Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

ইরান-ইসরায়েলের যুদ্ধখেলা

Icon

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

প্রকাশ: ০২ মে ২০২৪, ১৭:১২

ইরান-ইসরায়েলের যুদ্ধখেলা

জিয়াউদ্দীন আহমেদ। ফাইল ছবি

সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেট ভবনে ইসরায়েলের হামলায় ১১ ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে এলিট ফোর্স কুদসের সিনিয়র কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদি এবং তার সহযোগী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ হাদি হাজি-রহিমিও রয়েছেন।

সিরিয়ায় আমেরিকা ও রাশিয়ার সামরিক ঘাঁটি থাকলেও ইরান তাদের সামরিক ঘাঁটি থাকার কথা অস্বীকার করেছে, তবে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সেনাবাহিনীকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য ইরানের যে কয়েকজন সেনা পাঠানো হয়েছিল তারা এখনো আছে। আমেরিকা এবং ইসরায়েলের অভিযোগ হচ্ছে এই সকল সামরিক উপদেষ্টা ইরান সমর্থিত সিরিয়ার সশস্ত্র শিয়া মিলিশিয়া বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এবং তারাই সিরিয়া থেকে ইসরায়েলে রকেট নিক্ষেপ করে থাকে। তাই আমেরিকা এবং ইসরায়েল নিয়মিত সিরিয়ার অভ্যন্তরে শিয়া মিলিশিয়াদের উপর বিমান হামলা চালায়। এবার ইসরায়েল শিয়া মিলিশিয়াদের উপর নয়, খোদ ইরানের সামরিক উপদেষ্টাদের উপর বোমা ফেলেছে। ইসরায়েল মনে করে সিরিয়ায় ইরানের কনস্যুলেট ভবনটি কূটনৈতিক কনভেনশন দ্বারা পরিচালিত হয়নি, কারণ ইরানের ইসলামিক রেভ্যুলশনারি গার্ডের সদস্যরা সেটিকে একটি সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত করেছিল। ইরানের কনস্যুলেটে ইসরায়েলের হামলা ছিল আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। কিন্তু আমেরিকা বা তাদের মিত্ররা এই হামলার নিন্দা করেনি। ইরান ব্যতীত অন্য কোনো দেশের দূতাবাসে এভাবে বোমা মেরে কূটনীতিকদের মেরে ফেলার নজির আমার জানামতে আর নেই। ১৯৭৯ সালে ইরান ইসলামি বিপ্লবীদের দখলে চলে গেলে ইরানের শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি মিশরে পালিয়ে যান; তাকে ফেরত দেওয়ার দাবি তুলে ইরানি বিপ্লবীরা আমেরিকান দূতাবাস দখল করে ৫২ জন কূটনীতিককে ৪৪৪ দিন জিম্মি করে রেখেছিল; কিন্তু দূতাবাসে আক্রমণ করেনি। ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী দূতাবাসে আক্রমণ করা যায় না, কারণ কূটনৈতিক মিশনের সুরক্ষা নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। দূতাবাস এবং কূটনীতিকরা এত বেশি অধিকার ও স্বাধীনতা ভোগ করে যে, হোস্ট কান্ট্রির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিনা অনুমতিতে দূতাবাসে প্রবেশ করতেও পারে না। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের গোপন তথ্য ফাঁসকারী উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ২০১২ সালে লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসে আশ্রয় নিয়ে ২০১৯ সাল পর্যন্ত নির্বিঘ্নে বসবাস করেন, ইকুয়েডর দূতাবাসে অবস্থানকালীন তার দুটি সন্তানেরও জন্ম হয়। সিরিয়ার অভ্যন্তরে ইরানি দূতাবাসকে রক্ষা করার দায়িত্ব ছিল সিরিয়ার; কিন্তু আইএসের আক্রমণ ও দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধে সিরিয়া একেবারেই বিধ্বস্ত, রাশিয়া সমর্থন না করলে বিদ্রোহীদের হাতে বাশার আল আসাদ সরকারের পতন নিশ্চিত ছিল। আমেরিকা বা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার শক্তি না থাকায় সিরিয়া নিশ্চুপ।

