
ভারতের নির্বাচন। প্রতীকী ছবি
গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে স্লোভাকিয়ার নির্বাচনে ভোটের ঠিক দুই দিন আগের কথা। ন্যাটোপন্থি প্রোগ্রেসিভ স্লোভাকিয়া পার্টির শীর্ষ নেতা মিশাল সিমেস্কার একটি অডিও রেকর্ডিং ভাইরাল হয়। এতে তিনি দেশটির এক সাংবাদিক মোনিকা তোদোভার সঙ্গে আলোচনা করছেন মদের মূল্যবৃদ্ধি থেকে কীভাবে ভোটে কারচুপি করতে হয়। কীভাবে দেশের সংখ্যালঘু ভোট কিনতে হয়। তারা দাবি করেন, অডিওটি নকল।
বার্তা সংস্থা এএফপির ফ্যাক্ট চেকিং বিভাগও জানায়, এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) দিয়ে তৈরি। এদিকে ভোটের আগের ৪৮ ঘণ্টায় প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা। ধারণা করা হয়, এই ডিপফেক অডিও নির্বাচনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। নির্বাচনে হেরে যায় প্রোগ্রেসিভ স্লোভাকিয়া পার্টি।
এর আগে গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও ব্যবহার করা হয় ফেক অডিও ক্লিপ। গত নভেম্বরে আর্জেন্টিনায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রেও এআই প্রযুক্তির বেপরোয়া প্রয়োগ দেখা যায়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের নির্বাচনেও এআই প্রযুক্তির সাহায্যে নির্মিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বক্তব্য প্রচার করেছিল তার দল তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)।
বিশ্বজুড়ে নির্বাচনে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার দেখা গেছে। ভারতের মতো একটি জনবহুল দেশ, যার একটা বড় অংশই দীর্ঘদিন ধরে প্রযুক্তির নেতিবাচকতাই প্রত্যক্ষ করেছে, সেখানকার লোকসভা নির্বাচনে এর ব্যবহার, অপব্যবহার কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। সম্প্রতি এএফপির এক প্রতিবেদনে শিরোনাম করা হয়, ‘মেশিনের মধ্যে ভূত : ডিপফেকের ছায়া ভারতের নির্বাচনে।’
‘ডিপ লার্নিং’-এর মতো উন্নতমানের মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে হুবহু আসলের মতো ‘ফেক’ ভিডিও বা অডিও তৈরি করা হচ্ছে-এটিই ‘ডিপফেক’। এই প্রযুক্তি যে কোনো মানুষের মুখের অভিব্যক্তি সহজেই খুব খুঁটিয়ে পড়ে ফেলতে পারে। অনায়াসে বুঝে নিতে পারে গলার আওয়াজ। তারপর সেই বিশ্লেষণের ভিত্তিতে নিখুঁতভাবে একজনের মুখের কথা অন্যের মুখে বসিয়ে দেওয়া হয়। যেমন দেখা যাচ্ছে তামিলনাড়ুতে। এডিএমকে নেত্রী জয়ললিতা মারা গেছেন ২০১৬ সালে। কিন্তু এখন তার গলায় শোনা যাচ্ছে রাজ্যের শাসকদল ডিএমকের সমালোচনা। বিজেপি এর মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাষণ ভাষান্তর করেছে আটটি আঞ্চলিক ভাষায়। এআই ইমেজে মোদিকে আট ভাষায় ভাষণ দিতে দেখা গেছে। সে অর্থে এবারের নির্বাচন হতে চলেছে ভারতের প্রথম এআই নির্বাচন।
একুশ শতকের গোড়ায় ভারত দেখে নির্বাচনে গণহারে মোবাইল ফোনের ব্যবহার। ২০১৪ সালে ভারতে প্রথম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তরুণ প্রজন্মকে ধরতে বিজেপি ফেসবুক, টুইটার ব্যাপকভাবে ব্যবহার করে। ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত হয় হোয়াটসঅ্যাপ নির্বাচন। রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাজদীপ সারদেশাই তার বই ‘২০১৯ : হাউ মোদি ওন ইন্ডিয়া’তে দেখিয়েছেন, তখন হোয়াটসঅ্যাপ পরিণত হয় নিরবচ্ছিন্ন রাজনৈতিক প্রচারের আদর্শ পাইপলাইনে। আর এ ক্ষেত্রে বিজেপির আইটি সেল বিশেষ ভূমিকা পালন করে। আর ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে প্রথম এআই নির্বাচন।
বিজেপি ও গণমাধ্যম/সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মধ্যে সম্পর্ক সংক্রান্ত আলোচনায় ফ্রন্টলাইন পত্রিকায় লেখা ‘এ লিপ ফর ইন্ডিয়ান ডেমোক্রেসি’ নিবন্ধে সতীশ দেশপান্ডে বলেন, ‘ডিজিটাল যুগে একটি পণ্য হিসেবে মিডিয়া মনোপলির বিপুল সুবিধা রয়েছে মোদি জামানার হাতে। তা সে প্রকাশ্যে ইলেকট্রনিক মাধ্যমের ক্ষেত্রেই হোক; আর গোপনে আইটি সেলের দুরন্ত দক্ষ আন্ডারগ্রাউন্ড নেটওয়ার্কই হোক। সেই সঙ্গে রয়েছে ডিজিটাইজড রাষ্ট্রে নিবিড় নজরদারির লক্ষ্যে নির্লজ্জভাবে জবরদস্তি প্রয়োগের ক্ষমতা।’
ভুয়া কনটেন্ট প্রকাশ্যে আনাটা কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলেই জানিয়েছেন ফ্যাক্ট-চেকাররা। নির্বাচনের সময় যখন ভুল তথ্য ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়তে থাকে সে সময় এই কাজটা আরও কঠিন হয়ে পড়ে। শ্রীনিবাস কোদালি নামে এক বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, ‘ভুয়া কনটেন্ট মূলধারার মিডিয়াতেও ছড়িয়ে পড়ছে। তা সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রকাশ্যে নীরবতা পালন করছে। এর জন্য কোনো আইন নেই। কোনো আইন-কানুন তৈরি করার বদলে তারা বিষয়টি প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর স্বনিয়ন্ত্রণের ওপর ছেড়ে দিয়েছে।’
ভারতের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এস ওয়াই কুরেশি বলেন, ‘এই মুহূর্তে যারা ভুয়া ভিডিও অন্যদের পাঠাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে যদি ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তাহলে হয়তো অন্যরা যাচাই না করা তথ্য শেয়ার করতে ভয় পাবে। গুজব বরাবরই নির্বাচনী প্রচারের সঙ্গে মিশে ছিল। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এটা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে পারে। গোটা দেশে এই আগুন ছড়িয়ে পড়ার ভয় রয়েছে।’