Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

জি-২০ সম্মেলন: সংযত যুদ্ধবিরোধী যৌথ ঘোষণার ঊর্ধ্বে রাশিয়া

Icon

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৭:০৪

জি-২০ সম্মেলন: সংযত যুদ্ধবিরোধী যৌথ ঘোষণার ঊর্ধ্বে রাশিয়া

জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ছবি: এএফপি

ভারতের নয়াদিল্লিতে ৯ সেপ্টেম্বর দুদিনব্যাপী জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন শেষ হয়। সম্মেলন শেষে বিশ্ব নেতাদের যৌথ ঘোষণায় সম্মত হওয়াকে ভারতের বড় কূটনৈতিক অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে এ ঘোষণায় ইউক্রেনের প্রতি সমবেদনা থাকলেও নেতাদের রাশিয়ার প্রতি নিন্দা ছিল না। ইউক্রেন এ ঘোষণাকে ‘গর্ব করার মতো কিছু নয়’ বলে জানিয়েছে।

অন্যদিকে রাশিয়া স্বাগত জানিয়ে ঘোষণাটিকে ‘ভারসাম্যপূর্ণ’ বলে উল্লেখ করেছে। এর মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে রাশিয়া-চীন জোটের রাজনৈতিক-কূটনৈতিক প্রভাবের দেখাও মিলেছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন চীনের প্রতি আপসমূলক মনোভাব প্রদর্শনের ভান করছে। একের পর এক মার্কিন কর্মকর্তার সাম্প্রতিক বেইজিং সফর- জুন মাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি জে ব্লিংকেন, জুলাই মাসে অর্থমন্ত্রী ও জলবায়ুদূত জন কেরি এবং আগস্টে বাণিজ্যমন্ত্রী গিনা রাইমন্ডো তারই সাক্ষ্যবহ। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং উভয়েই বহু ঠেকে এটা শিখেছেন যে, বাইডেন ছলনাময়ী আচরণে আগে থেকেই পটু। রুদ্ধ দুয়ারে এক কথা বলেন; কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অভিনয় করেন প্রকাশ্যে এসে। কূটনীতির ক্ষেত্রে অভদ্র, এমনকি ব্যক্তি আক্রমণেও দ্বিধাহীন তিনি। ভারতের মাটিতে প্রতীকীভাবে হলেও যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার ‘পুনর্মিলন’ শুধু ওয়াশিংটনের সুবিধার জন্য কাজ করতে পারত। এর মাধ্যমে তিনি ইউক্রেন প্রশ্নে গোটা দক্ষিণার্ধ যেভাবে একাট্টা হয়ে আছে, তাতে ভাঙন ধরাতে ভারতকে স্বীয় বলয়ে নিতে পারতেন।

মস্কো ও বেইজিং বাইডেন প্রশাসনের তৈরি ফাঁদ সম্পর্কে খুবই সতর্ক। উভয়ের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে ভুল ধারণা জন্ম দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা চালাচ্ছে এবং তা এমন সময়ে, যখন পুতিন অক্টোবরে বেইজিং সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সফরটিকে জিনপিংয়ের গত মার্চে মস্কো সফরের ফিরতি সফর বলে বিবেচনা করা যেতে পারে, যেখানে মস্কো হয়তো চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যোগ দিতে পারে। পুরো বিষয়টি আমলে নিয়ে পুতিন ও জিনপিং জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে আসেননি, পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের পাঠিয়েছেন।

গত বছর বালি সম্মেলন থেকেই ইউক্রেন যুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল জি-২০-এর গলার কাঁটা। যুক্তরাষ্ট্রসহ জি-৭ গোষ্ঠীভুক্ত সদস্য দেশগুলোর দাবি ঘোষণাপত্রে ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য সরাসরি দায়ী করতে হবে রাশিয়াকে। এর বিরুদ্ধে এককাট্টা রাশিয়া ও চীন। দুই পক্ষের এই অনড় মনোভাবের কারণে বালি ঘোষণাপত্রের চরিত্র ছিল ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র মতো। সেই পরিস্থিতি এখনো অপরিবর্তিত। জি-৭ ও রাশিয়া-চীনের পরস্পরবিরোধী অবস্থানের জন্য ভারতের সভাপতিত্বে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের সম্মেলনে সর্বসম্মতভাবে কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করা যায়নি। দিল্লিতে শীর্ষ সম্মেলন ঘিরেও তাই সংশয়ের মেঘ ছেয়েছিল ঘোষণাপত্র নিয়ে। ঘোষণাপত্র গৃহীত না হলে সেটা হতো ভারতের নেতৃত্বের পক্ষে একটা বড় ধাক্কা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সব কুল রক্ষা করে সমাধান সূত্রের খোঁজ দিতে পারলেন ভারতীয় কূটনীতিকরা। রাশিয়াকে একঘরে হতে না দিয়ে ঘোষণাপত্র সর্বসম্মতভাবে গ্রহণের বিষয়টি ‘মিত্র’ ভারতের পক্ষে ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। ১৫০ ঘণ্টা ধরে কাটাছেঁড়ার পর এই ঘোষণাপত্রে সব সদস্য দেশ সম্মত হয়েছে। ভারতের কাছে এটা ছিল এক মস্ত চ্যালেঞ্জ, যেহেতু যুযুধান দুই শিবিরকে এক কাতারে দাঁড় করানো ছিল কঠিন ব্যাপার।

