Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

শ্রমিক পরিবার থেকে প্রধানমন্ত্রী

Icon

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৪, ১২:২১

শ্রমিক পরিবার থেকে প্রধানমন্ত্রী

কিয়ার স্টারমার ও তার স্ত্রী ভিক্টোরিয়া। ছিবি: সংগৃহীত

দীর্ঘ ১৪ বছর পর ব্রিটেনের ক্ষমতায় লেবার পার্টি। আর এই জয়ের নায়ক কিয়ার স্টারমার। নিন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া কিয়ার স্টারমার নানা সংকট আর অর্থনৈতিক সংগ্রামের মধ্য বেড়ে ওঠেন। তবে তিনি দমে যান নি। এগিয়েছেন জীবন গড়ার জন্য। অবশেষে  নিরলস পরিশ্রম আর কঠোর তপস্যা অবশেষে তাকে এনে দিলো চূড়ান্ত সাফল্য।

কিয়ার স্টারমার ১৯৬২ সালে ২ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারের চার সন্তানের মধ্যে একজন, কিয়ার স্টারমার বেড়ে ওঠেন দক্ষিণ–পূর্ব ইংল্যান্ডের সারে–তে। তার বাবা একটা কারখানার সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক হিসাবে কাজ করতেন এবং মা ছিলেন নার্স। তার পরিবারও কট্টর লেবার পার্টির সমর্থক ছিল, যার প্রতিফলন পাওয়া যায় তার নামে। লেবার পার্টির প্রথম নেতা স্কটিশ খনি শ্রমিক কিয়ার হার্ডির নাম অনুসারে তার নাম রাখা হয়েছিল।

বড় হয়ে ওঠার সময় স্যার কিয়েরের পারিবারিক জীবন খুব সুখকর ছিল না। তাদের সঙ্গে দূরত্ব রেখে চলতেন তার বাবা। তার মা জীবনের দীর্ঘকাল 'স্টিল'স ডিজিজ' নামক এক ধরনের অটো-ইমিউন ডিজিজে ভুগেছেন। রোগের কারণে ধীরে ধীরে হাঁটার এবং কথা বলার ক্ষমতা হারান তার মা। একসময় তার পা কেটে বাদ দিতে হয়েছিল। 

অল্প বয়সে স্টারমার যোগ দেন রাজনীতিতে। ১৬ বছর বয়সে লেবার পার্টির স্থানীয় যুব শাখায় যোগ দেন তিনি। পাশাপাশি পড়াশুনাও চলতে থাকে সমান তালে। পরিবারের প্রথম সদস্য হিসেবে উচ্চ শিক্ষা লাভ করতে লিডস এবং অক্সফোর্ডে পড়াশুনা করতে যান তিনি। ওই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। এসময় তিনি কিছু সময়ের জন্য উগ্র বামপন্থী একটি পত্রিকার সম্পাদনাও করেছিলেন। তবে তা কিছুদিন মাত্র। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রী নিয়ে ব্যারিস্টার হন। মানবাধিকার নিয়ে কাজ শুরু করেন। 

কর্মজীবনের শুরুতেই তিনি সেই সময়ে ক্যারিবিয়ান এবং আফ্রিকার দেশগুলিতে মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্তির জন্য কাজ করেন। 

২০০৮ সালে, স্টারমার পাবলিক প্রসিকিউশনের ডিরেক্টর এবং ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিসের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পান। ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি চাকরি করেন। ২০১৪ সালে ফৌজদারি বিচারপ্রক্রিয়ায় অবদান রাখায় তাকে ‘নাইট’ উপাধি দেওয়া হয়। এতো কিছুর পাশাপাশি তিনি লেবার পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে কাজ করে গেছেন। 

এর ফল মিলে ২০১৫ সালে। পার্টির এমপি হিসেবে তিনি সংসদে যান। তিনি লন্ডনের হবর্ন অ্যান্ড সেন্ট প্যানক্রাসের সাংসদ হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন। 

২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে ভরাডুবি হয় পর লেবার পার্টির। পার্টির জন্য সবচেয়ে খারাপ সময় ছিল এটা। ১৯৩৫ সালের পর সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে হেরেছিল ওই দল, যা জেরেমি করবিনকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। জেরেমি করবিন লেবার পার্টিকে বামপন্থী এবং মধ্যপন্থীদের মধ্যে ভাগ করেছিলেন। কিন্তু স্টারমার বলেছিলেন তিনি পার্টিকে একত্রিত করতে চান। একই সঙ্গে করবিনের চিন্তাধারাও ধরে রাখতে চেয়েছিলেন।

এমন পরিস্থিতিতে ২০২০ সালে লেবার পার্টির সর্বোচ্চ নেতা হওয়ার সুযোগ পান স্টারমার। এপ্রিলে লেবার পার্টির নেতা হিসেবে দায়িত্ব নেন স্টারমার। জেরেমি করবিনের স্থলাভিষিক্ত হন তিনি। দায়িত্ব নিয়ে দলকে যুক্তরাজ্যের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসেন স্টারমার। 

