Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

ভারতের অন্তর্বর্তী বাজেট ও নির্বাচনে উপেক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা

Icon

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ১১ মে ২০২৪, ১৭:৩০

ভারতের অন্তর্বর্তী বাজেট ও নির্বাচনে উপেক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা

প্রতীকী ছবি

ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ড ও ইশতেহারে স্বাস্থ্য খাত কখনোই গুরুত্ব পায়নি। এবারের স্বাস্থ্য বাজেটের (২০২৪-২৫) ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। মোট অর্থনৈতিক উৎপাদনের (জিডিপি) ২ শতাংশেরও কম স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় জিডিপির ১৮.৫২ শতাংশ, চীনের ৫.৫৯ শতাংশ এবং জার্মানির ১২.৮১ শতাংশ; অথচ বিশ্বের তৃতীয় শক্তিশালী জিডিপির দেশ হতে চাওয়া ভারতের অন্তত ৩ শতাংশ স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ করা উচিত। 

ন্যাশনাল হেলথ ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে (এনএফএইচএস-৫, ২০১৯-২০২১) প্রতিবেদনে ভারতে রক্তস্বল্পতা নিয়ে কিছু অস্বস্তিকর তথ্য সামনে আসে। পূর্ববর্তী এনএফএইচএস-৪-এ যেখানে ৬ থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে রক্তস্বল্পতার হার ছিল ৫৮.৬ শতাংশ। সেখানে এনএফএইচএস-৫-এ তা বেড়ে হয়েছে শহরাঞ্চলে ৬৪.২ শতাংশ, গ্রামাঞ্চলে ৬৮.৩ শতাংশ, গড়ে ৬৭.১ শতাংশ। ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের রক্তস্বল্পতার হার এনএফএইচএস-৪ থেকে এনএফএইচএস-৫-এ ৫৪.১ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছিল ৫৯.১ শতাংশ। ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে ২৯.২ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩১.১ শতাংশ। সরকারের দাবি অনুযায়ী, যেখানে খোলা জায়গায় মলত্যাগের হার ছিল শূন্য; সেখানে এনএফএইচএস-৫-এ দেখা গেছে প্রায় ১৯ শতাংশ বাড়িতে কোনো পাকা টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। ৪০ শতাংশ বাড়িতে পরিষ্কার রান্নার তেলের জোগান নেই। অধিকন্তু ৫৭ শতাংশ বাড়িতে এলপিজি বা প্রাকৃতিক গ্যাসের কোনো সংযোগ নেই।

এই জরিপের কাজ করে প্রতিবেদন তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পপুলেশন সায়েন্সেস (আইআইপিএস) নামের একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা। এর প্রধান ছিলেন আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত বিজ্ঞানী কে এস জেমস। রক্তস্বল্পতা নিয়ে করা প্রতিবেদন কেন্দ্র সরকারের বিড়ম্বনার কারণ হওয়ায় কে এস জেমসকে এক অদ্ভুত যুক্তিতে বরখাস্ত করা হয় ২০২৩ সালের জুলাই মাসে।

শুধু তাই নয়, এনএফএইচএস-৬-এ রক্ত স্বল্পতাকে অন্তর্ভুক্তই করা হয়নি। আর এবারের বাজেটে এই গোড়ার সমস্যা বাদ দিয়ে ‘সিকল সেল অ্যানিমিয়া’র গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। ঘোষণা করা হয়েছে, ২০৪৭ সালের মধ্যে এ রোগটি নির্মূল করা হবে। ২০২১ সালের তথ্যানুযায়ী, সিকল সেল অ্যানিমিয়ায় ভোগা রোগীর সংখ্যা ২ কোটির আশপাশে। আর অ্যানিমিয়া বা রক্ত স্বল্পতায় ভোগা রোগী ভারতের মোট জনসংখ্যার ৬৭.১ শতাংশ। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের সমস্যা এড়িয়ে গিয়ে এমন একটি রোগের কথা বলা হলো, যা তুলনায় অনেক কম সংখ্যক মানুষের আছে এবং এটি আন্তর্জাতিকভাবে বেশ সমীহ জাগানোর মতো একটি খবর।

ভারতে প্রাক-নির্বাচনী অন্তর্বর্তী বাজেটে নানা পপুলিস্ট (জনতোষণবাদী) প্রবণতা লক্ষণীয়। নির্বাচনের আগে এমনটা অস্বাভাবিক নয় মোটেও। করোনাকালে দেখা গেছে, ভারতের প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এক ভয়ঙ্কর আঘাতের মুখোমুখি হয়। স্বাস্থ্য খাতের ভঙ্গুরতা উন্মোচিত হয়। করোনা-উত্তর সময়ে স্বাস্থ্য খাত সুরক্ষিত রাখা নিয়ে বহু আলোচনা হলেও এ নিয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। প্রসঙ্গটি এবারের বাজেটেও অবহেলিত। এবারের অন্তর্বর্তী বাজেটে স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ রয়েছে ৯০ হাজার ১৭১ কোটি রুপি (ভারতীয় মুদ্রা)। ২০২৩-২৪-এর বাজেটের তুলনায় বরাদ্দ ২.৬ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু এর মধ্যে মুদ্রাস্ফীতিকে হিসাবে রাখা হয়নি। যদি স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ২.৫ শতাংশ বরাদ্দ হতো, তাহলে অর্থের পরিমাণ হতো ৮,১৯,০০০ কোটি রুপি। বাস্তব হিসাবে, প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্য সুরক্ষা যোজনায় বরাদ্দ হয়েছে ২,৪০০ কোটি রুপি। গত বাজেটে ছিল ৩,৩৬৫ কোটি রুপি, মুদ্রাস্ফীতির হিসাব ছাড়াই ৩৩ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। সরকারের একটি ‘ফ্ল্যাগশিপ’ প্রোগ্রাম পিএম-অভিম-এ গতবার যেখানে ছিল ৪,২০০ কোটি রুপি, এবারে বরাদ্দ হয়েছে ৪,১০৭ কোটি রুপি।

বাজেটে অল্পবয়সী মেয়েদের জরায়ুর ক্যান্সার রোধের টিকা দেওয়ার জন্য অর্থ বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে। ২২টি নতুন উন্নত মেডিক্যাল ইনস্টিটিউট তৈরির জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। গত বছর এর পরিমাণ ছিল ৬,৮৩৫ কোটি রুপি, এবার ৬,৮০০ কোটি। অথচ ২০১৪ সাল থেকে তৈরি হওয়া এ রকম ১৬টি ইনস্টিটিউট এখনো পুরোপুরি চালুই হয়নি। 

প্রসঙ্গত ব্যক্তির স্বাস্থ্য বা ‘ক্লিনিক্যাল হেলথ’ এবং জনসমষ্টির স্বাস্থ্য তথা ‘পাবলিক হেলথ’-এর মধ্যে পার্থক্য করা জরুরি। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ সুবিমল রায়ের মতে, ভারতে নিরাময়মূলক স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্য সুরক্ষার মধ্যে ভারসাম্য নেই। রোগনির্ভর চিকিৎসা, যেমনটা যুক্তরাষ্ট্রে দেখা যায়, তা সবার জন্য স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে না। এ ব্যবস্থা মূলত করপোরেশননির্ভর মডেল। এটিই এখন ভারতে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অপরদিকে জনস্বাস্থ্যনির্ভর চিকিৎসা, যা ভারতে আগে ত্রুটিবিচ্যুতি সহকারে চর্চিত হয়ে আসছিল, তাকে বাদ দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে। 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