
চীনের ষষ্ঠ আন্তর্জাতিক আমদানি মেলা ‘সিয়েছাও’। ছবি: সংগৃহীত
৫ থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত চীনের ষষ্ঠ আন্তর্জাতিক আমদানি মেলা ‘সিয়েছাও’ নামক সাংহাইয়ের জাতীয় প্রদর্শনী কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয়। করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে দীর্ঘ বিরতির পর এটি সরাসরি আয়োজিত চীনের প্রথম আন্তর্জাতিক আমদানি মেলা।
আমদানিকে প্রধান বিষয় হিসেবে নেওয়া প্রথম জাতীয় পর্যায়ের এক্সপো চীনের উন্মুক্তকরণের দরজা ‘অধিক থেকে অধিকতর বড় হওয়ার’ সাক্ষী। কার্যত ঝিমিয়ে পড়া অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে আমদানি মেলা বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে।
চায়না গ্লোবাল টেলিভিশন নেটওয়ার্কের (সিজিটিএন) এক অনলাইন জরিপ অনুযায়ী, বিশ্বের মুক্ত বাজার অর্থনীতিকে গতিশীল করতে বড় ভূমিকা রাখছে চীনের আন্তর্জাতিক আমদানি মেলা। এমন মতামত দিয়েছেন ৯০ শতাংশ উত্তরদাতা। তাদের মতে, বিশ্বের অনিশ্চিত অর্থনীতির জন্য নিশ্চয়তা আনতে গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হয়ে হয়ে উঠেছে চীনের আন্তর্জাতিক আমদানি মেলা। গত ৬ বছর ধরে আন্তর্জাতিক আমদানি মেলার আয়োজন করছে চীন। এর মধ্য দিয়ে বহির্বিশ্বে শক্তিশালী সংকেত পাঠিয়েছে দেশটি, যা অস্থিতিশীল বিশ্বের অর্থনীতির জন্য একটি বড় সুযোগ তৈরি করছে। জরিপে ১০ হাজারেরও বেশি নেটিজেন অংশ নেন।
চায়না মিডিয়া গ্রুপের এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, ২০১৮ সাল থেকে চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলা সাফল্যের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মেলায় লেনদেনের পরিমাণ ৩৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। মেলায় প্রদর্শিত অনেক পণ্য বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত হয়েছে এবং অংশগ্রহণকারীরা বিনিয়োগকারী হয়েছে। মেলা আন্তঃদেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বিশাল উন্নয়নের সুযোগ নিয়ে এসেছে। সম্পাদকীয়তে আরও বলা হয়, চলতি বছর পালিত হয় চীনের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ নীতি প্রণয়নের ৪৫তম বার্ষিকী এবং বিআরআই উত্থাপনের দশম বার্ষিকী।
মেলা চীনের বড় বাজারের সুবিধা কাজে লাগিয়ে আন্তঃদেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য নতুন উন্নয়নের সুযোগ দিচ্ছে। চলতি বছরের আমদানি মেলায় ৪৪২টি নতুন পণ্য, প্রযুক্তি ও সেবা নিয়ে হাজির বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন চীনা বাজারে তা বিক্রির সুযোগ পাবে, তেমনি চীনা ক্রেতারাও ভালো পণ্য কেনার সুযোগ পাবে। ষষ্ঠ চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলায় ভিয়েতনাম, দক্ষিণ আফ্রিকা, কাজাখস্তান, সার্বিয়া ও হন্ডুরাস প্রধান অতিথি দেশ হিসেবে অংশগ্রহণ করছে। মেলায় দেশ-প্যাভিলিয়নগুলোতে বিভিন্ন দেশ নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যের পণ্য ও পরিষেবা নিয়ে হাজির হয়েছে। উন্মুক্তকরণ ও সহযোগিতামূলক উদ্ভাবনের মাধ্যমে অভিন্ন কল্যাণ লাভের নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করছে দেশগুলো।
সার্বিয়া টানা পাঁচবার আমদানি মেলায় এবং তিনবার দেশ-প্যাভিলিয়ন প্রদর্শনে অংশগ্রহণ করছে। এবারের মেলায় সার্বিয়ার প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি বড় প্রতিনিধি দল অংশ নিচ্ছে। ষষ্ঠবার আমদানি মেলায় অংশগ্রহণের অনুভূতি প্রসঙ্গে সার্বিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনা ব্রনাবিচ বলেন, ‘চীনে আসতে পেরে আমি খুব আনন্দিত। এটি আমার দ্বিতীয়বারের মতো সাংহাই সফর। আমরা চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রেখেছি। গত ১০ বছরে চীনে সার্বিয়ার রপ্তানির পরিমাণ ১৮৫ গুণ বেড়েছে। এতে প্রমাণ হয় যে, চীন ও চীনা বাজার বিদেশিদের জন্য অনেক উন্মুক্ত হয়েছে।’
দক্ষিণ আফ্রিকা টানা পাঁচ বার আমদানি মেলায় অংশগ্রহণ করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশটির খাদ্যপণ্য চীনা ভোক্তাদের টেবিল পর্যন্ত পৌঁছেছে। চীনে দেশটির পণ্যের রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে আমদানি মেলা। দক্ষিণ আফ্রিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট পল মাশাটাইল দেশটির প্যাভিলিয়ন উদ্বোধনের সময় বলেন, ‘আমরা হাতে হাত মিলিয়ে দুই দেশের বাণিজ্য জোরদার করতে পারি। দক্ষিণ আফ্রিকা ও চীনের দীর্ঘকালীন বন্ধুত্বের সম্পর্ক রয়েছে। দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ২৫ বছরে, চীনের সঙ্গে অনেক সহযোগিতামূলক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। চীনের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার বাণিজ্যের পরিমাণ ৬১ হাজার ৪০০ কোটি র্যান্ড ছাড়িয়েছে এবং তা অব্যাহতভাবে বাড়ছে।’
