Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় বিকশিত চীনের সেমিকন্ডাক্টর শিল্প

Icon

শাহেরীন আরাফাত

প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২৩, ০৯:৫৫

মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় বিকশিত চীনের সেমিকন্ডাক্টর শিল্প

প্রতীকী ছবি।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) উন্নত চিপ হাতে পাওয়ার চীনের আকাঙ্ক্ষা যেন পূরণ না হয়, সেজন্য আরও বিধিনিষেধ আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে মার্কিন চিপ নির্মাতাদের রাজস্ব কমবে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। বাইডেন প্রশাসন গত ১৭ অক্টোবর মার্কিন কোম্পানির তৈরি উন্নত সেমিকন্ডাক্টর বিক্রির ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ দিয়েছে। সুপারকম্পিউটার গবেষণা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় চীনের অগ্রগতি নিয়ন্ত্রণ করতে এসব বিধিনিষেধ দেওয়া হয়। তবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা চীনকে নিজস্ব প্রযুক্তি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রণোদনা দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

নতুন মার্কিন বিধিনিষেধ অনুযায়ী, চীনের উন্নত চিপ বিক্রি করতে চাইছে এমন মার্কিন প্রতিষ্ঠান বা সেখানে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি সম্পর্কে সরকারকে অবহিত করতে হবে, বা একটি বিশেষ লাইসেন্স পেতে হবে। উন্নত মার্কিন চিপ তৃতীয় দেশের মাধ্যমে চীনে যাওয়ার ঝুঁকি রোধ করতে চিপ প্রস্তুতকারকদেরকে মার্কিন অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার সাপেক্ষে আরও কয়েক ডজন দেশে পাঠানোর লাইসেন্স নিতে হবে।

মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে এমন বিধিনিষেধের কথা বলা হয়েছে। তাদের দাবি, হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র, উন্নত নজরদারি ব্যবস্থা বা গোপন মার্কিন কোড ব্যবস্থা ভেঙে ফেলতে চীনের সামরিক বাহিনী এসব চিপ ব্যবহার করতে পারে। তবে সেমিকন্ডাক্টর নির্মাতারা বলছে, এমন বিধিনিষেধের ফলে রাজস্ব কমবে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা চীনকে বিকল্প নতুন প্রযুক্তির দিকে ধাবিত করছে।

এসব বিধিনিষেধ এনভিডিয়া, এএমডি এবং ইন্টেলের মতো মার্কিন চিপ নির্মাতাদের চীনে বিক্রয়কে প্রভাবিত করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। মার্কিন কর্মকর্তারা বলেছেন, এসব বিধিনিষেধ স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, বৈদ্যুতিক যান এবং গেমিং সিস্টেমের মতো বাণিজ্যিক অ্যাপ্লিকেশনগুলোতে ব্যবহারের জন্য চিপ ব্যবহারকে প্রভাবিত করবে। এক বিবৃতিতে সেমিকন্ডাক্টর ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, ‘আমরা জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করি। একটি শক্তিশালী মার্কিন সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের জন্য এটি অপরিহার্য। তবে একতরফা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হলে জাতীয় নিরাপত্তার অগ্রগতি না হলেও মার্কিন সেমিকন্ডাক্টর ব্যবস্থাপনাকে ক্ষতি করবে। কারণ তা বিদেশি গ্রাহকদের অন্য কোথাও বিকল্প দেখতে উৎসাহিত করবে।’ চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় নিরাপত্তার ধারণাকে সরলীকরণ করে চলছে। তারা রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অপব্যবহার করছে এবং একতরফা হুমকি দিয়ে যাচ্ছে।’

