে সুশীল সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আইনের মাধ্যমে তাদের ক্রিয়াকলাপ সীমিত করতে তহবিল, প্রতিবেদন, নিবন্ধন এবং রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বিষয়ে অত্যাশ্চর্য সম্মতি নেওয়ার চেষ্টা চলে। ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট ক্ষমতাসীন দলের একমাত্র শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী কম্বোডিয়া ন্যাশনাল রেসকিউ পার্টিকে বিলুপ্ত করে। দলটির বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান চেষ্টার অভিযোগ তোলা হয়। আর এটি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই উঠেছে। এরপর নমপেন একতরফাভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক মহড়া দেওয়া থেকে সরে আসে এবং সে বছরই তারা চীনের সঙ্গে সামরিক মহড়া দেওয়া শুরু করে। হুন সেন পুরোমাত্রায় চীনের বলয়ে ঢুকে পড়ে এবং বর্তমানে চীন তাদের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। কম্বোডিয়ায় নতুন এক্সপ্রেসওয়ে ও বন্দর তৈরিতে চীন শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। কম্বোডিয়ার দক্ষিণ উপকূলে একটি নৌঘাঁটি নির্মিত হচ্ছে। সেখানে চীনের সেনা মোতায়েন অনুমোদন দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র হুন সেনের ওপর চটে আছে।
সর্বশেষ নির্বাচনকে যুক্তরাষ্ট্র ‘না অবাধ, না সুষ্ঠু’ নির্বাচন বলে উল্লেখ করেছে। নির্বাচনে অনিয়মের কারণে যুক্তরাষ্ট্র কম্বোডিয়ার নেতাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলেও বেশির ভাগ পশ্চিমা দেশ কম্বোডিয়া থেকে মালামাল আমদানি অব্যাহত রেখেছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্র কম্বোডিয়াকে চাপে রেখে ওয়াশিংটনের আজ্ঞাবহ রাখতে চায় ও বেইজিংয়ের বলয় থেকে নমপেনকে বের করে আনতে চায়। এ ক্ষেত্রে হুন সেন বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেন; কারণ প্রধানমন্ত্রীর গদি থেকে সরে গেলেও তিনি ক্ষমতাসীন দল সিপিপির সভাপতি থাকছেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে হুন মানেট অনভিজ্ঞ হওয়ায় তার পরামর্শক হিসেবেও তিনি কাজ করবেন। সে ক্ষেত্রে কম্বোডিয়ার শিগগিরই চীনপন্থি নীতি থেকে সরে আসার সম্ভাবনা কম বলেও অনেকে মনে করছেন।
রাজনৈতিক বিরোধীরা এখন নির্বাসনে; মিডিয়া ক্ষমতাসীনদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণে; সুশীল সমাজের সংগঠনগুলো ক্ষমতাহীন; গণবিক্ষোভ দমিত এবং নাগরিকদের রাজনৈতিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতা নির্বিচারে খর্বিত। অতএব হুন মানেটের জন্য হুন সেনের উত্তরাধিকারী বা দ্বিতীয় প্রজন্মের ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্রী’ হওয়ার পথ এখন পরিষ্কার। ভবিষ্যতে এই কম্বোডিয়া মডেল অন্যান্য দেশও গ্রহণ করতে পারে। কম্বোডিয়া আজকের বিশ্ব ব্যবস্থায় কর্তৃত্ববাদী আদর্শের এক মডেলে রূপান্তর হয়েছে। হুন সেন সর্বশেষ প্রহসনমূলক ও জালিয়াতিপূর্ণ একটি সাধারণ নির্বাচন সম্পন্ন করেছেন। নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র অব্যাহত থাকায় বিশ্ব রাজনীতির চাপের মুখে পড়েছে দেশটি। তবে সেই চাপ এতটাও শক্তিশালী নয় যে, এখান থেকে শুধু বাহ্যিক চাপে কোনো পরিবর্তন সম্ভব। রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুণ্ঠনে কম্বোডিয়ার সংকটের গভীরতা ও ব্যাপ্তি আমাদের চিন্তাকেও ছাপিয়ে যেতে পারে।