সমর্থকদের চোখে স্টারমার একজন বাস্তববাদী মানুষ। ভরসা করার মতো রাজনীতিবিদ। সমালোচকদের অনেকের মতে, স্টারমার চৌকস নন। বরং তিনি অনেকটাই ঝিমিয়ে পড়া একজন রাজনীতিক।

প্রতিপক্ষের ‘উপহাসের নিশানায়’ প্রায়ই থাকেন স্টারমার। নিজেকে কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে থাকা এক মানুষ হিসাবে পরিচয় দিয়ে থাকেন তিনি। এক সহকর্মী তার নাম দিয়েছিলেন ‘মিস্টার রুলস! তবে জীবনে একবারই আইনের ফাঁদে পড়েছিলেন ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী। যুবক বয়সে ট্রেডিং পারমিট ছাড়াই আইসক্রিম বিক্রি করতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিলেন তিনি। আইসক্রিম বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল বটে, তবে তার বিরুদ্ধে আর কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। 

সাক্ষাৎকারে তার ব্যক্তিগত বিষয়ে বিশেষ কিছু না বললেও, নিজের ‘প্রতিযোগিতামূলক দিক’টার কথা স্বীকার করেছেন স্টারমার। যুক্তরাজ্যের গার্ডিয়ান পত্রিকাকে তিনি বলেন, আমি হারতে ঘৃণা করি। কেউ কেউ বলে থাকেন (প্রতিযোগিতায়) অংশগ্রহণ করাটাই গুরুত্বপূর্ণ। আমি আবার ওই দলে নেই।

রাজনীতির মাঠে সাড়া ফেলে দেওয়া স্টারমার একজন দক্ষ ফুটবলার। ক্লাব ফুটবলে আর্সেনালের ভক্ত তিনি। অবসর সময়ে ‘ফাইভ–আ–সাইড’ ফুটবল খেলে ক্লান্তি দূর করে থাকেন স্যার কিয়ার স্টারমার।

আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে অনিচ্ছুক স্টারমার সম্পর্কে তার স্ত্রী ভিক্টোরিয়া জানান, ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বেশ হাসি-খুশি ও বিনয়ী। ভিক্টোরিয়া একজন পেশাদার থেরাপিস্ট হিসেবে যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্য বিভাগে কাজ করেন। স্টারমার ও ভিক্টোরিয়া দম্পতির রয়েছে এক ছেলে ও এক মেয়ে, যাদের দুজনই কিশোর-কিশোরী। স্টারমার আগেই জানিয়ে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হলেও তিনি শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টার পর কোনো কাজ করবেন না। কেননা, তার এই সময়টা বরাদ্দ থাকে পরিবারকে দেওয়ার জন্য।

এদিকে ব্রিটেনে বসবাররত বাংলাদেশিরাসহ আরও অনেক দেশের নাগরিকরা স্টারমারকে হয়তো ভালো ভাবে গ্রহণ করতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কারন সম্প্রতি সংবাদমাধ্যম দ্য সান আয়োজিত এক বিতর্ক অনুষ্ঠানে স্টারমার বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশগুলো থেকে যেসব মানুষ আসছেন, তাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে না।

মূলত, কনজারভেটিভ সরকারের রুয়ান্ডা অভিবাসী প্রত্যাবাসন প্রকল্পের সমালোচনা করতে গিয়ে তিনি এমন মন্তব্য করেন।

স্টারমারের এমন মন্তব্যে ক্ষোভে ফেটে পড়ে যুক্তরাজ্যের বাংলাদেশি সম্প্রদায়। প্রতিবাদ জানানো হয়। এমন মন্তব্যে বিপাকে পড়েন এবারের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থীরা। তুমুল সমালোচনার মুখে সুর নরমও করেন স্টারমার। তিনি বলেন, আমি আসলে বাংলাদেশকে আলাদাভাবে বোঝাতে চাইনি। আমাদের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও আমাদের দেশের প্রতি বাংলাদেশি কমিউনিটির অবদানকে আমি ব্যাপকভাবে মূল্যায়ন করি।

বিগত সরকারের আমলে জনগণের জন্য সরকারি সেবার মান কমে যাওয়া এবং জীবনযাত্রার মান নিয়ে মানুষের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়েছেন স্টারমার। ভোটের আগে তিনি এক শব্দের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রচার করেছেন, তা হচ্ছে—পরিবর্তন। সে সময় তিনি বলেছেন, লেবার পার্টি পরিবর্তন আনবে। সে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। তবে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে শিগগিরই উত্তরণের কোনো জাদুমন্ত্র তার কাছে নেই। ধীরে ধীরে তিনি এই পরিস্থিতি থেকে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।   

তবে এই আভাস নির্বাচনের অনেক আগোই দিয়েছিল বার্তাসংস্থা রয়টার্স। এক প্রতিবেদনে বার্তাসংস্থাটি জানায়, সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর স্টারমারকে ডাউনিং স্ট্রিটে আরও কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হবে।

এখন সময়ই বলবে, কতটা কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয় রানী এলিজাবেথের দেশের নতুন প্রধানমন্ত্রীকে। আর তিনি এর থেকে কতটা সফল ভাবে ব্রিটেনকে সামনে দিকে এগিয়ে যাবেন।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