Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

কোভিড-১৯

প্রতিষেধক আবিষ্কারে রেকর্ড গতিতে চলছে গবেষণা

Icon

এ আর সুমন

প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২০, ২২:০৮

প্রতিষেধক আবিষ্কারে রেকর্ড গতিতে চলছে গবেষণা

করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) আতঙ্কে স্থবির হয়ে পড়েছে বিশ্ব। পুরোপুরি অবরুদ্ধ বিভিন্ন দেশের জনগণ। উন্নত, অনুন্নত কোনো দেশই এই ছোবল থেকে মুক্তি পাচ্ছে না। মৃত্যুর সংখ্যা ইতোমধ্যে যেমন ৩৩ হাজার ছাড়িয়েছে, তেমনি বিশ্বজুড়ে আক্রান্তের খাতাটাও বেশ দীর্ঘ। সাত লাখেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। প্রাণহানির সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে ইতালিসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশে কোভিড-১৯ ভয়াবহ রূপ নেয়ার পর থেকেই তা প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। এ মহামারি নিয়ে একের পর এক আসছে নতুন তথ্য। গবেষণা চলছে রোগটির ভ্যাকসিন আবিষ্কারে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ঘুম হারাম করে দিয়েছে মেডিকেল সায়েন্সের সবচেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ এই ভাইরাস চ্যাপ্টারটি।

সম্প্রতি বলা হয়েছিল, কৃত্রিমভাবে এ ভাইরাস তৈরি করা হয়েছে। তবে সেই গবেষণাকে ভুল দাবি করে নতুন গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। করোনাভাইরাস নিয়ে একটি নতুন গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে নেচার মেডিসিন পত্রিকায়। কোভিড-১৯ ও তার সম্পর্কিত ভাইরাসগুলোর জিনের গঠন সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকরা। বিজ্ঞানিদের দাবি, স্বাভাবিক বিবর্তনের ফলেই এগুলো তৈরি হয়েছে। কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়নি। এই ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির জন্য এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। কবে মিলবে এই ভ্যাকসিন? পৃথিবীতে যে কোনো রোগের ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়ে থাকে। অতীতে এমনটাই দেখা গেছে। কিছু ক্ষেত্রে লেগে গেছে দশকের পর দশক। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার সংশ্লিষ্ট সব দেশ ও সংস্থা খুব ত্বরিৎ পদক্ষেপ নিয়েছে। বর্তমানে বেশ কিছু সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান ভ্যাকসিন তৈরিতে শ্রম দিচ্ছে।

এর মধ্যে জনসন অ্যান্ড জনসন জানায়, ৮ থেকে ১২ মাসের মধ্যে এমন ভ্যাকসিন তারা তৈরি করতে পারবে। চীনভিত্তিক ক্লোভার বায়োফার্মাসিউটিক্যালস বলছে, অচিরেই তারা একটি ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক ব্যবহার শুরু করতে চায়। অন্যদিকে, নোভাভ্যাক্স ও ইনোভিও ফার্মাসিউটিক্যালস নিশ্চিত করেছে যে, করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরিতে তারা কাজ শুরু করেছে। তবে বিশেষজ্ঞদের দাবি, নতুন ভ্যাকসিন তৈরি হয়ে গেলেও, তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিরূপণের জন্য আলাদাভাবে গবেষণার প্রয়োজন হবে।

এই পরিস্থিতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে, করোনাভাইরাস ঠেকাতে সব মিলিয়ে কমপক্ষে ২০টি ভ্যাকসিন তৈরির কাজ চলছে। এসব প্রকল্পের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখছে ডব্লিউএইচও। আশা করা হচ্ছে, দ্রুততম সময়ের মধ্যেই আবিষ্কৃত হবে কোভিড-১৯ প্রতিরোধের ভ্যাকসিন। এরই মধ্যে কিছু ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগও শুরু হয়ে গেছে। যা এক ধরনের রেকর্ড। এত কম সময়ে আগে কখনো কোনো রোগের ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু করা যায়নি। করোনাভাইরাসের জিন সিকোয়েন্স তৈরির মাত্র ৬০ দিনের মাথায় এসব ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হয়েছে। 

ডব্লিউএইচওর জরুরি কর্মসূচির টেকনিক্যাল প্রধান মারিয়া ভ্যান কেরখোভে জানিয়েছেন, ‘এই প্রক্রিয়াটি খুব দ্রুত ও নাটকীয়ভাবে এগোচ্ছে। আমাদের যতটুকু সামর্থ্য, তার চেয়েও দ্রুত এগোতে পারছি আমরা। সার্স ও মার্স যখন ছড়িয়েছিল, ওই সময় থেকেই করোনাভাইরাস নিয়ে কাজ শুরু হয়েছিল। সেই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই আমরা এগিয়ে চলেছি। আগের গবেষণা নতুন ভাইরাসের ক্ষেত্রে কাজে লাগছে।’ তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিও বলে দিয়েছে- জনসাধারণের ব্যবহারের উপযোগী ওষুধ বানাতে আরো অনেক পথ পার হতে হবে। পরীক্ষামূলক প্রয়োগ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য গবেষণা শেষে একটি নিরাপদ ওষুধ তৈরি করতে ১৮ মাস পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরি কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক মাইক রায়ান বলেন, ‘পরীক্ষামূলক প্রয়োগের বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি। কারণ একটি খারাপ ভাইরাসের তুলনায় একটি খারাপ ভ্যাকসিন বেশি অপকারী।’

