
এশিয়ান গেমসের মাসকট। ছবি: সংগৃহীত
করোনা মহামারির কারণে এবারের এশিয়ান গেমস অনুষ্ঠিত হলো এক বছর পর। সেখানে অংশগ্রহণ করছে ৪৫টি দেশ থেকে আসা প্রায় ১২ হাজার খেলোয়াড়। আসরে থাকছে ৪০টি খেলা। আর সেদিকে নজর রেখে চীনের উদ্যোক্তারা নিজেদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করছে। প্রযুক্তি, খাদ্য, শিল্পোৎপাদন ও বিনোদন খাতে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য তুলে ধরছে।
চীনের চেচিয়াং প্রদেশের রাজধানী হাংজুতে ১৯তম এশিয়ান গেমস চলছে। এ নিয়ে তিনবার এশিয়ান গেমস আয়োজন করছে চীন। তবে এবারের এশিয়ান গেমস চীনের জন্য শুধু খেলার শীর্ষত্বে সীমাবদ্ধ নয়। এ আসরকে কেন্দ্র করে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে চাইছে বেইজিং। এ আয়োজনকে কেন্দ্র করে ব্যস্ততা বেড়েছে চীনা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর। এ আয়োজনের স্পন্সরশিপ নিয়েছে ১৭০টিরও বেশি চীনা ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রয়েছে আলিবাবা গ্রুপ হোল্ডিং, ক্যানন, গিলি অটো ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়নার নাম। পাশাপাশি রয়েছে উদীয়মান ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানগুলো।
হাংজু শহরে নতুন করে খুব বেশি অবকাঠামো নির্মাণ করতে হয়নি এশিয়ান গেমস উপলক্ষে। এটি আগে থেকেই ভীষণ উন্নত এবং প্রযুক্তিকেন্দ্রিক বাণিজ্যিক শহর। চেচিয়াং প্রদেশজুড়েই রয়েছে বহু নামি-দামি বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। রাজনৈতিকভাবেও প্রদেশটি গুরুত্বপূর্ণ। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০০২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত প্রদেশটির নেতা ছিলেন। বর্তমান সময়েরও একাধিক নেতা এসেছেন প্রদেশটি থেকে। স্বাভাবিকভাবেই চেচিয়াং প্রদেশ বা হাংজু শহরের অর্থনৈতিক তৎপরতাও চোখে পড়ার মতো। তবে এশিয়ান গেমস সুযোগে তা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বিশ্বের টেকসই যোগাযোগ শীর্ষ ফোরামে সম্মেলনও এ সময়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ উপলক্ষে জিনপিং বলেন, নিরাপদ, দক্ষ, সবুজ, সহনশীল টেকসই যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করার মাধ্যমে সেবা অর্থনীতি ও সমাজের উচ্চ মানের উন্নয়নে সমর্থন দেওয়া হবে। চীন যোগাযোগ খাতের শক্তিশালী দেশ গঠনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চীন অব্যাহতভাবে বিশ্ব ও যুগের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে বিশ্বের যোগাযোগ খাতের সহযোগিতা জোরদার করবে, নিজের উন্নয়ন দিয়ে বিশ্বের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে। চীন বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যৌথ আলোচনা, নির্মাণ ও শেয়ার করার চেতনায় টেকসই যোগাযোগ উন্নয়নের সুফলের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জনগণের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে, বিশ্ব উন্নয়ন উদ্যোগ, জাতিসংঘের ২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বাস্তবায়ন এবং মানবজাতির অভিন্ন কল্যাণের সমাজ গঠনে সক্রিয় অবদান রাখবে।
এদিকে চীনা সংবাদমাধ্যম সিএমজি তাদের সম্পাদকীয়তে লিখেছে, এবারের হাংজু এশিয়ান গেমস এশিয়ার মানুষের সমর্থন পাচ্ছে। এশিয়ার সর্বোচ্চ মানের ক্রীড়া ইভেন্ট হিসেবে এশিয়ান গেমসের শান্তি, ঐক্য ও সহনশীলতার চেতনা এশিয়ার জনগণের সুন্দর আকাক্সক্ষা বহন করে। বিগত কয়েক ডজন বছরে এশিয়ার অর্থনীতির দ্রুত বৃদ্ধি বজায় রয়েছে। যা বিশ্ব অর্থনীতির ৪০ শতাংশেরও বেশি। ‘এশিয়া মিরাকেলের’ প্রক্রিয়ায় এশিয়ান গেমস হলো এসব সফলতার সাক্ষী, অংশগ্রহণকারী ও জোরদারকারী। বর্তমানে অন্য অঞ্চলের কিছু দেশ স্নায়ুযুদ্ধের চিন্তাধারায় এশিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতা ধ্বংস করতে চায়। এশিয়ার জনগণ ক্রীড়ার মাধ্যমে শান্তির আহ্বান জানাতে চায়। হাংজু এশিয়ান গেমস ঠিক এমন আকাঙ্ক্ষা বহন করতে পারে।
