
প্রতীকী ছবি
ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি দেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০২৪ সালে। আর তাই নতুন বছরের বড় ইস্যু এবং প্রবণতাগুলো প্রধানত হবে রাজনৈতিক। যদিও বিশ্ব করোনা-পরবর্তী অবস্থা থেকে অনেকটাই এগিয়েছে, তবু এটি এখনো ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাব, সেই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য ও সাহেল থেকে লাতিন আমেরিকা; এমনকি দক্ষিণ চীন সাগর পর্যন্ত নতুন যুদ্ধ, সংঘাতের বাস্তবতা মোকাবিলা করছে। বিশ্ব রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করবে যে বিষয়গুলো, তার মাঝেই নিহিত রয়েছে গণতন্ত্রের জন্য হুমকি, যুদ্ধ এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ঝুঁকির বাস্তবতা। কেমন যাবে নতুন বছর—এ নিয়ে মন্তব্য করেছেন প্রজেক্ট সিন্ডিকেটের কয়েকজন বিশেষজ্ঞ লেখক।
আদিকেয়ে আদিবাজো
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব স্কলারশিপের (সিএএস) অধ্যাপক আদিকেয়ে আদিবাজোর মতে, আফ্রিকা অভ্যুত্থান, সংঘাত ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উদ্ভূত চ্যালেঞ্জগুলোর ওপর অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ফোকাস করতে বাধ্য হবে। পশ্চিম আফ্রিকায় সামরিক শাসনের প্রত্যাবর্তনে গণতান্ত্রিক শাসন অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। খরাপীড়িত সাহেল জুড়ে নিরাপত্তাহীনতায় জর্জরিত গালিভাররূপী নাইজেরিয়াকে তার উত্তর-পূর্বের লিলিপুট প্রতিবেশীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে বেগ পেতে হবে। হর্ন অব আফ্রিকা খ্যাত অঞ্চলটি ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি, খরা, দুর্ভিক্ষ এবং যুদ্ধবাজদের হুমকির মুখে থাকবে। পূর্ব কঙ্গো ও সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের মিলিশিয়ারা ব্যাপক হারে মানুষকে বাস্তুচ্যুত করে যাবে এবং বন্যা-বিধ্বস্ত আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে স্বাধীনতায় নেতৃত্ব দেওয়া দলগুলো একগুঁয়েভাবে ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকবে। দক্ষিণ আফ্রিকার আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস অন্তত এ তালিকাভুক্ত নয়। উত্তর আফ্রিকা আর্থ-সামাজিক স্থবিরতার শিকার হবে; কারণ মিশর, আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়ার সামরিক-সমর্থিত শাসন ব্যবস্থা সংস্কারের দাবিকে প্রতিহত করে। ১.১ ট্রিলিয়ন ডলার ঋণের বোঝা, ক্রমবর্ধমান সুদের হার, এবং বহিরাগত শক্তির হস্তক্ষেপে মহাদেশটি বিপর্যস্ত।
নিনা এল ক্রুশচেভা
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক অধ্যাপক নিনা এল ক্রুশচেভা বলেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে এবং ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে বর্তমান যুদ্ধের সমাপ্তি দেখতে পাব এমন ইঙ্গিত খুব কমই রয়েছে। চীন যে তাইওয়ানের দিকে অগ্রসর হবে না, তাও নিশ্চিতভাবে বলে দেওয়া যায় না। ডোনাল্ড ট্রাম্প বা অন্য কোনো রিপাবলিকান যদি নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হন, তাহলে তা কিছু বৈশ্বিক হিসাব-নিকাশ আমূল বদলে দিতে পারে। ট্রাম্প ইউক্রেন যুদ্ধ দ্রুত শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্রাদিমির পুতিন, যিনি প্রায় নিশ্চিতভাবেই মার্চ মাসে আরও ছয় বছরের মেয়াদ গ্রহণ করছেন, অন্য পক্ষ থেকে বড় ছাড় ছাড়া কোনো মীমাংসায় রাজি হওয়ার সম্ভাবনা কম।