প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের আগে থেকেই নিজস্ব চিপসেট তৈরি করছে হুয়াওয়ে। সম্প্রতি ফাইভ-জি প্রযুক্তিযুক্ত কিরিন ৯০০০এস উন্মোচন করেছে কোম্পানিটি। এ সম্পর্কে সেভাবে বিস্তারিত কিছু জানানো না হলেও গুঞ্জন রয়েছে কোম্পানিটি আরও একটি চিপসেট আনতে যাচ্ছে। এটি কিরিন-৮ সিরিজের অন্তর্ভুক্ত হবে এবং হুয়াওয়ে নোভা-১২ সিরিজের সঙ্গে বাজারে আসতে পারে। উইবোতে এক চীনা টিপস্টারের দাবি, চলতি বছরের শেষ নাগাদ হুয়াওয়ে কিরিন-৮ সিরিজের নতুন চিপসেট আনতে পারে। তবে এর নাম বা মডেল সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। 

সংশ্লিষ্টদের মতে, শুধু ভ্যানিলা মডেলে নতুন চিপসেট ব্যবহার করা হতে পারে। অন্যদিকে নোভা-১২-প্রো ডিভাইসে ৯০০০এস থাকতে পারে। হুয়াওয়ে মেট-৬০ সিরিজেও এ চিপসেট ব্যবহার করা হয়েছে। হুয়াওয়ের নতুন চিপ উৎপাদনের বিষয়টি মার্কিন চিপ প্রস্তুতকারকদের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। 

কীভাবে চীন এত উন্নত চিপ উৎপাদন করল তার বিশ্লেষণে পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র উচ্চ প্রযুক্তির চিপ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিলেও পুরনো প্রযুক্তিতে তৈরি এনভিডিয়ার এইচ-৮০০ চিপস অথবা নিম্নমানের ২৮-এনএম চিপস তৈরির সরঞ্জাম ব্যবহারের সুযোগ এখনো চীনের রয়েছে। চীনা নির্মাতা সেই পুরনো প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং সহায়ক প্রযুক্তি সংযোজনের মাধ্যমে এই অসাধ্য সাধন করেছে বলে তারা ধারণা করছেন।

২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র বেশকিছু দিক থেকে হুয়াওয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এর মধ্যে দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি রপ্তানি বন্ধ করার মতো বিষয় রয়েছে। ফলে স্মার্টফোন তৈরিতে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করা হুয়াওয়ের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। ২০২২ সালে চীনে চিপ সরবরাহ সীমিত করার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করার পর পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা উন্নত চিপ উৎপাদনে চীনের সক্ষমতা হ্রাস পাবে বলে ধারণা করেছিলেন। তবে হয়েছে এর উল্টো। ধারণা করা হচ্ছে, ভালো চিপের র‍্যাংকিংয়ে তাইওয়ানের বিশ্বসেরা সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি টিএসএমসি এবং স্যামসাংয়ের উৎপাদিত সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তি চিপের পরপরই হুয়াওয়ের ৭-এনএম (এন+২) জায়গা করে নেবে। যদিও পশ্চিমা সরঞ্জাম ছাড়াই হুয়াওয়ে ব্যাপক আকারে এই চিপ তৈরি করার কার্যকর দক্ষতা এবং অ্যাপলের সমতুল্য ফাইভ-জি সক্ষমতা দেখাতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়ে গেছে।

নিজস্ব প্রযুক্তিতে উৎপাদিত চিপ ও পণ্য ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন হুয়াওয়ের ভাইস ও রোটেটিং চেয়ারম্যান জু ঝিজুন। গত সেপ্টেম্বরে ওয়ার্ল্ড কম্পিউটিং কনফারেন্স ২০২৩-এ তিনি বলেন, ‘হুয়াওয়ে যদি নিজস্ব চিপ ব্যবহার না করে তাহলে প্রতিযোগীদের সঙ্গে দূরত্ব আরও বাড়বে। অন্যদিকে চীনের এ প্রযুক্তি জায়ান্ট যদি নিজস্ব চিপের ব্যবহার বাড়ায়, তাহলে কোম্পানির প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও পণ্যের বিষয়ে আরও মানুষ জানতে পারবে। এর মাধ্যমে বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা যাবে। চীনের জেনারেল কম্পিউটিং ইন্ডাস্ট্রি তিনটি ইকোসিস্টেমে এগিয়ে যাচ্ছে; যার প্রথমটি হচ্ছে এক্স-৮৬, দ্বিতীয়টি হচ্ছে পেন্টিয়াম ইকোসিস্টেম এবং তৃতীয়টি হচ্ছে আরআইএসসি-ভি ওপেন সোর্স ইকোসিস্টেম। ভবিষ্যতে এ তিনটি ইকোসিস্টেম সমান্তরালভাবে অগ্রসর হবে। তবে এগুলোর মধ্যে কোনটি বেশি কার্যকর বা সফল হবে সে বিষয়ে এখনই নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।’

যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার মধ্যে চীনের বাজারে ফাইভ-জি নেটওয়ার্কযুক্ত মেট-৬০ স্মার্টফোন উন্মোচন করেছে হুয়াওয়ে। আর এটি পশ্চিমা দেশসহ বিশ্ববাজারে প্রশ্ন তৈরি করেছে। এ ডিভাইসটিতে ৭ ন্যানোমিটার প্রযুক্তিতে তৈরি কিরিন চিপ ব্যবহার করা হয়েছে। এ প্রযুক্তি ফাইভ-জির বাজারে ফিরে আসার মাধ্যমে হুয়াওয়ে নতুন মাইলফলক অর্জন করেছে। প্রযুক্তি বাজারে এগিয়ে থাকা কোম্পানিগুলোর তুলনায় কিরিন চিপসেট সেভাবে উন্নত না হলেও এ খাতে এগিয়ে যাওয়ার জন্য এটি হুয়াওয়ের প্রথম ধাপ। প্রযুক্তিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকদের মতে, যে কোনো জায়গা থেকেই কোম্পানিটিকে কাজ শুরু করতে হবে। সেদিক থেকে নিজস্ব চিপ উৎপাদন ও ব্যবহারের যে সিদ্ধান্ত তা অদূর ভবিষ্যতে কোম্পানিটির সেমিকন্ডাক্টর খাতে এগিয়ে থাকার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। স্মার্টফোনের বাজারে হুয়াওয়ের মেট-৬০ সিরিজ নিয়ে গুঞ্জন উঠেছে। প্রশ্ন উঠছে ডিভাইসে যেসব উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলোর সরবরাহকারী কারা।

মেট-৬০ প্রো মডেলের ফোনে দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি হাইনিক্সের চিপ ব্যবহার বলে দিচ্ছে, হুয়াওয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এড়াতে পেরেছে। আর এটি ওয়াশিংটনের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে কোম্পানিটি জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় থাকা কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে পণ্য সরবরাহ করা হয় না।

সেলফোনের পাশাপাশি হুয়াওয়ে নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেমের বাজার বিকাশেও কাজ করছে। সম্প্রতি কাস্টম ওএসের চতুর্থ ভার্সন উন্মোচন করে হুয়াওয়ে। উন্মোচনের এক মাসের মধ্যে এক কোটির বেশি ডিভাইসে হারমনি ওএস-৪ ইনস্টল করা হয়েছে বলে জানা গেছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের বিশ্লেষক এমিলি বেনসন বলেন, “আমাজন ও মাইক্রোসফট পরিচালিত বিদেশি ক্লাউড পরিষেবাগুলোতে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সীমাবদ্ধ করবে বলে মনে হয় না। মার্কিন প্রশাসন সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সেই ব্যবসা বন্ধ করার কথা বিবেচনা করেছিল। তাদের ধারণা, চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো উন্নতমানের চিপ পেতে অন্য দেশকে এক ধরনের ‘ব্যাকডোর’ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। পরে এমন একটি নির্বাহী আদেশও আসতে পারে।”

গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যাপিটাল ইকোনমিক্সের চীনা অর্থনীতি বিষয়ক প্রধান জুলিয়ান ইভান্স-প্রিচার্ড বলেন, ‘অ-চীনা কোম্পানিগুলো তাদের বর্তমান পণ্যগুলোর আরও উন্নত সংস্করণ তৈরি করার কারণে নিয়ন্ত্রণের প্রভাব আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এতে চীন নিজেই এআই চিপের বিকাশে কাজ করতে পারে। আগামী কয়েক দশকে এআই উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য গেম চেঞ্জার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