তবে তিনি স্বীকার করেছেন যে, এটি কখনোই সম্ভব হতো না, যদি না চীনসহ বিভিন্ন দেশ করোনাভাইরাসের জেনেটিক সিকোয়েন্স অন্যান্য দেশকে না জানাত। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে মাইক রায়ান বলেন, ‘পৃথিবীর পুরো জনগোষ্ঠীর জন্য একটি উপযোগী ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রে অনেক সাবধানী পদক্ষেপ নিতে হয়। যদি একটি ভ্যাকসিন তৈরি করাও যায়, তখন আরো অনেক অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক বাধার মুখোমুখি হতে হবে। কারণ করোনাভাইরাস ঠেকাতে হলে বিশ্বের সব মানুষকে এই ভ্যাকসিন দিতে হবে। শত শত কোটি মানুষের জন্য বিপুল পরিমাণে এই ভ্যাকসিন তৈরি করা একটি বিশাল চ্যালেঞ্জ।’

ভাইরাসটির জীবনের নকশাটি বের করার পর ভ্যাকসিন তৈরির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগার থেকে শুরু করে, বিভিন্ন ওষুধ এবং বায়োটেক কোম্পানি নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের এক দল গবেষক এই নতুন ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের আকৃতি কিছুদিন আগে সায়েন্স জার্নালে প্রকাশ করেছে। এর মাধ্যমে স্পাইক প্রোটিনের সঙ্গে অ্যান্টিবডি যুক্ত হওয়ার ব্যাপারটা আরো নিখুঁতভাবে জানা যাবে।

মডার্না থেরাপিউটিকস নামে একটি ইউএসভিত্তিক কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের সঙ্গে একত্রে কাজ করছে একটি নতুন ভ্যাকসিনের ব্যাপারে। তারা ভাইরাসের মেসেঞ্জার আরএনএ নামক একটি জেনেটিক বস্তু তৈরি করেছে। এই ভাইরাসের আরএনএ শরীরে প্রবেশ করালে এটা কোষে ভাইরাসের উপরিভাগে উপস্থিত স্পাইক প্রোটিনের একটি অংশ তৈরি করবে। শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যে কোনো ধরনের বাইরের বস্তু আমাদের শরীরে প্রবেশ করলে তা বুঝতে পারে এবং এটাকে মারার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রতিরক্ষা পদ্ধতি ব্যবহার করে। এই প্রোটিনটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রতিরক্ষা পদ্ধতি এটার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করবে। শরীরের এই মজুদ অ্যান্টিবডি পরবর্তী সময়ে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে সক্রিয় হবে। এ কোম্পানি সিয়াটলে বেশ কিছু সুস্থ ভলান্টিয়ার জোগাড় করেছে এটা প্রয়োগ করার জন্য।

কানাডায় অবস্থিত একটি বায়োটেক কোম্পানি মেডিকাগো, যা মিতসুবিশি তানাবি ফার্মা কোম্পানির সাবসিডিয়ারি। কোম্পানিটির দাবি, তারা করোনাভাইরাসের একটি ভাইরাস-লাইক-পার্টিকেল তৈরি করেছে। এদের সংক্ষেপে বলে ভিএলপি। এই ভিএলপি বিভিন্ন প্রোটিনের দ্বারা তৈরি এবং এদের আকার এবং গঠন মূল ভাইরাসের মতোই; কিন্তু এদের মধ্যে ভাইরাসের জেনেটিক বস্তু নেই। এই ভ্যাকসিনগুলো সফল হলে এটা নিরাপদ কি না, সেটা নিশ্চিত করার জন্য বেশ কিছু ধাপ পেরোতে হবে। গিলিয়াড সায়েন্স নামে একটি আমেরিকান বায়োটেকনোলজি কোম্পানির একটি অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ এখন ছোট আকারে কিছু রোগীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। এটার নাম রেমডেসিভির এবং বৈজ্ঞানিক ভাষায় যাকে বলে নিওক্লিওটাইড অ্যানালগ। এর একটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয়েছে চীনে। 

গত ১৬ মার্চ করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক মানবদেহে প্রথম পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সিয়াটলে অবস্থিত জাতীয় ইনস্টিটিউট অব হেলথে, প্রাথমিক অবস্থায় জেনিফার হ্যালার নামে এক নারীর দেহে প্রথমবার পরীক্ষা চালান চিকিৎসকরা। পর্যায়ক্রমে শারীরিকভাবে সুস্থ ৪৫ জন স্বেচ্ছাসেবীর শরীরে এটি প্রয়োগ করা হয়। এদিকে চীনের স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত রোগীদের জন্য জাপানে ব্যবহৃত এক ধরনের ওষুধ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে চীনে কার্যকর হয়েছে। চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ঝাং শিনমিন বলেছেন, জাপানের ফুজিফিল্ম কোম্পানির সহযোগী প্রতিষ্ঠান টয়ামা কেমিক্যাল ওই ওষুধটির উৎপাদনকারী। তাদের এই ওষুধটি উহান ও শেনজেন শহরে করোনায় সংক্রমিত ৩৪০ জন রোগীর ওপর প্রয়োগ করে আশাব্যঞ্জক ফল পাওয়া গেছে। 

ওষুধ আবিষ্কার করতে কাজ করছেন বাংলাদেশেরও একদল গবেষক। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভের (ইউডা) লাইভ সায়েন্স অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. রহমত উল্লাহ বলেন, ‘ড্রাইল্যাব বা কম্পিউটার গবেষণায় তিনটি যৌগিক উপাদান পাওয়া গেছে। যার মধ্যে অ্যাপিজেনিন, ভিটেক্সিন এবং আইসো ভিটেক্সিন নামের তিনটি উচ্চ মাত্রার যৌগিক উপাদান রয়েছে। যা নভেল করোনাভাইরাসের বিপরীতে কাজ করতে সক্ষম।’ ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়েও এই গবেষণাটি যথার্থ বলে প্রমাণিত হয়েছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