কেউন লি
সিউল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক কেউন লি বলেন, নতুন বছর এবং তারপরও আমরা ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক বৈষম্য দেখতে পাব, বিশেষ করে উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে। ডিগ্লোবালাইজেশন সুরক্ষাবাদ ও শিল্পনীতি ফিরিয়ে এনেছে। ব্যাপক ভর্তুকি ও উচ্চ সুদ হারের কারণে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বব্যাপী প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ ও অর্থপ্রবাহ আকৃষ্ট করছে। অপরদিকে গ্লোবাল সাউথ ডলার দর বৃদ্ধির ফলে খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতিতে ব্যাপকভাবে ভুগছে। যদিও এ বছর মুদ্রাস্ফীতি সামগ্রিকভাবে ধীরে ধীরে হ্রাস পাবে, কিছু পণ্যের দাম বেশি থাকবে, বিশেষ করে যে পণ্যগুলো পরাশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং বৈশ্বিক মূল্য শৃঙ্খলের দ্বারা প্রভাবিত।
টিলালেঙ মোফোকেঙ
দক্ষিণ আফ্রিকার চিকিৎসক ও ২০২১ সালে বিবিসির ১০০ প্রভাবশালী নারীর তালিকায় থাকা টিলালেঙ মোফোকেঙ বলেন, ২০২৪ সালে গাজা উপত্যকায় জরিপ চালাব। যে অঞ্চলটি নজিরবিহীন বোমাবর্ষণ ও ধ্বংসযজ্ঞের সম্মুখীন হয়েছে। উপত্যকার চিকিৎসা পরিকাঠামোর অপূরণীয়ভাবে ক্ষতি হয়েছে এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীরা গুরুতর পরিস্থিতিতে কাজ করছে। চিকিৎসা সরঞ্জামের সরবরাহ ভীষণ সীমিত। স্বাস্থ্যসেবার অধিকারের সঙ্গে যা কোনোভাবেই মেলানো যাবে না। সেখানকার অমানবিক পরিস্থিতি শেখার এক বড় উপলক্ষ। এ পরিস্থিতিতে ইসরায়েল ও তার মিত্রদের পক্ষ থেকে অনমনীয়তার প্রকাশ ঘটেছে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের স্বায়ত্তশাসনের জন্য সমানভাবে অদম্য প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করেছে। সহিংসতার অবসানই চূড়ান্ত লক্ষ্য হতে হবে। মানবাধিকার, শান্তি ও নিরাপত্তা অর্জন তখনই সম্ভব, যখন জাতিসংঘের সব সদস্য রাষ্ট্র মানবাধিকার রক্ষায় ভূমিকা রাখবে।
আলা মুরাবিত
লিবীয় বংশোদ্ভূত কানাডার চিকিৎসক আলা মুরাবিতের মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কণ্ঠস্বরকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং উন্নত করার গুরুত্বকে নেতিবাচকভাবে দেখা হয়েছে। আমরা ২০২৪ সালে প্রবেশ করছি বিশ্বব্যাপী এ বাস্তবতাকে সঙ্গী করেই। যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুকের নিরাপত্তা এবং প্রজনন অধিকার থেকে শুরু করে গাজায় যুদ্ধবিরতি, বিশ্বব্যাপী নারী অধিকারের অগ্রগতি এবং সুদান, ইথিওপিয়া, ইয়েমেন ও কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের মতো জায়গায় শান্তি ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য জরুরি আহ্বান বিস্তৃত হুমকির সৃষ্টি করেছে। শুনতে ও প্রতিক্রিয়া জানাতে আমাদের ব্যর্থতা স্থিতাবস্থাকে স্থায়ী করে, যেখানে দ্বন্দ্ব ও নিরাপত্তাহীনতায় নারী এবং শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যত দিন তাদের আখ্যান এবং অভিজ্ঞতা উপেক্ষা করা হবে, বৈশ্বিক বৈষম্য ও অবিচার আরও গভীর হবে। তবে আমরা যদি নতুন বছরকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং নীতি তৈরিতে নতুন কণ্ঠের সঙ্গে জড়িত হওয়ার সুযোগ হিসেবে দেখি, তাহলে আমরা পুনরায় আইনের শাসনের সম্ভাবনার কথা উপস্থাপন করতে পারি।