ঘোষণাপত্রের কয়েকটি অধ্যায় লেখা হয় নতুন করে, যেখানে পরিষ্কারভাবে বলা হয় পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রসঙ্গও ঘোষণাপত্রে বিস্তারে উল্লেখ করা হলো। কিন্তু রাশিয়ার নাম কোথাও কোনোভাবে উচ্চারণ করা হলো না। লেখা হয়েছে, কোনো দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত নয়। গায়ের জোরে ভৌগোলিক সীমানার পরিবর্তন নয়। ৩৭ পৃষ্ঠার ঘোষণাপত্রকে সর্বসম্মত করে তুলতে ‘পৃথিবী, জনগণ, শান্তি ও সমৃদ্ধি’ শীর্ষক অংশের চারটি অনুচ্ছেদ নতুন করে লিখতে হয়েছে। প্রতিটি শব্দ খুঁটিয়ে দেখে প্রতিটি দেশের কর্মকর্তারা তা অনুমোদন করেছেন। ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ও জনগণের দুর্দশার উল্লেখ করে ঘোষণাপত্রের দশম অনুচ্ছেদে লেখা হয়েছে, এই যুদ্ধ খাদ্য, শক্তি নিরাপত্তা, সরবরাহ শৃঙ্খল, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করেছে। মূল্যবৃদ্ধি গগনচুম্বী করে তুলেছে। প্রবৃদ্ধি নষ্ট করেছে। চরম সংকট সৃষ্টি করেছে কম উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোয়। কোভিডের ছোবল থেকে এসব দেশ এখনো মুক্ত হতে পারেনি।

রুশ আলোচক সভেতলানা লুকাশ নয়াদিল্লিতে সাংবাদিকদের বলেন, জি-২০ সম্মেলনের যৌথ ঘোষণাটি ‘ভারসাম্যপূর্ণ’ এবং মস্কো এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে। নয়াদিল্লির ঘোষণায় স্পষ্টভাবে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের নিন্দা করা হয়নি। তবে চীনের নীতিনির্ধারণী গবেষণা সংস্থা চায়না ইনস্টিটিউট অব কনটেম্পরারি ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন ভারতের সমালোচনা করেছে। তারা জানিয়েছে, ভারত তার নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য জি-২০ গ্রুপকে ব্যবহার করছে। চীনের স্বার্থের ক্ষতি করার দিকেই দিল্লির মনোযোগ। 

দিল্লি শীর্ষ সম্মেলনেই জি-২০-এর বহর বেড়েছে। স্থায়ী সদস্য হিসেবে যুক্ত হয়েছে আফ্রিকান ইউনিয়ন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘গ্লোবাল সাউথ’ ও আফ্রিকার স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে জোটে আনার যে প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে আসছিলেন, তা বাস্তবায়িত হলো। তবে আফ্রিকায় চীনের নিজস্ব আগ্রহ থাকায়, তা স্বার্থের সংঘাত সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে সম্মেলনে উপস্থিত না থেকেই আলোচনায় ছিলেন পুতিন-জিনপিং। জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে অনুপস্থিত থেকে জিনপিং হয়তো চীন-ভারত সীমান্তে চলমান উত্তেজনা নিয়ে এবং বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে দিল্লিকে ব্যবহারে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতার জবাব হিসেবে মোদিকে কড়া বার্তা দিতে চান। আবার চীনের অর্থনৈতিক সংকট এবং অভ্যন্তরীণ অসন্তোষের কারণে তিনি ঘর ছাড়ার ঝুঁকি নিচ্ছেন না- এমনটাও হতে পারে।

চীন যদি অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে তা সারা বিশ্বকে প্রভাবিত করবে। এমন পরিস্থিতিতে বিষয়টি নিয়ে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম এই অর্থনৈতিক জোটের নেতাদের আলোচনা করার যে সুযোগ ছিল, জিনপিং জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে না থাকায় তা হাতছাড়া হলো। এমন পরিস্থিতি বিশ্বের অর্থনৈতিক সংকট ত্বরান্বিত করতে পারে। এ বিষয়ে ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাংক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের বিশ্লেষক ড. ব্রুস জোনস বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বা বিশ্বব্যাংকের বিপরীতে জি-২০-এর মতো একটি গোষ্ঠীর মূল সক্ষমতা সত্যিকার অর্থে সদস্য দেশগুলোর প্রধানদের ওপর নির্ভরশীল। জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের মতো বহুপক্ষীয় আয়োজনের মূল কাজ হয় মূলত দ্বিপক্ষীয় ও ব্যক্তিগত বৈঠকগুলোতে। তাই কোনো নেতা এখানে উপস্থিত না থাকলে বিষয়গুলোর কোনোটিই অর্জন করতে পারবেন না।’

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট সাধারণত জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে উপস্থিত থাকেন। এবার তিনি উপস্থিত না থাকায় ইউক্রেন সংকটে বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকট ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে সবচেয়ে জরুরি আলোচনার সুযোগ বন্ধ হলো। তবে পুতিন কেন ভারতের জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন নেই সেটাই বড় প্রশ্ন। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দহরম-মহরম বেশি হলেও রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক মোটেও খারাপ নয়। তাছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কারণে তার বিদেশে না যাওয়ার বিষয়টিও এখানে প্রযোজ্য নয়। কারণ ভারত এ আদালতের সদস্য না হওয়ায় পরোয়ানা বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক নয়।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