Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

ভারতে ফের আলোচনায় নাগরিকত্ব আইন

Icon

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২৪, ০৯:৪২

ভারতে ফের আলোচনায় নাগরিকত্ব আইন

মোদি আমলে নাগরিকত্ব আইন নিয়ে বিদ্বেষের রাজনীতি আরও চাঙ্গা হচ্ছে ছবি: দ্য হিন্দু

ভারতে গত বছর থেকেই লোকসভা নির্বাচনের আবহ চলছে। আর ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে ভোট মানেই যেন বিভাজন ও বিদ্বেষের নিত্যনতুন অস্ত্রের ঝনঝনানি। এবার এই অস্ত্রের নাম নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ)। ওই আইন অনুযায়ী—পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় উৎপীড়নের কারণে পালিয়ে আসা মুসলিম বাদে অন্য ছয়টি ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের (হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, পার্সি, খ্রিষ্টান) মানুষকে ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কেন ওই তালিকায় মুসলিমদের নাম নেই, তা নিয়ে পথে নামে সংখ্যালঘু সমাজ এবং বিরোধী দলগুলো। এতে মুসলিমদের প্রতি বৈষম্য হচ্ছে ও তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করার চেষ্টা হচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠে।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে সংসদে সিএএ পাস হয়েছিল। সিএএ-এর প্রতিবাদে দেশজুড়ে বিক্ষোভ ও সহিংসতায় ৮৩ জনের মৃত্যু হয়। দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, আসামের মতো বেশ কিছু রাজ্যে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছিল। বিরোধী শিবির মনে করছে, লোকসভা ভোটের ঠিক আগে সিএএ বিতর্ক বাজারে নিয়ে আসবে বলেই এত দিন নরেন্দ্র মোদি সরকার সিএএ নিয়ে টালবাহানা করছিল। ভোটের আগে সিএএ কার্যকর করার চেষ্টা হলে আবারও সহিংসতা-অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। আর এ থেকে বিজেপিই ফায়দা তুলবে।

২০১৪ এবং ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে ক্ষমতায় আসতে উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল বিজেপি। ২০১৯ সালে মোদি দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর পার্লামেন্টের দুই কক্ষে পাস হয়েছিল নাগরিক সংশোধনী বিল (সিএবি)। এরপর চার বছর হয়ে গেলেও সেই বিষয়ে বিধিমালা তৈরি করা হয়নি। ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসের আগেই সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিধিমালা তৈরি করে ফেলতে চাইছে মোদি সরকার। যাতে ভোট ঘোষণার আগেই ওই আইনের মাধ্যমে প্রতিবেশী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো থেকে ধর্মীয় উৎপীড়নের কারণে পালিয়ে আসা ব্যক্তিদের নাগরিকত্ব প্রদান শুরু করা সম্ভব হয়।

ভারতের পার্লামেন্টে কোনো আইনের বিল পাসের ছয় মাসের মধ্যে বিধিমালা তৈরি না হলে লোকসভা ও রাজ্যসভার বিধিমালা বিষয়ক কমিটির কাছে সময় বাড়ানোর অনুমতি চাইতে হয়। এখন পর্যন্ত অমিত শাহের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আটবার এই অনুমতি নিয়েছে। গত বছরের ২৬ নভেম্বর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্র টেনি পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে বলেছেন, ‘সিএএ কার্যকর হবে।’ এ বছরের ৩০ মার্চের আগে সিএএ বিধিমালার খসড়া চূড়ান্ত হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘লোকসভার বিধিমালা কমিটি আগামী বছরের ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। রাজ্যসভার বিধিমালা কমিটি ৩০ মার্চ পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে সেপ্টেম্বর মাসেই বলা হয়েছিল, লোকসভা ভোটের আগে সিএএ-এর বিধিনিয়ম চূড়ান্ত করে ফেলার চেষ্টা চলছে। শীর্ষ স্তরে নিয়মিত বৈঠক, কাজকর্ম চলছে। কবে সিএএ-এর বিধিমালা চূড়ান্ত হবে, তা রাজনৈতিক স্তরে সিদ্ধান্ত হবে। ইতোমধ্যে সিএএ-তে নাগরিকত্বের আবেদনের জন্য পৃথক একটি পোর্টাল তৈরির কাজ চলছে। সেখানে যোগ্যতা, মাপকাঠিও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা থাকবে।’