ইসরায়েল ১৯৬৭ সাল থেকে সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখল করে রেখেছে; শুধু দখল করে রাখেনি, ১৯৮১ সালে ইসরায়েল গোলানকে নিজের অংশ করে নিয়েছে, আর গোলান মালভূমির উপর ইসরায়েলের সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে এক ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কত বড় অরাজকতা। আমেরিকা এবং ইউরোপ যত দিন ইসরায়েলকে শর্তহীন সমর্থন দিয়ে যাবে তত দিন মধ্যপ্রাচ্যে এই অরাজকতা থাকবে। 

শুধু ইসরায়েল বা আমেরিকাকে দোষারোপ করা হলে অর্ধেক সত্য বলা হয়, পুরো সত্য হচ্ছে কুর্দি দমনের নামে তুরস্কও সিরিয়ার অভ্যন্তরে প্রায়ই আক্রমণ করে। ইরান থেকে ইসরায়েলের নিকটতম দূরত্ব ১০০০ কিলোমিটার। ইরান ইদানীং নিজেকে কিছুটা শক্তিশালী ভাবছে, তাই ঘোষণা দিয়েই তারা ইসরায়েলের উপর তিন শতাধিক ড্রোন ও ক্ষেপনাস্ত্র নিক্ষেপ করে। কিন্তু ইসরায়েলের মাটিতে পড়েছে নিক্ষিপ্ত বোমা-ড্রোনের মাত্র এক শতাংশ। বাকিগুলো ইসরায়েলের ভূমিতে আঘাত হানার আগেই আকাশে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এই ধ্বংসের কাজ ইসরায়েল একা করেনি, করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স; মুসলিম দেশ জর্ডানও ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপনাস্ত্র ধ্বংস করে গর্ব বোধ করছে। এখন শোনা যাচ্ছে, সৌদি আরবও ইসরায়েলের পক্ষে কাজ করেছে। তাই ইসরায়েলের বন্ধু শুধু আমেরিকা নয়, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোও। ইরাক আক্রমণ করার সময় আমেরিকা সৌদি আরবের ভূমি ব্যবহার করেছিল, মিশরের অপ্সরীরা আমেরিকান সেনাদের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত ছিল। আফগানিস্তান আক্রমণে পাকিস্তানের ভূমি ব্যবহার করেছে আমেরিকা। লিবিয়া আক্রমণেও আরব ভূমি ব্যবহৃত হয়েছে। ইসরায়েলও ইরানের ইস্পাহান শহরে মিসাইল ছুড়েছে, তবে ইরানের মতো এত বেশি নয়। ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে ইস্পাহানের দূরত্ব সাড়ে তিনশ কিলোমিটার, এই শহর ও তার আশপাশের এলাকায় ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো অবস্থিত। ইস্পাহান শহরে হামলা চালিয়ে ইসরায়েল ইরানকে বুঝিয়ে দিল যে, তারাও ইরানের সংবেদনশীল গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার ক্ষমতা রাখে, বাড়াবাড়ি করলে পরের বারের হামলা হবে ভয়াবহ। ইসরায়েল যে ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভেদ করতে সফল হয়েছে, তা অনেকটা প্রমাণিত। আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ইসরায়েল অনেক বেশি ক্ষমতাবান, এই ক্ষেত্রে ইরানকে আরও বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

