
নরেন্দ্র মোদি। ছবি: সংগৃহীত
ভারতের নির্বাচন কমিশন গত ৯ অক্টোবর পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে। ছত্তিশগড়ে দুই দফায় এবং বাকি চার রাজ্যে এক দফায় নির্বাচন শুরু হবে ৭ নভেম্বর থেকে। ভোটপর্ব শেষ হবে ৩০ নভেম্বর। ফলপ্রকাশ ৩ ডিসেম্বর। ভোটের সূচি ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই পাঁচ রাজ্যের বিধানসভার ফল নিয়ে কাটাছেঁড়া শুরু হয়েছে। ২০২৪ সালের মে মাসে ভারতের লোকসভা নির্বাচন। এটি যদি দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়, তাহলে পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন এরই একটি রিহার্সেল বলা যেতে পারে। মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, তেলেঙ্গানা, রাজস্থান ও মিজোরামে এবার ভোট। সব মিলিয়ে ভোটার সংখ্যা ১৬ কোটিরও বেশি। ৭ নভেম্বর মিজোরামে ভোট। ছত্তিশগড়ে ৭ ও ১৭ নভেম্বর, দুই দফায়। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও তেলেঙ্গানায় ভোট হবে যথাক্রমে আগামী ১৭, ২৩ ও ৩০ নভেম্বর।
বিশেষজ্ঞ মতামত ও এবিপি-সি ভোটারের সাম্প্রতিক সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস-বিজেপি হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। ভোটে ০.১ শতাংশ এগিয়ে থাকতে পারে বিজেপি। কংগ্রেস পেতে পারে ৪৪.৬ শতাংশ ভোট। বিজেপি পেতে পারে ৪৪.৭ শতাংশ ভোট। অন্যরা পেতে পারে ৮.৬ শতাংশ এবং বিএসপির ঝুলিতে যেতে পারে ২.১ শতাংশ ভোট। আসনের বিচারে এগিয়ে কংগ্রেস। ১১৬ থেকে ১২৫টি আসন যেতে পারে কংগ্রেসের ঘরে। বিজেপি পেতে পারে ১০৪ থেকে ১১৬টি আসন। বিএসপি পেতে পারে দুটি আসন এবং অন্যরা পেতে পারে তিনটি আসন।
৪০ আসনের মিজোরাম বিধানসভা দীর্ঘদিন দখলে ছিল কংগ্রেসের। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তা হস্তান্তরিত হয় মিজো আন্দোলনের অন্যতম মুখ জোরামথাঙ্গার হাতে। তার নেতৃত্বে মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট জিতে নিয়েছিল ২৬টি আসন। কংগ্রেস পাঁচটি, বিজেপি মাত্র একটি। সমীক্ষা অনুযায়ী, মিজোরামে কংগ্রেস পেতে পারে ১৭টি আসন। মিজো ন্যাশনাল পার্টি পেতে পারে ১৩টি আসন। অনুমান করা হচ্ছে, ত্রিশঙ্কু হতে পারে উত্তর-পূর্ব ভারতের এই রাজ্যে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এবার মিজোরামে বিজেপির ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পার্শ্ববর্তী রাজ্য মণিপুরে কেন্দ্রীয় সরকারের ঘটনার কুপ্রভাব সেই রাজ্যে পড়েছে। সব মিলিয়ে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে এই বিধানসভা নির্বাচনগুলোতে বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ কংগ্রেস যদি ভালো ফল করে, তাহলে রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস আবার মাথাচাড়া দেবে।
২০০ আসনের রাজস্থান বিধানসভায় গতবার ১০৩টি আসন নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল কংগ্রেস। বিজেপি পেয়েছিল ৭৩টি আসন। তবে এর আগে রাজস্থানে দীর্ঘদিন রাজত্ব করেছে বিজেপি। রাজস্থানে কংগ্রেসের অন্তর্দ্বন্দ্বও রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের একটি বড় অংশ মনে করছে, এ বছরের নির্বাচনে রাজস্থানে পাশা উল্টে দিতে পারে বিজেপি। রাজস্থান বিধানসভায় বড় চমকের ইঙ্গিত রয়েছে মতামত জরিপে। বিজেপি পেতে পারে ১২৭ থেকে ১৩৭টি আসন। ২০১৮ সালের তুলনায় গেরুয়া শিবিরের ভোটের হার বাড়তে পারে ৩৮ শতাংশ। এ বছর বিজেপির ঝুলিতে যেতে পারে ৪৭ শতাংশ ভোট। কংগ্রেস পেতে পারে ৪২ শতাংশ ভোট। আসন সংখ্যা দাঁড়াতে পারে ৫৯ থেকে ৬৯টি।
তেলেঙ্গানায় ক্ষমতাসীন দল তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি (টিআরএস)। সম্প্রতি নাম বদলে হয়েছে ভারত রাষ্ট্র সমিতি (বিআরএস)। ২০১৪ সালে অন্ধ্র প্রদেশ থেকে আলাদা হয়েছিল এই রাজ্য। পৃথক তেলেঙ্গানার জন্য দীর্ঘ লড়াই করেছিলেন কেসিআর। তিনিই তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী। এবারও তার দিকেই পাল্লা ভারী। তবে কংগ্রেস ও বিজেপিও লড়াইয়ে আছে। ফলে সেখানে লড়াই হবে ত্রিমুখী। ভোট-পূর্ব সমীক্ষা বলছে, তেলেঙ্গানায় বিআরএসের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে কংগ্রেসের। বিআরএস পেতে পারে ৪৩ থেকে ৫৫টি আসন। বিজেপি পেতে পারে মাত্র ৫ থেকে ১১টি আসন। কংগ্রেস পেতে পারে ৪৮ থেকে ৬০টি আসন। অন্যরা পেতে পারে ১১টি আসন।
