
স্কুল ও শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি ধসে পড়ার পরও গাজার শিশুরা অস্থায়ী শিবিরে পড়ছে। ছবি: এএফপি
গাজায় প্রতি ১০টির মধ্যে আটটি স্কুলই ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে। ইউনিসেফ বলছে, যুদ্ধের কারণে এ অঞ্চলের প্রায় ১২ লাখ শিশুর যে মানসিক ক্ষতি হয়েছে, তাতে বিশেষজ্ঞরা শঙ্কিত। ডক্টরস উইদাউট বর্ডারসের শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অড্রে ম্যাকমোহন বলেছেন, ‘শিখতে সক্ষম হওয়ার জন্য আপনাকে একটি নিরাপদ স্থানে থাকতে হবে। এ মুহূর্তে গাজার বেশিরভাগ শিশুর মস্তিষ্ক মানসিক আঘাতে বিপর্যস্ত।
অল্পবয়সী শিশু অপুষ্টি থেকে আজীবন মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যায় পড়ছে। যখন কিশোর-কিশোরীরা তাদের ওপর হওয়া অবিচারের জন্য ক্ষুব্ধ হয়, তা অনুভব করতে পারে, তখন এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব রয়েছে। অগাধ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে; আর তা নিরাময় করতে দীর্ঘ সময় লাগবে।’
যুক্তরাজ্যভিত্তিক দাতব্য সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের পরিচালক ডেভিড স্কিনার বলেছেন, ‘স্কুলগুলোকে পুনর্নির্মাণ করা অনেক কঠিন। তবে শিশুদের ট্রমা এবং শিক্ষা ব্যবস্থার যে ক্ষতি হয়েছে, তা মোকাবিলা করার চেয়ে স্কুলগুলো পুনর্নির্মাণ করা অনেক সহজ। গাজার কথা প্রচারের ক্ষেত্রে প্রায়ই যা হারিয়ে যায় তা হলো এটি শিশুদের জন্য একটি বিপর্যয়। তারা এমন শিশু যারা শোকাহত, যারা আপনজন হারিয়েছে, যারা অসুস্থ এবং অপুষ্টিতে ভুগছে।’
জাতিসংঘের শিশু কল্যাণ সংস্থার মতে, গাজায় অন্তত ৬ লাখ ২০ হাজার শিশু স্কুলের বাইরে রয়েছে। স্কিনারের মতে, শিশুদের ক্লাসে ফিরিয়ে নিয়ে আসা এবং স্কুল পুনর্নির্মাণ হলো প্রথম পদক্ষেপ। তবে প্রকৃত চ্যালেঞ্জ হবে বাস্তুচ্যুত এবং আঘাতপ্রাপ্ত কিশোরদের সুস্থ করা, যাতে তারা আবার শিখতে স্কুলে আসতে পারে।
ইসরায়েল গাজায় চালানো সাম্প্রতিক আগ্রাসনে এখন পর্যন্ত ৩৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। যুদ্ধ শুরুর পর স্কুলে ক্লাস নেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। বেশিরভাগ স্কুলই বিমান হামলা থেকে পালিয়ে আসা পরিবারের আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয়। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের প্রায় অর্ধেক অধিবাসীই ১৮ বছরের কম বয়সী। গত ২০ বছরে ইসরায়েলের পাঁচটি বড় আগ্রাসনে এমনিতেই সেখানকার শিক্ষা ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। এবারের আগ্রাসনে গাজার ৫৬৩টি স্কুল ভবনের মধ্যে অন্তত ৫৩টি ধ্বংস হয়েছে বলে জানিয়েছে ইউনিসেফ।
স্যাটেলাইট ইমেজ এবং সরেজমিন প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে ইউনিসেফসহ সাহায্য সংস্থাগুলো জানিয়েছে, প্রতি ১০টির মধ্যে আটটির বেশি স্কুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ৬৭ শতাংশ স্কুলে সরাসরি হামলা চালানো হয়েছে। জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ গাজার প্রায় তিন লাখ শিশুকে শিক্ষা প্রদান করে। সংস্থাটির কমিউনিকেশন ডিরেক্টর জুলিয়েট তোমা বলেন, ‘এটি এক নজিরবিহীন পরিস্থিতি। যে সহকর্মীরা এখানে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে আছেন তারাই হয়তো বুঝবেন, এ ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যে একটি স্কুলও ছিল।’
মাজিদ হালাওয়া গাজা সিটির বাসিন্দা। ধ্বংসযজ্ঞের মুখোমুখি হতে ১৬ বছরের এ তরুণের বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি। তার আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন ইসরায়েলি বোমার আঘাতে স্থগিত রয়ে গেল। ইসরায়েলি আগ্রাসন শুরুর দুই সপ্তাহ পর তাকে এবং তার পরিবারকে তাদের অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে যেতে ৩ মিনিট সময় দেওয়া হয়। মাজিদ বলেন, ‘আমি সব বই ছেড়ে এসেছি, ভেবেছিলাম ফিরে যেতে বেশি সময় লাগবে না, কিন্তু এমনটি হয়নি।’ বিমান হামলায় তাদের বাড়ি ও তার স্কুল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
দক্ষিণাঞ্চলীয় রাফাহ শহরে তাঁবুতে অস্থায়ী স্কুল স্থাপন করা হয়েছে। ওই শহরে এখন গাজার অর্ধেক মানুষ পালিয়ে এসেছে। একটি তাঁবুতে হিবা হালাওয়েহ ৩০ জন শিশুকে তাদের প্রথম শব্দ পড়তে শেখাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ‘পাঠ্যপুস্তক বা কলম না থাকলেও শিশুরা পড়াশোনায় ফিরে আসতে পেরে খুশি।’ গাজার শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ ধরনের ২৫ হাজার অস্থায়ী স্কুলের পরিকল্পনা করেছে। বিশ্বের অন্য কোথাও যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করে এত শিশুদের স্কুলে ফিরে আসতে দেখা যায় না। ইরাকে সন্ত্রাসী সংগঠন ইসলামিক স্টেটের পতনের ছয় বছর পর লাখ লাখ শিশু এখনো স্কুলের বাইরে রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মতে, হাজারো ধ্বংসপ্রাপ্ত স্কুল ভবন এখনো পুনর্নির্মাণ করা হয়নি।