ভারতে মুসলিমবিদ্বেষে চড়ে নতুন পার্লামেন্ট ভবন উদ্বোধন

স্বর্ণা চৌধুরী
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০২৩, ১০:১১

বেঙ্গালুরুতে ২০২২ সালের ৩০ এপ্রিল মুসলিমবিদ্বেষের বিরুদ্ধে সমাবেশ হয়। ছবি: এপি
ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদের রাজনৈতিক প্রচারণার মূল প্রকাশ মুসলিমবিদ্বেষ। ঐতিহাসিকভাবে তা চলে এসেছে। তবে ২০১৪ সালে বিজেপি নেতৃত্বাধীন মোদি সরকার ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিটি ক্ষেত্রে বিদ্বেষের এক প্রকার প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বিরুদ্ধ মত দমনে রাষ্ট্রীয় বাহিনী থেকে শুরু করে আইন-আদালত, প্রশাসন ও মিডিয়া এবং সর্বোপরি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে যথেচ্ছ ব্যবহার করা হয়েছে। পার্লামেন্টের নতুন ভবনের উদ্বোধনের ভাষণে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সব মতের প্রতি সহিষ্ণু আচরণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তবে এটি যে কেবলই কথার কথা ছিল, তা প্রমাণ করে দেন তার দলের এমপি রমেশ বিধুরী। সমাজবাদী দলের দানিশ আলিকে যে ভাষায় পার্লামেন্টে আক্রমণ করা হয় এবং তখন উপস্থিত বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা যেভাবে হাস্যোজ্জ্বল অভিব্যক্তিতে তা সমর্থন করেন, তা নতুন পার্লামেন্ট ভবনের মৌলিকত্বেরই প্রকাশ বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। আর সেই মৌলিকত্ব হলো- হিন্দুত্ববাদ।
মোদি আমলের শুরু থেকেই দেশে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়েছিল। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার প্রাথমিক, প্রণালিবদ্ধ ও সংঘবদ্ধ প্রকাশ ‘হেট স্পিচ’ বা বিদ্বেষ বক্তব্য। ধর্মীয় সংখ্যালঘু থেকে দলিত ও নিম্নবর্ণ পর্যন্ত এর বহর। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উভয় মঞ্চ থেকেই সময়ে সময়ে ঘৃণা-বিদ্বেষ প্রচার করা হয়েছে। মোদি আমলে মূল নিশানা করা হয়েছে সংখ্যালঘুদের, বিশেষত মুসলিম সম্প্রদায়কে। মুসলিম শাসন আমলের ইতিহাস, হিন্দু-মুসলিমের ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতির বৈসাদৃশ্য, সন্ত্রাসবাদ- এসবকে বিষয়বস্তু করে মুসলিম সম্প্রদায় সম্পর্কে হিন্দুমনে বিষ ঢোকানোর কাজ ধারাবাহিকভাবে চলেছে। সে কারণেই হেট স্পিচকে হিন্দুত্বের রাজনৈতিক চক্রের একটি ধারালো হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে।
হেট স্পিচের পথ ধরেই এসেছে মব লিঞ্চিং। ধর্মীয় বা জাতপাতগত ঘৃণা-বিদ্বেষের বিষে পুষ্ট হয়েছে মব লিঞ্চিংয়ের প্রবণতা। হিন্দুত্ব অনুশীলনের একটা পর্যায়ে মব লিঞ্চিংয়ের সূত্রপাত। পন্থা হিসেবে এটার সূত্রপাত মোদি আমলের কিছুটা আগেই। তখন এর ছিল সামাজিক অবয়ব। জাতপাতকে কেন্দ্র করে এমন ঘটনা ঘটত বেশি। তবে এর প্রকাশ ছিল বিক্ষিপ্তভাবে। ২০১৪ সালের পর থেকে অবস্থা বদলে যেতে থাকল। মুসলিমবিদ্বেষ মব লিঞ্চিংয়ের তালিকায় এক নম্বরে চলে এলো। তখন রাজনীতিতে ধর্মীয় ঘৃণার চাষ শুরু হয় পূর্ণমাত্রায়।