২০১৮ সালে ৯০ আসনের ছত্তিশগড় বিধানসভায় কংগ্রেস পেয়েছিল ৬৮টি আসন। বিজেপি পেয়েছিল ১৫টি আসন। এর আগে ওই রাজ্যে ১৫ বছর রাজত্ব করেছে বিজেপি। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, এবারও কংগ্রেসের দিকেই পাল্লা ভারী ছত্তিশগড়ে। সমীক্ষা অনুযায়ী, ২.২ শতাংশ ভোট বাড়তে পারে কংগ্রেসের। ৪৫ শতাংশ ভোট পেতে পারে তারা। মোট আসন সংখ্যা দাঁড়াতে পারে ৪৫ থেকে ৫১। বিজেপির ভোট ১০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৪৩ শতাংশ। ৩৯ থেকে ৪৫টি আসন পেতে পারে দলটি। অন্যরা পেতে পারে দুটি আসন।
মধ্যপ্রদেশ বিধানসভার আসন সংখ্যা ২৩০। ২০১৮ সালে মধ্যপ্রদেশের নির্বাচনে কংগ্রেস পেয়েছিল ১১৪টি আসন। বিজেপি পেয়েছিল ১০৯টি আসন। তবে নির্বাচনের কিছুদিনের মধ্যেই জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া একাধিক বিধায়ক নিয়ে বিজেপিতে যোগ দেন। ফলে সরকার উল্টে যায়। মধ্যপ্রদেশে বিজেপি ক্ষমতাসীন রয়েছে বহু বছর। এ বছর মধ্যপ্রদেশে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সমীক্ষা অনুযায়ী, কংগ্রেসের দখলে যেতে পারে ১১৩-১২৫টি আসন, অন্যদিকে বিজেপির ঝুলিতে যেতে পারে ১০৪-১১৬টি আসন। আসন সংখ্যার দিক থেকে কংগ্রেস এগিয়ে থাকলেও ভোট শতাংশের দিক থেকে সামান্য এগিয়ে রয়েছে বিজেপি। এবারের নির্বাচনে কংগ্রেস পেতে পারে ৪৪.৬ শতাংশ ভোট এবং বিজেপির দখলে থাকবে ৪৪.৭ শতাংশ। গতবার হাত শিবিরের দখলে ছিল ৪০.৯ শতাংশ এবং পদ্ম শিবিরের দখলে ৪১ শতাংশ ভোট।
কিছুদিন আগে কর্ণাটকের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ক্ষমতাসীন ছিল; কিন্তু সেখানে কংগ্রেস ক্ষমতায় আসায় দলটির মনোবল বেড়েছে। রাহুল গান্ধী গোটা দেশে যে জনসম্পর্ক অভিযান করেছেন, তাতে মানুষ সাড়া দিয়েছে। এসব মিলিয়ে কংগ্রেসের কার্যকলাপ বেড়েছে। বিভিন্ন আঞ্চলিক অ-বিজেপি, অ-কংগ্রেস দল মিলে ‘ইন্ডিয়া’ নামক বিরোধী জোট তৈরি হয়েছে। নির্বাচনী প্রচারে বিজেপির প্রধান মুখ মোদি। বিজেপির অভ্যন্তরে মোদির একচ্ছত্র আধিপত্য নিশ্চিত করতেও মোদিকেন্দ্রিক প্রচার-প্রচারণা জরুরি। তবে বিজেপির মোদি ব্র্যান্ড কর্ণাটকে কাজে দেয়নি। সুতরাং নির্বাচনে একজন ব্যক্তির জনপ্রিয়তা কাজে লাগছে না। মোদির জনপ্রিয়তার পাশাপাশি স্থানীয় বিজেপির নেতৃত্ব কী করেছে না করছে, সাংগঠনিক বহু বিষয়, এমনকি হিন্দুত্ব ছাড়াও অন্য অনেকগুলো জাতপাতের বিষয় এবং আইন-শৃঙ্খলা, সন্ত্রাস, ধর্মনিরপেক্ষতা, সহিষ্ণুতা, মুসলিম ভোট এবং অনেক রকমের বিষয় পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে ভারতের রাজনীতিতে। সেই কারণে বিধানসভা নির্বাচন আর লোকসভা নির্বাচনের ইস্যু সবক্ষেত্রে একই রকম থাকে না। তবে এবারের বিধানসভা নির্বাচনগুলোর পরপরই লোকসভা নির্বাচন। তাই বিধানসভা নির্বাচনের প্রভাব পড়বে লোকসভা নির্বাচনে।
এই মুহূর্তে বিজেপির সামনে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ আছে। মোদি অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি অনেকের কাছেই সমালোচিত। কানাডার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে রয়েছে। মালদ্বীপ, নেপাল, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে চীনের প্রভাব বাড়ছে। এতে ভারতের প্রভাব কমেছে নিশ্চিতভাবেই। নির্বাচনে এর প্রভাবও থাকবে। ঐক্য ধরে বাস্তবিক লড়াই করে যেতে পারলে কংগ্রেস ও বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোট ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। পাঁচ রাজ্যে মোদিকেন্দ্রিক প্রচারণা না চললে দলের ভেতরে ও বাইরে মোদি তার গ্রহণযোগ্যতা হারাতে পারেন। সব মিলিয়ে পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন মোদির সামনে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের বিশাল চ্যালেঞ্জের একটি প্রস্তুতিই বলা যেতে পারে।