জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ: লোকসমাজে রইলেন দোষী হয়ে

অরুন্ধতী সুরঞ্জনা
প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৪, ১৬:২৯

অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা বিমানবন্দরে অবতরণের পর দুই হাত উঁচু করে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের উচ্ছ্বাস প্রকাশ। ছবি : এএফপি
দিনে ২৩ ঘণ্টা। এভাবে একটানা ১৯০১ দিন। ছোট্ট এক কক্ষে পুরো বিচ্ছিন্ন হয়ে সময় পার করেছেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। যুক্তরাজ্যের কুখ্যাত বেলমার্শ কারাগার থেকে সম্প্রতি তার মুক্তি মিলেছে। বিনিময়ে বাধ্য হয়ে দোষ স্বীকার করতে হয়েছে। তার অপরাধ? তিনি পৃথিবীর শক্তিধর এমন রাষ্ট্রের গোপন নথি প্রকাশ করেছিলেন (সচেতনভাবেই, ‘ফাঁস করেছেন’ বলা হলো না), এতে ওই রাষ্ট্রের গুমোর ফাঁস হয়ে যায়।
এ রাষ্ট্রের নাম যুক্তরাষ্ট্র। নিয়মের পরাকাষ্ঠে এবং বহুস্তরী নিরাপত্তার শেকলে লুকিয়ে রাখা লেখা ও ভিডিওচিত্র প্রকাশ হওয়ার পর লোকসমাজ জেনে যায়, ইরাকে ও আফগানিস্তানে কীভাবে মার্কিন সেনারা যুদ্ধাপরাধ করেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। মার্কিন ভাবমূর্তি, মোড়লি, ঠাটবাট-সবই পড়ে যেতে শুরু করে।
শরম কতটা পেয়েছিল ওয়াশিংটন, তা বলা মুশকিল, তবে গরম হয়ে উঠেছিল মার্কিন প্রশাসনের ভেতর-বাহির সমগ্রই। নিজের অপরাধ স্বীকার না করে, আত্ম-সমালোচনা না করে, উল্টো প্রকৃত প্রকাশক জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে তারা শাস্তি দিতে উদ্যত হয়। তথ্যমুক্তির মহানায়ক সেই চরম অমানবিক শাস্তি এরই মধ্যে ভোগ করেছেন। তবে সবচেয়ে বড় শাস্তি হলো, শারীরিক মুক্তির জন্য তাকে শেষাব্দি ‘দোষ’ স্বীকার করতে হলো। অথচ ওই নথি প্রকাশই তার প্রকৃত গুণ।
অ্যাসাঞ্জ ‘বাড়ি’ ফিরেছেন। বাড়ি মানে অস্ট্রেলিয়ায়। প্রথম দিকে নিজ দেশই তার পক্ষে সেভাবে দাঁড়ায়নি। এর পরও বর্তমান সরকার তার কারামুক্তির লড়াইয়ে সহযোগিতা করায় অ্যাসাঞ্জ কৃতজ্ঞ। ফিরেই যেমন তিনি অ্যান্থনি আলবানিজকে বলেছেন, ‘আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন।’ কিন্তু এই জীবন তিলে তিলে নষ্ট করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কারাবন্দি জীবন দীর্ঘায়ু হলে তাকে আর জীবন বলা চলে? হয়তো বন্দিদশায় তাকে মারধর করা হয়নি কিংবা তার আঙুলের নখ উপড়ে ফেলা হয়নি; কিন্তু বারবার বর্ধিত বন্দিত্ব আর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ-এ এক বিশেষ ধরনের যন্ত্রণাদায়ক নির্যাতন।
কোভিড মহামারি মানুষকে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে, সামান্য কদিনের বিচ্ছিন্নতা কীরকম শারীরিক ও মানসিক পীড়ন তৈরি করতে পারে। সেখানে অ্যাসাঞ্জ সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে ছিলেন উনিশশ এক দিন। অথচ বাকস্বাধীনতা ও সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা এবং সরকারি কর্তৃপক্ষের নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলার যে অধিকার মানুষকে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান, অ্যাসাঞ্জ কিন্তু সেই কাজটিই করেছিলেন। কর্তৃপক্ষ কীরূপ নির্যাতক হতে পারে, তার একটি উদাহরণ এখানে উল্লেখ করা যাক। অ্যাসাঞ্জ যেসব ভিডিওচিত্র প্রকাশ করেছিলেন, এর একটিতে দেখা যায়, ২০০৭ সালে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে কিছু ইরাকি নাগরিক ও রয়টার্সের দুজন সাংবাদিককে খুন করছেন মার্কিন সেনারা। এ সময় সেনাদের বলতে শোনা যায়, ‘হা হা হা, আমার নিশানা নিখুঁত’, ‘দারুণ’, ‘অব্যর্থ গুলি’। একজন আহত মানুষ যখন হামাগুড়ি দিয়ে কোনোরকমে নিরাপদে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন, হেলিকপ্টার থেকে একজন সেনা নিচে থাকা মার্কিন সেনাদের বললেন, ওই আহতকে যেন আবার গুলি করার অনুমতি তাকে দেওয়া হয় এবং ওই আহতকে যখন মিনিবাসে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, হেলিকপ্টার থেকে একের পর এক গুলি করে বাস ধ্বংস করা হয়েছিল, আর সেই সঙ্গে ওই আহতকে হত্যা করা হয়েছিল। এই সব ভয়াল; কিন্তু সত্য চিত্র প্রকাশ করেছিলেন অ্যাসাঞ্জ।
হ্যাঁ, এখানে প্রশ্ন আছে, তিনি বা তার প্রতিষ্ঠান উইকিলিকস যেভাবে সব তথ্যই কোনো ধরনের বাছ-বিচার বা সতর্কতা ছাড়াই অনলাইনে প্রকাশ করেছেন, এতে অনেক অনাপরাধী ব্যক্তিত্ব ও সূত্রকে তারা ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। ফলে অ্যাসাঞ্জের কাজকে সাংবাদিকতা বলা চলে না। তবে তিনি যে সাংবাদিকতাকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
নথি প্রকাশের পর থেকে অ্যাসাঞ্জ যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ান্টেড তালিকায় ছিলেন। সুইডেনে একটি ধর্ষণ মামলায় গ্রেপ্তার এড়াতে সাত বছর ধরে লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসে আশ্রয় নিয়ে লুকিয়ে ছিলেন অ্যাসাঞ্জ। পরে ২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যের পুলিশের কাছে গ্রেপ্তার হওয়ার পর সে দেশের কারাগারে ছিলেন। মার্কিন আদালতে দোষ স্বীকার করলে এই কারাবাসকেই তার শাস্তি হিসাবে গণ্য করা হবে, আর কারাভোগ করতে হবে না, মার্কিন সরকারের বিচার বিভাগের সঙ্গে এ রকম একটি সমঝোতার পর ব্রিটেন থেকে তিনি মুক্তি পান।