
‘ভারত জোড়ো নবযাত্রা’য় রাহুল গান্ধী। ছবি: সংগৃহীত
ভারতের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ও সরকারবিরোধী দলগুলোর ঘুরে দাঁড়ানো বহু মানুষের মধ্যে আশা জাগিয়েছে। এবারের নির্বাচনে কংগ্রেসের আসন বেড়ে চার বছর আগের নির্বাচনের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। জোটগতভাবেও এগিয়েছে কংগ্রেস। তাদের ইন্ডিয়া জোট পেয়েছে ২৩৩ আসন। আর এতে বড় ভূমিকা ও নেতৃত্ব ছিল রাহুল গান্ধীর। ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ ও ‘ভারত জোড়ো নবযাত্রা’র মাধ্যমে কংগ্রেস ও জোটের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের চাঙা করেছেন। তবে এই জোটকে এখনো বিজেপিকে টক্কর দেওয়ার মতো শক্তিশালী বলে মনে করছেন না বিশ্লেষকরা। বিরোধীদলীয় নেতা হওয়ার পর রাহুলের ওপর এখন গুরুদায়িত্ব নিজ দল কংগ্রেসের সঙ্গে ইন্ডিয়া জোটকে টিকিয়ে রেখে শক্তিশালী করার।
২৬ জুন লোকসভার স্পিকার হিসেবে নামকরণের পর ওম বিড়লার প্রথম কাজগুলোর মধ্যে একটি ছিল রাহুলকে ৯ জুন থেকে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া, সেদিনই কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি তার নির্বাচন ঘোষণা করে। ২৬ জুন এক ভিন্ন রাহুলকে দেখা যায়। নৈমিত্তিক সাদা টি-শার্ট নয়, সেদিন তাকে দেখা যায় আনুষ্ঠানিক কুর্তা-পায়জামা পরতে। ইন্ডিয়া জোট কে সুরেশকে প্রার্থী করলেও লোকসভায় ধ্বনি ভোটে স্পিকার পদে নির্বাচিত হন ওম বিড়লা। তারপর এনডিএর পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী যেমন ওম বিড়লাকে অভিনন্দন জানান, তেমনই তাকে শুভেচ্ছা জানান রাহুল। তখনই পার্লামেন্টে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে হাত মেলান লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল, যাদের সম্পর্ক ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সাপে-নেউলে বললেও অত্যুক্তি হয় না। ২০১৮ সালের জুলাই মাসেও মোদির সঙ্গে করমর্দন করেন রাহুল। তবে এবারের এই সৌহার্দ্য শুধু প্রথাগত ছিল। দুই নেতা কুশল বিনিময় করেননি এবং কংগ্রেস আনুষ্ঠানিকভাবে মোদিকে পার্লামেন্টের নেতা নির্বাচিত করার পর অভিনন্দন জানায়নি। বিজেপির তরফ থেকেও রাহুলকে বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচনের কোনো অভিনন্দন ছিল না।
আগামী পাঁচ বছরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগপ্রাপ্তদের বাছাই করতে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতাকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একসঙ্গে বসতে হবে। রাহুল পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির (পিএসি) চেয়ারম্যানও হতে পারেন, যিনি ভারতের কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) প্রতিবেদনগুলো যাচাই করবেন। তবে কে সুরেশকে স্পিকার নির্বাচনের জন্য মনোনীত করার কথা তৃণমূল কংগ্রেস (টিএমসি) বা শরদ পাওয়ারের জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস পার্টি (এনসিপি) আগে থেকে জানত না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও শরদ পাওয়ার দুজনই বলেছেন, সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তাদের কিছু জানানো হয়নি। জোটে যোগাযোগ এখনো ভালো নয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামলে জরুরি অবস্থা জারির ৫০তম বার্ষিকী উপলক্ষে বিড়লা যখন একটি নিন্দা প্রস্তাব পাঠ করেছিলেন তখন বিরোধীদের মধ্যেও মতভেদ দৃশ্যমান হয়। তিনি কংগ্রেস ও ইন্দিরা গান্ধীর নাম উল্লেখ করে নিন্দা জানাতে প্রস্তাব করেন। কংগ্রেস প্রতিবাদ করলেও ইন্ডিয়া জোটের সমাজবাদী পার্টি (এসপি), টিএমসি, ডিএমকে এবং বাম দলগুলো কংগ্রেস সদস্যদের সঙ্গে যোগ দেয়নি। তারা বসে ছিলেন, যা ইঙ্গিত করে যে তাদের এ প্রস্তাব নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। পরের দিন কংগ্রেস কিছু প্রতিরোধ গড়ে তোলে। জোটের অংশীদারদের নিয়ে প্রস্তাব করে যে, এভাবে প্রস্তাব করার প্রয়োজন নেই। ইন্ডিয়া জোটের দলগুলোর একসঙ্গে ৯৬ আসন রয়েছে, যেখানে কংগ্রেসের দখলে ৯৯ আসন।
এসপি হলো পূর্ববর্তী সমাজতন্ত্রপন্থি দল। ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামলে সংবিধান স্থগিত হওয়ার ১৯ মাস সময় দলটির নেতারা কারাগারে ছিলেন। ডিএমকের অনেক নেতাও কারাবাসে ছিলেন। তৃণমূল কংগ্রেসের মমতা, তৎকালীন যুব কংগ্রেসের কর্মী, ১৯৭৫ সালে জাতীয় লাইমলাইটে উঠেছিলেন যখন সংবাদপত্রগুলো জরুরি অবস্থা বিরোধী জয়প্রকাশ নারাইনকে বহনকারী গাড়ির বনেটে প্রতিবাদে তার নাচের ছবি ছড়িয়ে দিয়েছিল। ওম বিড়লার নিন্দা প্রস্তাবে টিএমসির সমর্থন কংগ্রেস থেকে স্বাধীন সত্তা, নিজস্ব পরিচয় জাহির করার চেষ্টা বলা যেতে পারে।
বিরোধী নেতা হওয়ার পরপরই রাহুল স্যাম পিত্রোদাকে ওভারসিজ কংগ্রেসের প্রধান হিসেবে পুনর্বহাল করেন। বিজেপির মুখপাত্র সি আর কেসাভান, যিনি গত বছর পর্যন্ত কংগ্রেস নেতা হিসেবে কাজ করেছিলেন, পিত্রোদার পুনর্নিয়োগকে দুই মাস আগে তার বর্ণবাদী মন্তব্যের কারণে যারা দুঃখিত হয়েছিল তাদের জন্য একটি ‘গুরুতর অপমান’ বলে বর্ণনা করেছেন।
তবে যা-ই হোক না কেন, ভোটযুদ্ধের পরও রাজনীতির লড়াই চলমান থাকে। আর মোদির মতো শক্তিশালী নেতৃত্বকে টক্কর দেওয়ার জন্য রাহুলের যেমন বিরোধীদের সঙ্গ প্রয়োজন; তেমনি বিরোধীদেরও রাহুল ও কংগ্রেসকে প্রয়োজন। তবে এ ক্ষেত্রে রাহুলের দায়িত্বই বেশি। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলাম লেখক শুভব্রত ভট্টাচার্য বলেন, ‘রাহুলকে যেমন নিজ দলকে শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ করতে হবে তৃণমূল পর্যায় থেকে; তেমনি এক নড়বড়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ জোটকেও ঐক্যবদ্ধ রেখে নেতৃত্ব দিতে হবে। আগামী কয়েক বছর রাহুলের জন্য এটিই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।’