
ভারতের পতাকা। ফাইল ছবি
ভারতে ১৯ এপ্রিল থেকে সাত ধাপের লোকসভা নির্বাচন শুরু হয়েছে। বেকারত্ব এবং মুদ্রাস্ফীতি ভারতীয় ভোটারদের প্রধান উদ্বেগ। তা সত্ত্বেও সেখানে ধর্মীয় বিভাজন, সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ অন্যতম আলোচিত বিষয়। এর জোরে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি এবারেও নির্বাচিত হয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় ফিরবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে প্রথম থেকেই অর্থনৈতিক চাপে থাকবে পরবর্তী সরকার।
ভারত বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল এবং পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি, যা বিভিন্ন সংকটে ধুঁকছে। সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুর মতে, ভারতের ২৮টি রাজ্যের মধ্যে ১৯টি রাজ্যে লোকনীতি-সিএসডিএস দ্বারা সমীক্ষা করা ১০ হাজার ভোটারের মধ্যে ২৭ শতাংশের প্রাথমিক উদ্বেগ ছিল বেকারত্ব, ২৩ শতাংশ চিন্তিত ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি নিয়ে। জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বা ৬২ শতাংশ জানান, মোদির দ্বিতীয় মেয়াদে গত পাঁচ বছরে চাকরি পাওয়া আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।
আর্থিক বিশেষজ্ঞ সংস্থা ‘সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি’ জানিয়েছে, গত অক্টোবর মাসে ভারতে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা ছিল ১০ শতাংশ, যা সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় দুই শতাংশের কিছু বেশি। আর এর আগের বছর অক্টোবরে এই হার ছিল সাত শতাংশের সামান্য বেশি। এ ধরনের সমীক্ষায় বেকার বলতে ধরা হয়, কত মানুষ কাজ চেয়ে কাজ পাচ্ছে না।
রয়টার্স পরিচালিত জরিপে অংশ নেওয়া ভারতের ২৬ জন অর্থনীতিবিদের মধ্যে ১৫ জনই মনে করেন, জাতীয় নির্বাচনের পর বেকারত্ব সমস্যাই হবে সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ। ৮ অর্থনীতিবিদ মনে করেন, গ্রামীণ ভোক্তা চাহিদাকে চাঙ্গা করাই হবে সবচেয়ে বড় সমস্যা, আর অন্য দুজন বলেছেন, মূল্যস্ফীতি ও দারিদ্র্যের কথা। সোসাইটি জেনারেল সংস্থার অর্থনীতিবিদ কুনাল কুন্ডু বলেন, ‘প্রায় এক দশক ধরে কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে ভারতীয় অর্থনীতিতে জনশক্তির অংশগ্রহণের হার (এলএফপিআর) আগের চেয়ে অনেক নিচে নেমেছে।’
২০১৪ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে মোদি বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশটির বেকারত্বের হার ইঙ্গিত দিচ্ছে, পার্থক্য গড়ার মতো যথেষ্ট সংখ্যক কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারেনি তার সরকারের প্রচেষ্টাগুলো।
এদিকে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে যখন উন্নতি নেই, তার মধ্যেই সরকার প্রধান প্রধান সব খাতে বিনিয়োগ করছে, যাতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গতি পেয়েছে। অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮.৪ শতাংশ, যা প্রত্যাশার চেয়েও অনেকটাই বেশি। ৩১ মার্চে শেষ হওয়া অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে ৭.৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলেও ধারণা করছেন রয়টার্সের জরিপে অংশগ্রহণকারী অর্থনীতিবিদরা। তবে এসব রিপোর্ট ও অর্থনীতিবিদদের তথ্য-বিশ্লেষণ অস্বীকার করে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টিভি-৯-এর এক অনুষ্ঠানে মোদি নিজের তৈরি এক রিপোর্টে দাবি করেন, ‘গত ১০ বছরে আমরা ২৫ কোটি মানুষকে দারিদ্র্যসীমা থেকে বের করে এনেছি। ভারতে প্রতিদিন দুটি করে কলেজ খুলেছে। প্রতি সপ্তাহে একটা নতুন বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছে। প্রতিদিন ৫৫ পেটেন্ট, ৬০০ ট্রেডবার রেজিস্টার করা হয়েছে। প্রতিদিন দেড় লক্ষ মুদ্রা লোন দেওয়া হয়েছে, ৩৭টি নতুন স্টার্টআপ শুরু হয়েছে। ভারতে প্রতিদিন ১৪ কিলোমিটার রেলওয়ে ট্র্যাক তৈরি করা হচ্ছে, ৫০ হাজার এলপিজি সংযোগ দেওয়া হয়েছে। প্রতি সেকেন্ডে একটি বাড়িতে পানির লাইনের সংযোগ দেওয়া হয়েছে।’
এদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, স্নাতকদের মধ্যে বেকারত্বের হার ২৯.১ শতাংশ। তবে যারা পড়তে বা লিখতে পারেন না তাদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৩.৪ শতাংশ। মাধ্যমিক পাস বা উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ১৮.৪ শতাংশ। আইএলওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতে প্রধানত যুবকদের মধ্যে বেকারত্ব দীর্ঘদিনের সমস্যা। বিশেষ করে মাধ্যমিক স্তরের বা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে এই সমস্যা দিন দিন আরও প্রকট হয়ে উঠছে। ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর রঘুরাম রাজনের মতো সুপরিচিত অর্থনীতিবিদেরা বেশ কিছুদিন ধরেই এ নিয়ে সতর্ক করে আসছেন। ভারতের দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থা যে দেশটির অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে ব্যাহত করছে, এই পরিসংখ্যান সেটিই তুলে ধরেছে।
আইএলও বলেছে, ভারতে যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার এখন বৈশ্বিক স্তরের চেয়ে বেশি। ভারতীয় অর্থনীতি নতুন শিক্ষিত যুব শ্রমশক্তির জন্য অ-কৃষি খাতে যথেষ্ট আকর্ষণীয় কর্মসংস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়নি। এই চিত্র উচ্চ এবং ক্রমবর্ধমান বেকারত্বের হারে প্রতিফলিত হয়েছে।
নারীদের মধ্যে বেকারত্ব বেশি বেড়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষিত নারীদের মধ্যে বেকারত্বের হার ৭৬ দশমিক ৭ শতাংশ, যেখানে পুরুষের হার ৬২ দশমিক ২ শতাংশ। আবার গ্রামের তুলনায় শহরাঞ্চলে বেকারত্ব বেশি। আইএলও বলেছে, ভারতে শ্রমশক্তিতে নারীদের অংশগ্রহণ বিশ্বে সর্বনিম্ন-প্রায় ২৫ শতাংশ। প্রতিবেদনে তথাকথিত গিগ জব (ফ্রিল্যান্সিং বা প্রকল্প ভিত্তিক অস্থায়ী বা খণ্ডকালীন কাজ) এবং ফুড ডেলিভারির মতো অস্থায়ী এবং স্বল্প বেতনের চাকরি বেড়ে যাওয়া নিয়ে সতর্ক করেছে আইএলও। এই বাস্তবতা কর্মীদের নিরাপত্তা এবং কাজের সুষ্ঠু পরিবেশের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।