তবে সামরিক খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়েও লাভ নেই, কারণ আমেরিকা ঘোষণা দিয়েছে, ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে ইরানকে জিততে দেওয়া হবে না। গাজা যুদ্ধে আমেরিকার দূতিয়ালিতে মুসলিম দেশগুলো নীরবতা পালন করছে, ১৪ হাজার শিশুর মৃত্যুও তাদের নীরবতা ভাঙতে পারেনি। ১৯৭৩ সালের যুদ্ধে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত বলেছিলেন, ‘আমরা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারি, কিন্তু আমেরিকার বিরুদ্ধে নয়।’ ইরান আর গোলা ছুড়বে বলে মনে হয় না, কারণ পরিপূর্ণ যুদ্ধ হলে ইরান তার পারমাণবিক স্থাপনা রক্ষা করতে পারবে না। ইসরায়েল ও ইরান বছরের পর বছর ধরে রক্তক্ষয়ী ছায়া যুদ্ধে লিপ্ত। লেবাননের হেজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতি, সিরিয়া ও ইরাকের শিয়া মিলিশিয়া মাঝে মাঝে ইসরায়েলের উপর রকেট হামলা চালায়। এ ছাড়াও ১৯৯২ সালে ইরানের ঘনিষ্ঠ একটি ইসলামিক জিহাদি দল বুয়েনস আইরেসে ইসরায়েলি দূতাবাস উড়িয়ে দেয়; এতে ২৯ জন নিহত হয়। ইসরায়েলও এদের উপর বিমান হামলা করেই যাচ্ছে। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পের কয়েকজন বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে, ইরান টেরও পায়নি। কিছুদিন আগে হেজবুল্লাহ নেতা আব্বাস আল-মুসাভিকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। 

ইরানের বোমা নিক্ষেপকে পশ্চিমা বিশ্ব আগ্রাসী তৎপরতা হিসেবে আখ্যায়িত করেছে এবং এজন্য ইরানের উপর আরও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আসছে। অন্যদিকে ইরানের উপর দুইবারের আক্রমণকে পশ্চিমা বিশ্ব ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার বলে উল্লেখ করেছে; বিশ্বের মেরুকরণ স্পষ্টতই ইসরায়েলের পক্ষে। ইরানের কাছে ইসরায়েল হলো ‘ছোট শয়তান’ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে ‘বড় শয়তান’। বিগত কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলোর নানামুখী নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধের কবলে পড়ে ইরান কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। তারপরও এই মুহূর্তে ইরান এবং ইসরায়েলের যুদ্ধ চায় না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র; কারণ করোনা আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সৃষ্ট অর্থনৈতিক অস্থিরতা এখনো সম্পূর্ণ কাটেনি। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে আকাশ এবং সমুদ্রপথ কিছুটা হলেও বন্ধ হয়ে যাবে। যুদ্ধ শুরু হলে যাত্রীবাহী ও কার্গো বিমানকে নিক্ষিপ্ত গোলা এড়িয়ে চলাচল করতে হবে, বেড়ে যাবে পরিবহন খরচ। ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিলে ব্যবসা-বাণিজ্য অনেকটা স্থবির হয়ে যাবে। জ্বালানি তেলের দাম আবার দ্বিগুণ হয়ে যাবে, বিশ্ব অর্থনীতিতে পুনরায় স্থবিরতা নেমে আসবে, মূল্যস্ফীতি আবার বাড়তে থাকবে। 

রাগ হলে হুমায়ূন আহমেদ তার নাটকের চরিত্রগুলোকে গ্লাস বা কিছু একটা ধ্বংস করতে বলতেন। ইরান এবং ইসরায়েলও একই আচরণ করেছে, বোমা বর্ষণ করে নিজেদের রাগ থামিয়েছে। তাই দুই পক্ষের হামলা যতটা না শত্রুপক্ষকে শায়েস্তা করার জন্য, তার চেয়ে বেশি মুখ রক্ষার জন্য, একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ করার ইচ্ছে কারোরই নেই। ইসরায়েল তার প্রতিশোধ পর্ব নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করছে না। হামলার আগে দুটি দেশই প্রতিবেশী দেশসহ আমেরিকাকে এই মর্মে অবহিত রেখেছিল যে, হামলা হবে সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত, হামলার পর দ্বিতীয়বার তারা আর বোমা নিক্ষেপ করবে না। আমেরিকাও উভয় দেশকে আক্রমণের সম্মতি দিয়েছিল। তার পরও যাত্রার কুশীলবদের মতো হাত-পা ছুড়ে স্ব স্ব দেশের জনগণকে তুষ্ট রাখতে শীর্ষ নেতাকে বলতে হচ্ছে, ‘নেহি ছোঁড়েঙ্গে’। কিন্তু খেলা শেষ, অন্তত এবারের মতো। এটাই রাজনীতি। মধ্যপ্রাচ্যের মূল সংকট ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত-তার অবসান জরুরি।

লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