মাইকেল আর স্ট্রেন
মার্কিন অর্থনীতিবিদ মাইকেল আর স্ট্রেন বলেন, ফেডারেল রিজার্ভের (মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক) রাজনৈতিক স্বাধীনতা এ বছর প্রশ্নবিদ্ধ হবে। মার্চ মাসে ফেড নীতিগত সুদের হার কমানো শুরু করবে। বছরের পরের অংশে অতিরিক্ত সুদহার কমানো হবে। কেউ ২০২৪ সালে মন্দা আশা করুক বা না করুক (আমি এখনো করি), মূল্যস্ফীতির বর্তমান পথ, সুদের নিরপেক্ষ হারের সম্ভাব্য স্তর এবং সামগ্রিক চাহিদার সম্ভাব্য গতিপথের কারণে সুদহার কমানো একটি যুক্তিসঙ্গত পূর্বাভাস। তবে ২০২৪ সাল মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বছর। ট্রাম্প যদি রিপাবলিকান পার্টির মনোনীত প্রার্থী হন, আশা করা যায়, তিনি সুদ হার কমিয়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে নির্বাচনে সহায়তা করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলবেন। কংগ্রেস সদস্য এবং মূল কমিটির প্রধানসহ তার সমর্থকবাহিনীর কাছ থেকে এটিই প্রত্যাশা করা যায়।
সিনান উলগেন
ব্রাসেলসভিত্তিক ইউরোপীয় গবেষক সিনান উলগেনের মতে, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে এটি পশ্চিমা গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর হবে। আপাতদৃষ্টিতে আরও র্যাডিক্যাল ও পপুলিস্ট আন্দোলনের অপ্রতিরোধ্য উত্থান আটলান্টিকের উভয় পাশের রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করবে। তবে আমি ভবিষ্যদ্বাণী করছি, অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি এবং মুদ্রাস্ফীতির চাপ কমানোর ক্ষেত্রে মধ্যপন্থিরা সহায়তা করতে পারে। আসন্ন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাগুলো আমাদের কীভাবে নতুন আন্দোলন মোকাবিলা করতে হয় তার একটি পরিষ্কার ধারণা দেবে এবং সেই পাঠ আমাদের গণতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি অখণ্ডতা রক্ষায় সহায়ক হবে।
ইলোনা জাবো
ব্রাজিলের রাজনীতি বিজ্ঞানী ইলোনা জাবো বলেন, ২০২৪ সালে ডিজিটাল ও সবুজ প্রযুক্তি, জলবায়ু অর্থায়ন এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি ঘটতে পারে। তবে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, এশিয়া ও আমেরিকায় রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং ক্রমবর্ধমান সংঘাতের কারণে সেখানকার পরিস্থিতি অনেক ভঙ্গুর। ব্যালট বাক্সে কী ঘটবে তার ওপরও এর অগ্রগতি নির্ভর করে। ৭০টিরও বেশি দেশে নির্বাচন, যেখানে ৪.২ বিলিয়নেরও বেশি ভোটার থাকবে। ২০২৪ সালটি কার্যত বিশ্বের জন্য নির্বাচনের বছর। পপুলিস্টরা সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে যা কিছু করতে পারে তারা ভোটে জিততে ব্যবহার করছে। এমন একটি সময়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সহযোগিতা-সহমর্মিতার সুযোগ সন্ধান করাটা আগের চেয়ে আরও বেশি জরুরি।