চীনে ‘সিয়েছাও’ হলো ভালোবাসা ও সুখের প্রতীক। দেশটির কর্মকর্তারা এবারের মেলাকে বৈশ্বিক অর্থনীতির ‘সিয়েছাও’ বলে অভিহিত করছেন। ২০১৮ সালের নভেম্বরে প্রথম চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চীন বিশ্বের কাছে আন্তরিকভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ‘চীনের আন্তর্জাতিক আমদানি মেলা কেবল প্রতিবছর আয়োজন করাই হবে না; বরং এর গুণগত মান ও কার্যকারিতাও বাড়ানো হবে।’ এর আগে পাঁচ বার আয়োজিত আমদানি মেলায় ১৩১টি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি ও শিল্প প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে ছিল নতুন পণ্য, নতুন প্রযুক্তি এবং নতুন পরিষেবা সম্পর্কিত ২ সহস্রাধিক প্রকল্প। মেলাগুলোতে মোট লেনদেনের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ইতোমধ্যেই ৬০টিরও বেশি দেশ এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, জাতিসংঘ শিল্প উন্নয়ন সংস্থা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্রসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবারের মেলায় অংশগ্রহণ করেছে। ৩ সহস্রাধিক শিল্প প্রতিষ্ঠান বুথ প্রতিষ্ঠার কথা নিশ্চিত করেছে। মেলায় তাদের প্রদর্শনী এলাকার আয়তন ছিল প্রায় ৩ লাখ ৬০ বর্গমিটার। বিভিন্ন দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য চীনের বৃহৎ বাজারে আসার সেতু নির্মাণ করেছে আমদানি মেলা। এটি দেশটীর অর্থনৈতিক রূপান্তর, শিল্পের অগ্রগতি এবং ভোগের অগ্রগতিতে সহায়ক এবং উচ্চ গুণগত মানের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বিশ্বে গত এক শতাব্দীতে অদেখা বর্তমান বাস্তবতা পরিস্থিতি আরও জটিল করেছে এবং বৈশ্বিক অর্থনীতি পুরুদ্ধারের পথ খুব সহজ নয়।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং মেলায় দেওয়া ভাষণে বলেন, ‘চীন তার বৃহৎ বাজারে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন পক্ষের যৌথ ভাগাভাগিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন পক্ষের ব্যবস্থাগত উন্মুক্তকরণের সুযোগ ভাগাভাগি করাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন পক্ষের আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সুযোগ ভাগাভাগি করাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।’ এর বিপরীতে মার্কিন জনসন অ্যান্ড জনসন কোম্পানির ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং চীন বিষয়ক চেয়ারম্যান সোং ওয়েই ছুন বলেন, ‘আমরা উচ্চমানের উন্মুক্তকরণে চীনের দৃঢ়প্রতিজ্ঞা, বৈশ্বিক অর্থনীতির উন্নয়ন এবং বৈশ্বিক আর্থ-বাণিজ্যিক সহযোগিতা বেগবানে চীনের দায়িত্ববোধ ও প্রচেষ্টা অনুভব করেছি।’
মেলায় পুরনো প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন অংশ নিচ্ছে, তেমনি নতুন প্রতিষ্ঠানও অংশ নিচ্ছে। চীন যে আরও উন্মুক্ত হচ্ছে, এটি তারই প্রমাণ। চীন ক্রমশ আমদানি বাড়াচ্ছে এবং অবাধ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করছে। হাইনান প্রদেশের অবাধ বাণিজ্যিক বন্দরসহ আরও উচ্চ পর্য়ায়ের উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এগুলো বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আরও উন্নয়নের সুযোগ বয়ে আনবে।
সম্প্রতি তৃতীয় বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আন্তর্জাতিক সহযোগিতা শীর্ষ ফোরাম বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হয়। চীন বিআরআইয়ের আওতায় উচ্চমানের যৌথনির্মাণ সমর্থনের জন্য ৮ দফা উদ্যোগ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে আরও উন্মুক্তকরণের বিশ্ব অর্থনীতি গঠনে সমর্থন দেওয়া অন্যতম। এবারের আমদানি মেলায় দেশভিত্তিক প্যাভিলিয়ন নেওয়া ৭২টি অংশগ্রহণকারীর মধ্যে ৬৪টি বিআরআই উদ্যোগসংশ্লিষ্ট দেশ। আর প্রতিষ্ঠানভিত্তিক প্যাভিলিয়ন নেওয়া ৩৪০০টিও বেশি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৫০০টি বিআরআই উদ্যোগসংশ্লিষ্ট দেশ থেকে আসা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আগামী ৫ বছরে চীনের মালামাল বাণিজ্য ও পরিষেবা বাণিজ্যের আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ যথাক্রমে ৩২ ট্রিলিয়ন এবং ৫০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। বিশ্বের প্রথম আমদানিকেন্দ্রিক জাতীয় পর্যায়ের প্রদর্শনী হিসেবে, আন্তর্জাতিক আমদানি মেলা অব্যাহতভাবে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে চীনা বাজারের সুবিধা ভোগের সুযোগ দিয়ে যাবে। চীনের বড় বাজারের সুবিধা কাজে লাগিয়ে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করে অর্থনীতি শক্তিশালী করতে চাইছে চীন।