২০১৯ সালে ‘দ্য মুসলিম উইমেন প্রোটেকশন অব রাইটস অন ম্যারেজ) অ্যাক্ট’ পাস হয়, যাতে একতরফা তিন তালাক দিলে তালাকদাতার দুই বছর জেল ও জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। ভারতে বিবাহবিচ্ছেদকে যেখানে দেওয়ানি সমস্যা হিসেবে দেখা হয়, সেখানে তিন তালাকে ফৌজদারি দণ্ড দেওয়া আসলে মুসলিমদের এক অপরাধপ্রবণ সম্প্রদায় হিসেবে দেখানোর পাঁয়তারা ভিন্ন কিছু নয়। ওই বছরের ডিসেম্বরে সিএএ-এর বিরোধিতায় ভারতে ব্যাপক আন্দোলন হয়। তখন দুমকায় নির্বাচনী জনসভায় মোদি বলেছিলেন, ‘পোশাক দেখেই বোঝা যায় কারা সহিংসতা ছড়াচ্ছে।’ কথাটার ইঙ্গিত যে মুসলিমদের দিকে ছিল, সেটা বুঝতে কারও বাকি ছিল না। বিজেপির এমপি পরবেশ ভার্মা দিল্লিতে এক নির্বাচনী সভায় বলেন, ‘শাহিনবাগের প্রতিবাদীরা দিল্লিবাসীদের বাড়িতে ঢুকে ঘরের মেয়েদের ধর্ষণ ও হত্যা করবে।’ মুসলিম অধ্যুষিত শাহিনবাগে যে অহিংস আন্দোলন হয়েছিল, তা ছিল এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।
ভারতে সিএএ আইনে ‘অমুসলিম শরণার্থী’ তকমা ব্যবহার করে সহজেই মুসলিমদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ ছাপ দেওয়া সম্ভব হয়। পুরো বিষয়টির রাজনীতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল মুসলিমবিদ্বেষের রাজনীতি। তবে গত ২১ সেপ্টেম্বর পার্লামেন্টের বিশেষ অধিবেশনে বিজেপি এমপি বিধুরীর মুখে যে ঘৃণা ভাষণ শোনা গেল, তাকে শুধু রাজনীতির নিক্তিতে মাপা যায় না। এটি দেশটির সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে পৌঁছে যাওয়া বিদ্বেষ বিষের অশ্লীল উদ্গার। এমপি কুনওয়ার দানিশ আলির উদ্দেশে বিধুরীর বলা ‘কাটুয়া’, ‘মোল্লা’, ‘জঙ্গি’, ‘ভাড়ওয়া’ শব্দগুলো পার্লামেন্টের রেকর্ড থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে বটে; তাতে বাস্তব অবস্থার কোনো হেরফের যে হবে না, তা বলাই বাহুল্য। বিধুরী নিজের বক্তব্যের সঠিকতার পক্ষে ও বিভিন্ন মিডিয়ায় সাফাই দিয়েছেন।
ভারতে মুসলিমদের মধ্যে ‘মোল্লা’ পদবির চল রয়েছে। আবার তির্যক অর্থেও ‘মোল্লা’ শব্দকে টানাটানি করা হয়। কোনো মুসলিম ব্যক্তিকে ধর্মান্ধ ও গোঁড়া বোঝাতে ‘মোল্লা’, ‘মোল্লার বাচ্চা’ বলে গালমন্দ করা হয়। আর ‘কাটুয়া’ শব্দটির বাংলা ‘কাটা’। এটা পুরুষের খৎনা সম্পর্কে বিকৃতভাবে গালি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। হিন্দুদের অনেকের মধ্যে, বিশেষ করে অশিক্ষিত ও অল্প শিক্ষিতদের মধ্যে, মুসলিমদের হয় নিছক খানিক খাটো করার মজা নিতে, নয়তো ঘৃণা প্রকাশ করতে শব্দটা অনায়াসে মুখে উঠে আসে। তবে বিধুরী পার্লামেন্ট যা করলেন, সেটি হিন্দুত্ববাদী প্রচারণার চরম ধর্ষকামী বহিঃপ্রকাশ।
বিজেপির মন্ত্রী রাজনাথ সিং পরে ঘৃণা ভাষণ নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলেন বটে; কিন্তু ঘটনা যখন ঘটে, তখন বিধুরীর পেছনে বিজেপির দুই সাবেক মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ ও হর্ষবর্ধনের সহাস্য মুখ যেন বিজেপির মনের কথাই প্রকাশ্যে তুলে ধরে। সাংবাদিকদের সামনে তার অপমানের কথা বলার সময় দানিশ আলি কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ওসব শোনার পর সারারাত তিনি ঘুমাতে পারেননি। এটাই সম্ভবত বিধুরীদের পরম কাক্সিক্ষত- আত্মসম্মানে আঘাত করো, ভেতর থেকে ভেঙে ফেল।
সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের ঘটনার ওপর নজর রাখে হিন্দুত্ব ওয়াচ। গ্রুপটি বলছে, ভারতে ২০২৩ সালের জুন মাস পর্যন্ত মুসলিমদের লক্ষ্য করে ২৫৫টি বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য দেওয়ার ঘটনা তারা নথিভুক্ত করেছে। তারা বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্যের ক্ষেত্রে জাতিসংঘের দেওয়া সংজ্ঞা অনুসরণ করেছে। হিন্দুত্ব ওয়াচের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছর ও আগামী ২০২৪ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে- এমন রাজ্যগুলোতেই মোট বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্যের প্রায় ৭০ শতাংশ দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও গুজরাটে সবচেয়ে বেশি ইসলামবিদ্বেষী বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে মহারাষ্ট্রে এই হার ২৯ শতাংশ। বেশিরভাগ বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্যে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব তুলে ধরা হয়েছে এবং সহিংসতার পাশাপাশি মুসলিমদের আর্থ-সামাজিকভাবে বর্জনের আহ্বান জানানো হয়েছে। ষড়যন্ত্র তত্ত্ব তুলে ধরাসহ মুসলিমদের প্রতি সহিংস আচরণ ও বর্জনের আহ্বান জানানোর প্রায় ৮০ শতাংশ ঘটনাই ঘটেছে হিন্দুত্ববাদী বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলোতে। বিধুরীর এই অপকীর্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে রাজনৈতিক দল, সামাজিক মাধ্যম সবদিক থেকেই। ২০১৯ সালে ভারতে ঘৃণাজনিত মব লিঞ্চিংয়ের ঘটনায় উদ্বিগ্ন দেশের ৪৯ জন খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী প্রধানমন্ত্রীকে খোলা চিঠি দিয়েছিলেন ন্যায়বিচারের আর্জি জানিয়ে। এই উদ্যোগ যখন ইতিবাচক চর্চার ক্ষেত্র প্রসারিত করল, তখনই অন্য ৬১ জন বুদ্ধিজীবী ওই চিঠির বিরোধিতা করে পাল্টা চিঠি পাঠালেন। মোদি তখন প্রকাশ্য সভায় ভিন্নমতাবলম্বীদের ‘আন্দোলনজীবী’ বলে ব্যঙ্গ করেছিলেন।
হরিদ্বার ধর্ম-সংসদের সাম্প্রদায়িক কীর্তিকলাপ নিয়ে দেশজুড়ে প্রতিবাদ সত্ত্বেও উত্তরাখ-ের বিজেপি সরকার নিরুত্তর ছিল। কেন্দ্র সরকার বিষযটা এড়িয়ে গিয়েছিল। অবশেষে বর্ষীয়ান আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ, দুষ্যন্ত দাভে, সালমান খুরশিদ, পাটনা হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি অঞ্জনা প্রকাশ, পাঁচজন সাবেক সেনা কর্মকর্তাসহ দেশটির ৭৬ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ন্যায়বিচারের আর্জি নিয়ে শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতির দ্বারস্থ হলে তার হস্তক্ষেপে উত্তরাখণ্ড পুলিশ নড়াচড়া শুরু করেছিল। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার প্রতিবাদে অনেক শিল্পী-সাহিত্যিক তাদের রাষ্ট্রীয় খেতাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। তবে এতে যে কোনো পরিবর্তনের সুর শোনা গেছে এমন নয়। বরং বিধুরীদের মতো অপকীর্তির হোতারাই পরে বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত হন। হিন্দুত্ববাদ যেহেতু থামছে না। তাই এর প্রচার ও প্রকাশের মাধ্যম বিধুরীদের আগমনও অচিরেই থামছে না।