Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

মূল্যস্ফীতির চাপে ক্ষুধার্ত ইউরোপ

Icon

শাহেরীন আরাফাত

প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:২৬

মূল্যস্ফীতির চাপে ক্ষুধার্ত ইউরোপ

বাজারে লেনদেন। ছবি: ফিনান্সিয়াল টাইম

ইউরো অঞ্চলে মূল্যস্ফীতির চাপে ভোক্তা পর্যায়ে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। গত বছরের তুলনায় চলতি বছর বার্ষিক মূল্যস্ফীতি কমলেও সেখানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখনো ঊর্ধ্বমুখী। খাদ্যদ্রব্যের দাম নাগালের বাইরে থাকায় নিম্ন আয়ের মানুষ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সাধারণ মানুষ যে হারে না খেয়ে, আধপেটা খেয়ে বেঁচে আছে; এ অবস্থাকে অনেক বিশ্লেষক ২০০৮ সালের মহামন্দার সঙ্গে তুলনা করেছেন। 

গত বছর ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) মূল্যস্ফীতির হার চার দশকের মধ্যে সর্বোচ্চে ওঠে। ১৯৯৭-২০২১ সালের মধ্যে অঞ্চলটিতে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি ছিল ৪.৪ শতাংশ। খাদ্যদ্রব্য ও অ্যালকোহলবিহীন পানীয়র বার্ষিক মূল্যস্ফীতি হার মার্চে ১৯.২ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। ২০২২ সালের অক্টোবরে ইউরো অঞ্চলের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০.৬ শতাংশ। ২০২৩ সালের একই সময়ে এসে তা কমে ২.৯ শতাংশে নেমে এসেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে এর হার ৩.৬ শতাংশ। কিন্তু খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণে ভোক্তাপর্যায়ে জীবনযাপন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ জটিল হয়ে উঠেছে। চলতি বছরের অক্টোবরে ইউরো অঞ্চলে প্রকৃত খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৪.৬ শতাংশ, যা নিম্ন আয়ের পরিবারের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে।

সম্প্রতি ‘ব্যারোমিটার অন পোভার্টি অ্যান্ড প্রিকারিয়াসনেস’ শীর্ষক জরিপ প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, মূল্যস্ফীতি ইউরোপের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষকে আর্থিক অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে। এক বেলার খাবার এড়িয়ে যেতে তারা বাধ্য হচ্ছে। প্রায় ১০ হাজার অংশগ্রহণকারীকে নিয়ে জরিপটি চালানো হয়। এটি পরিচালনা করেছে ফরাসি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইপসস। এতে অর্থ সহায়তা করেছে দাতা সংস্থা ফ্রেঞ্চ সেকোর্স পপুলার। ইউরোপীয়দের ক্রয়ক্ষমতার ওপর গবেষণা করে দেখা গেছে, চ্যালেঞ্জিং আর্থিক অবস্থার কারণে মানুষজনের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে উল্লেখযোগ্যহারে। জরিপে অংশগ্রহণ করা ৩৮ শতাংশ উত্তরদাতা প্রতিদিন তিন বেলার খাবারের খরচ বহন করতে অক্ষম বলে জানিয়েছে। ৪২ শতাংশ মানুষ আর্থিক অভাবে এক বেলার খাবার এড়িয়ে যান। অভিভাবক ও পিতামাতারা চলমান পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন।

জরিপ প্রতিবেদন অনুসারে, ইউরোপের ২৯ শতাংশ মানুষ তাদের আর্থিক পরিস্থিতিকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করে। ৫৬ শতাংশ তাদের আর্থিক অবস্থাকে স্থিতিশীল বলছে। মাত্র ১৫ শতাংশ নিজেদের অবস্থাকে ভালো বলেছে। চলমান পরিস্থিতিতে যে কোনো অপ্রত্যাশিত ব্যয় তাদের অর্থনৈতিক বিপদে ফেলতে পারে। এ ছাড়া ক্রমবর্ধমান দাম ও স্থবির বেতনের কারণে প্রায় অর্ধেক ইউরোপীয় অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার আশঙ্কা করছে।

ইইউর পার্লামেন্টের তথ্যানুযায়ী, জ্বালানির উচ্চমূল্যের কারণে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী। ফলে কৃষি খাত থেকে শুরু করে পুরো খাদ্যোৎপাদন ও সরবরাহ খাতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া সার থেকে শুরু করে পশুখাদ্যের সরবরাহ কমে যাওয়ায় শস্য উৎপাদনে কৃষক পর্যায়ে ব্যয় বেড়েছে। ৯ নভেম্বর খাদ্য নিরাপত্তা সূচকের আপডেট ভার্সন প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। সেখানকার তথ্যানুযায়ী, ইউরোপিয়ান দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায় রয়েছে।

ইউরোস্ট্যাটের তথ্যানুযায়ী, ১৯৯৭ সালের পর ইইউ অঞ্চলে খাদ্যদ্রব্যের প্রকৃত মূল্যস্ফীতি কখনোই ৩.৫ শতাংশ অতিক্রম করেনি। কিন্তু ২০২২ সালের আগস্টে তা ৩.৯ শতাংশে উন্নীত হয় এবং চলতি বছরের মার্চে সর্বোচ্চ ১০.৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। ২০২৩ সালের অক্টোবরে ইউরোপের মোট ৩৭টি দেশের মধ্যে ৩৩টিতেই খাদ্যদ্রব্যের মূল্যস্ফীতি সামগ্রিক হার ছাড়িয়ে গেছে। বেশির ভাগ ইউরোপীয় এরই মধ্যে কঠিন ত্যাগ স্বীকার করেছে। যেমন খাবার এড়িয়ে যাওয়া, ঘর গরম না করা, টাকা ধার নেওয়া ও অর্থের অভাবে চিকিৎসা না করা।

ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে চেক প্রজাতন্ত্রে বার্ষিক খাদ্য মূল্যস্ফীতি মাইনাস ৫.৭ শতাংশ, বেলজিয়ামে ১০.৯, নেদারল্যান্ডসে ৮.৮, গ্রিসে ৬.৬ ও স্পেনে ৫.৯ শতাংশ। চেক প্রজাতন্ত্রের পর হাঙ্গেরি ও রোমানিয়ার খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার সবচেয়ে কম। এ হার যথাক্রমে মাইনাস ১.৬ ও মাইনাস ০.৫ শতাংশ।

ইইউর সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার চারটি দেশের প্রকৃত খাদ্য মূল্যস্ফীতি অঞ্চলটির গড়ের তুলনায় কম। এদিক থেকে জার্মানির মূল্যস্ফীতি ৩.৭, ফ্রান্সের ৩.৫, স্পেনের ৫.৯ ও ইতালির ৪.৯ শতাংশ। ইইউতে খাদ্য ও পানীয়ের মূল্যস্ফীতি হার লক্ষ করলে দেখা যায়, ডেনমার্কে ৩.৭ শতাংশ হলেও গ্রিসে তা ১০.৪ শতাংশের বেশি। অন্যদিকে ইইউতে গড় ছিল ৭.৬ শতাংশ। ২০২২ সালের মে মাসের পর প্রথমবারের মতো মূল্যস্ফীতির হার এক অঙ্কে এসেছে। অন্যদিকে ইইউর ১৪টি সদস্য দেশে বার্ষিক খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল সাড়ে ৭ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে গ্রিস, বেলজিয়াম, স্পেন ও ফ্রান্সও রয়েছে। 

সম্প্রতি প্রকাশিত এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, চাহিদার অবনতি হওয়ায় ইউরোজোনের অর্থনীতি অক্টোবরে প্রায় তিন বছরের মধ্যে দ্রুত গতিতে সংকুচিত হয়েছে। পারচেজিং ম্যানেজার্স ইনডেক্স গত মাসে ৪৬.৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। অক্টোবর পঞ্চম মাস, যেখানে সূচকটি ধারাবাহিকভাবে সংকুচিত হয়েছে। এ ছাড়া অর্থনীতির একটা নেতিবাচক দিক হচ্ছে কর্মসংস্থানের স্থবিরতা। ৩২ মাস ধরে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না।

চলতি সপ্তাহে ব্রাসেলসে এক সংবাদ সম্মেলনে আইএমএফের ইউরোপীয় বিভাগের পরিচালক আলফ্রেড কামের বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি বিস্ময়করভাবে বাড়তে পারে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ এরই মধ্যে জ্বালানির মূল্যে প্রভাব ফেলেছে, যা ইউরোপে মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিয়েছে।’

আইএমএফের নতুন আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। অর্থনীতিতে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি এবং যুদ্ধের প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের প্রাথমিক প্রভাবে তেলের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। আমরা দেখছি যে প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্য ১০ শতাংশ বেড়েছে। সংঘাত চলছে সীমিত পরিসরে। ফলে প্রভাবটাও বড় পরিসরে দেখা যায়নি। এটা নির্ভর করছে যুদ্ধের স্থায়িত্বকাল ও ব্যাপকতার ওপর।’

আইএমএফ ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পরামর্শ দিয়েছে যে, মূল্যস্ফীতির ঝুঁকিগুলো পর্যবেক্ষণ করা দরকার। উৎপাদন ও মজুরির মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে হবে। চাকরি, ভবিষ্যতের কর্ম, দক্ষ শ্রমিক, অভিবাসী শ্রমিক এ সবকিছুর সঙ্গে মজুরি ও মূল্যস্ফীতির সমন্বয় জরুরি।

জোসেফ রাউনট্রি ফাউন্ডেশনের জুনের একটি সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে, যুক্তরাজ্যে প্রায় ৫৭ লাখ নিম্ন আয়ের পরিবারে খাদ্যের জন্য পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে রয়েছে। খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ার প্রভাবটি স্পষ্ট হয়েছে উঠেছে। যদিও মূল্যস্ফীতির সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানগুলোয় ধীর হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তার পরও খাদ্য ও খাদ্য-উপকরণের খরচ বৃদ্ধি অব্যাহত। ২০২২ সালে ইউরোপের মূল্যস্ফীতি তিন গুণ বেড়েছে। ক্রমবর্ধমান ব্যয়, বিশেষ করে খাদ্য ও জ্বালানির দাম বাড়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে অর্ধেকেরও বেশি অংশগ্রহণকারীর মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। গ্যাসের দাম ও অপ্রত্যাশিত খরচে উদ্বিগ্ন জরিপের ৫৯ শতাংশ মানুষ। অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে ইউরোপীয়দের ওপর আর্থিক চাপ দিন দিন পরিস্থিতিকে আরও সংকটময় করে তুলেছে।

বিদ্যমান আর্থিক পরিস্থিতির কারণে বেশির ভাগ ইউরোপীয়কে বাধ্য হয়ে জটিল সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। বিভিন্ন সেক্টরজুড়ে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে আপস করে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। যেমন অনেকে ক্ষুধার্ত থেকে এক বেলার খাবারের মূল্য পকেটে রেখে দিচ্ছে। প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন ইউরোপীয় এ সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। এ সমস্যার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি গ্রিস ও মলদোভায় পাওয়া গেছে। ক্রমবর্ধমান খরচের কারণে হিটার ব্যবহার এড়ানো, অর্থ ধার ও স্বাস্থ্যজনিত সমস্যাগুলোকে অবহেলা করা হচ্ছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