ক্রীড়া একটি দেশের উন্মুক্তকরণের জানালা। হাংজু এশিয়ান গেমসের মাধ্যমে এশিয়া ও বিশ্ব একটি উন্মুক্ত, আবেগপূর্ণ এবং আধুনিক চীন দেখতে পাচ্ছে। এবার এশিয়ান গেমসে ‘ইন্টেলিজেন্স এশিয়ান গেমস’ হলো আয়োজকদের একটি চিন্তাধারা। ‘ওয়ান-স্টপ’ ডিজিটাল প্রতিযোগিতা উপভোগের সেবা মঞ্চ থেকে, স্টেডিয়ামে রোবট সেবা পর্যন্ত, ‘ইন্টেলিজেন্স এশিয়ান গেমস’-এর মাধ্যমে সারা বিশ্ব চীনের বৈশিষ্ট্যময় আধুনিকায়ন উপভোগ করতে পারে। এশিয়ান জনগণের দৃঢ় সমর্থনে, হাংজু এশিয়ান গেমস অলিম্পিক গেমসের উন্নয়ন, এশিয়ান জনগণের ঐক্য ও মৈত্রী বাড়াতে নিশ্চয় নতুন অবদান রাখবে।
অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে চীন। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাহিদা কমে গেছে। এমন সময়ে এশিয়ান গেমসের হাত ধরে অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ার আশাবাদ ফুটে উঠেছে ব্যবসায়ীদের মধ্যে।
এশিয়ান গেমসে অগমেন্টেড রিয়েলিটি (এআর) গ্লাস সরবরাহ করবে উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান রোকিড। নিরাপত্তা ও পর্যবেক্ষণের জন্য কাজ করবে প্রতিষ্ঠানটি। বিশ্বব্যাপী ৮০টির বেশি দেশে ব্যবসা পরিব্যাপ্ত করেছে প্রতিষ্ঠানটি। চীনে বাজারের ৫০ শতাংশ রয়েছে দখলে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী আগামী বছরের মধ্যে উত্তর আমেরিকা, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার বাজারে ব্যবসা আরও বাড়াতে সংকল্পবদ্ধ।
ডিপ রোবটিকস নামে আরও একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা রোবট কুকুর ব্যবহার করে মাটির নিচে বিদ্যুৎ সরবরাহ ও নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ করে। ফলে শ্রমিকদের ওপর থেকে ঝুঁকি সরে যাবে। ডিপ রোবটিকস প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৭ সালে জু কিউগুও এবং লি চাওয়ের মাধ্যমে। চতুষ্পদী রোবটগুলোয় ক্যামেরা ও সেন্সর যুক্ত। কোম্পানিটি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই চীনের বাজারে নিজেদের ছড়িয়ে দিয়েছে।
কুয়াই-ই অন্য আরেকটি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান। রেডি-টু-ইট খাবার সরবরাহ করে ভেন্ডিং মেশিনের মাধ্যমে। খাদ্য তালিকায় রয়েছে বিফ, রাইস ও সি-ফুড নুডলস। কোম্পানির মেশিন স্থাপিত হয়েছে পাঁচটি ভেন্যুতে। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা চেন শিয়াওচিয়াং বলেছেন, ‘খাবারের দিক থেকে আমাদের পার্থক্য হলো খাবারের মানে। চীনের অনেক কুইজিনের সঙ্গে পরিচিত হবেন গ্রাহকরা।’ কুয়াই-ইর প্রতিটি ভেন্ডিং মেশিন ৪০টি পর্যন্ত বাক্স সরবরাহ করতে পারে, যা বের হওয়ার আগে উত্তপ্ত হয়। স্মার্টফোনের অ্যাপ ব্যবহার করেই অর্ডার করা যায়। বিক্রির তথ্য ও নিয়ন্ত্রণ থাকে কোম্পানির হাতে। গত বছর কুয়াই-ইর ভেন্ডিং মেশিন ব্যবহার হয়েছে অফিস বিল্ডিং, হাসপাতাল, কলেজ ও ট্রেন স্টেশনে। কিন্তু তা সীমাবদ্ধ ছিল হাংজুর সীমার মধ্যেই। উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে চায় কার্যক্রম। এর মধ্যে তিন বছরের লক্ষ্যমাত্রা হাতে নেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দাহাল (প্রচণ্ড) ও সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ সম্প্রতি চীন সফর করেন। এ সময় চীনা প্রেসিডেন্ট জিনপিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তারা। এ দুই নেতার সফর বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ২০১১ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রথমবার চীন সফর করেন বাশার আল আসাদ। সম্প্রতি চীনের মধ্যস্থতায় আরব লিগেও ফিরেছে সিরিয়া। মধ্যপ্রাচ্য থেকে মার্কিন প্রভাব কমে যাওয়ায় শূন্যস্থান পূরণে দেরি করেনি চীন। আর নেপালের প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধানমন্ত্রী হান ডাক-সু’ও চীন সফরে যাবেন বলে জানিয়েছেন।