গত ২৬ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের জাতীয় গ্রন্থাগারের ভাষা ভবনে অমিত শাহ বলেন, “দেশের সব রাজ্যে যেন আমাদের ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সরকার তৈরি হয়, সেটাই আমাদের লক্ষ্য। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ এদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সরকার তৈরির মানে হলো অনুপ্রবেশকারীদের ঢোকা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং অনুপ্রবেশকারীদের ‘সিল’ করে দেওয়া। বাংলায় বিজেপি সরকার তৈরি হওয়ার মানে গরুপাচার বন্ধ হয়ে যাওয়া। বাংলায় বিজেপি সরকার তৈরির মানে শরণার্থীদের সিএএ-এর মাধ্যমে নাগরিকত্ব দিয়ে দেওয়া।’’ তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে উদ্দেশ করে বলেন, ‘দিদি বেশ কয়েকবার আমাদের শরণার্থী ভাইদের বিপথে চালনা করছেন। সিএএ হবে কি না হবে, আইন বানিয়ে থেমে যাওয়া নিয়ে কথা বলেন। আজ আমি আপনাদের সবার সামনে বলে যাচ্ছি, সিএএ এই দেশের আইন। একে কেউ রুখতে পারবে না। সবাই নাগরিকত্ব পাবেন।’

গত চার বছরে ভারতজুড়ে ভয়ের আবহ তৈরি করেছে এই আইন। একই সঙ্গে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের আগুনও জ্বালিয়েছে। করোনা মহামারি এসে সাময়িক ছেদ টানার আগে এই নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে তুমুল আন্দোলিত হয়ে উঠেছিল দিল্লি এবং ভারতের নানা অঞ্চল, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু মহামারি শেষে অনেক বার পার্লামেন্টে অধিবেশন বসলেও এই আইন নিয়ে আলোচনার বিন্দুমাত্র প্রচেষ্টা হয়নি। ভোটের প্রহর ঘনিয়ে আসায় পশ্চিমবঙ্গ থেকেই নাগরিকত্ব প্রদানের কাজ শুরু হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন অমিত শাহ। ওই আইনের যে প্রকৃত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, পশ্চিমবঙ্গেই তা সবচেয়ে সার্থক হওয়ার কথা। এই আইন কার্যকর করে দুই দিক দিয়ে এ রাজ্যে ‘সাফল্য’ পেতে পারে বিজেপি। 

ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিদ্বেষ ছড়ানো ও তাদের বিতাড়নযোগ্য বলে প্রমাণ করার পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গে আরও একটি উদ্দেশ্য রয়েছে বিজেপির। তা হলো—নাগরিকত্ব আইন প্রয়োগে নিয়ে এসে মতুয়া ভোট নিজের ঝুলিতে নেওয়া। বিজেপির প্রতিশ্রুতিতে সীমান্ত-পেরোনো মতুয়া জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করার একটি প্রকল্প নিহিত আছে। এই অধিকার অনেক দিন থেকে তারা চেয়ে আসছে; কিন্তু বিবিধ রাজনৈতিক দল নিজ নিজ স্বার্থে তাদের ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহার করলেও তাদের নাগরিকত্ব সমস্যার সমাধান করা যায়নি। এর কিছু বাস্তব সংকট আছে। ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব আইনের মতো ২০১৯ সালের সংশোধিত আইনও নিশ্চয়তা দিতে পারেনি, কোন কাগজ দেখিয়ে এই দেশান্তরিত মানুষ ভারতে নিজেদের আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠা করবেন। সম্প্রতি আসামে যেভাবে এনআরসি তালিকা তৈরির চেষ্টা হয়েছে, তাতেও সিএএ নিয়ে আতঙ্ক অনেক গুণ বেড়েছে। ‘বৈধ’ কাগজপত্র দেখাতে না পারার কারণে পশ্চিমবঙ্গেও মতুয়াদের অনেকেই অধিকারচ্যুত হতে পারে, সে আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর এতে কেন্দ্রীয় শাসক দলের স্বার্থই কেবল রক্ষা হতে পারে।

২০১৯ সালে সংশোধিত আইন অনুযায়ী, প্রতিবেশী দেশগুলোর যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা (মুসলিম বাদে) ভারতে চলে এসেছেন, তাদের নাগরিকত্ব প্রদানের সূত্রে মুসলিমদের আলাদা করার কাজ শুরু হবে। দেশটিতে ভোটের প্রচারে অস্ত্র হিসেবে মেরুকরণের কার্যকারিতা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত। সুতরাং আরও একবার তার আশ্রয় নেওয়াই আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে বিজেপির লক্ষ্য। ‘মুসলিম’রা যদি অন্য দেশে উৎপীড়িত হয়ে এ দেশে এসে থাকেন, তা হলে তাদের কেন নাগরিকত্বের অধিকার দেওয়া হবে না—এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর নেই। অথচ বাস্তবতা হলোপাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ থেকে সিন্ধি বা মুহাজির মুসলিমরা, এমনকি শিয়া-সুন্নিরাও কখনো কখনো ধর্মীয় কারণে উৎপীড়নের শিকার হয়ে চলে এসেছেন সীমানা পেরিয়ে। ধর্মের ভিত্তিতে তাদের এভাবে নাগরিকত্বের অধিকার থেকে বিচ্যুত করা ভারতের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করা হচ্ছে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