
ক্রমশ অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে ব্রাজিলের ফুটবল। ছবি: সংগৃহীত
ক্রমশ অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে ব্রাজিলের ফুটবল। সাফল্য দূরে থাক, পাঁচবারের বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়নদের এখন চিনতে হয় জার্সির রঙে। বর্তমানে রীতিমতো বিরক্তিকর ফুটবল খেলছে সেলেসাওরা। অথচ একদা ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের নান্দনিক ‘জোগো বোনিতো’ ছন্দে বুঁদ হয়ে থেকেছে পুরো দুনিয়া।
সম্প্রতি ব্রাজিল বিদায় নিয়েছে কোপা আমেরিকার কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে। উরুগুয়ের কাছে টাইব্রেকারে হারের পর ফুঁসে উঠেছে ব্রাজিলের সাবেক ফুটবলাররা। ২০০২ ফিফা বিশ্বকাপজয়ী রোনালদিনহো গাউচা বলেছেন, ‘আমি আর ব্রাজিলের খেলা দেখব না। এই ব্রাজিল দলের কিছু নেই। খেলায় ছন্দ নেই। খেলোয়াড়দের ভালো খেলার ইচ্ছে নেই।’ রোনালদিনহোর বক্তব্যে জয়-পরাজয় নিয়ে কোনো ক্ষোভ নেই। ফুটবল প্রতিযোগিতায় জয়-পরাজয় থাকবেই। কিন্তু ব্রাজিলীয়রা দেখতে চায় ছন্দময় ফুটবল। যে কারণে বিশ্বকাপ জিতেও ১৯৯৪ সালের স্কোয়াড ততটা জায়গা করে নিতে পারেনি ব্রাজিলীয়দের মনে; যতটা পেরেছে ১৯৮২ কিংবা ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপ জিততে না পারা স্কোয়াড। ছন্দময় ফুটবল খেলা জিকো আর সক্রেটিসরা পরিচিতি পেয়েছেন ব্রাজিলের চিরকালীন ‘হিরো’ হিসেবে।
ব্রাজিলের ২০০২ সালের স্কোয়াডকে বলা যায় ‘জোগো বোনিতো’ ফুটবলের শেষ প্রজন্ম। রোনাল্ডো নাজারিও, রিভালদো, রবার্তো কার্লোস, কাফুদের সঙ্গে রোনালদিনহো আর কাকারা ছিলেন ছন্দময় ফুটবলের ধারক। পরবর্তী সময়ে একমাত্র নেইমার ছাড়া কারও খেলায় ব্রাজিলিয়ান ‘ম্যাজিক’ খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু নেইমার যে বড় অভাগা। প্রজন্মের সেরাদের একজন হয়েও বারংবার ইনজুরিতে তিনি নিজে ভুগেছেন, দেশকে ভুগিয়েছেন।
অনেকেই মনে করেন, ব্রাজিলের বর্তমান প্রজন্মের ফুটবলারদের ইউরোপের প্রতি অতিরিক্ত আকর্ষণে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে জোগো বোনিতোর ভবিষ্যৎ। একেবারে কিশোর বয়সে তারা চলে আসছে ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাবে। অথচ ‘ফুটবলের রাজা’ পেলে ক্যারিয়ারের প্রায় পুরো সময় কাটিয়েছেন নিজ দেশের ক্লাবে। জিকো, সক্রেটিস কিংবা রোমারিও আর রোনাল্ডোরা ইউরোপে এসেছেন পরিণত বয়সে। যখন ব্রাজিলের নিজস্ব ফুটবল ছন্দ তাদের পায়ে গেঁথে গেছে। কিন্তু বর্তমান ভিনিসিয়াস জুনিয়ররা কিশোর বয়সেই সাড়া দিচ্ছেন ইউরোপীয় প্রলোভনে। এতে ব্রাজিলিয়ান ক্লাবগুলোর দায়ও কম না। মোটা অর্থের বিনিময়ে তারা অল্প বয়সী খেলোয়াড়দের বিক্রি করছে। রদ্রিগো আর রাফিনহারা ইউরোপের পাওয়ার ফুটবলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে বিসর্জন দিচ্ছে নিজেদের চিরায়ত রীতি। বলা যায়, ফুটবল দর্শনের ভিন্নতার সংঘর্ষ ডোবাচ্ছে ব্রাজিলের ফুটবলকে।
২০১৯ সালের কোপা আমেরিকার পর ব্রাজিল কোনো আন্তর্জাতিক ট্রফি জিততে পারেনি। নেই ২০০২ সালের পর কোনো বিশ্বকাপ। ব্রাজিলের ফুটবল ফেডারেশনের (সিবিএফ) সভাপতি অ্যাডনাল্ডো রড্রিগেজ মনে করেন, ‘ব্রাজিলের ফুটবলের আমূল পরিবর্তনের সময় এসেছে। ইউরোপের পাওয়ার ফুটবলের সঙ্গে টক্কর দিতে ব্রাজিল জাতীয় দলের জন্য প্রয়োজন ইউরোপীয় কোচ।’ যে জন্য তিনি মারিনহো থেকে শুরু করে কার্লো আনচেলত্তির দুয়ারে ধর্না দিয়েছেন। পাননি। আসলে ২০০২ সালের বিশ্বকাপের পর ব্রাজিল বিশ্বকাপের প্রতিটা আসর থেকে বিদায় নিয়েছে কোনো না কোনো ইউরোপীয় দলের কাছে নাকাল হয়ে।
তাতেই ব্রাজিল ফুটবলের সভাপতির মনে জেগেছে ইউরোপীয় প্রেম। কিন্তু সম্প্রতি আর্জেন্টিনার কোচ লিওনেল স্কালোনির দল প্রমাণ করেছে, ফুটবলে ল্যাটিন ধারা এখনো কার্যকর। তিনিই লিওনেল মেসিদের স্কোয়াডে ফিরিয়ে এনেছেন ল্যাটিন ফুটবলের নিজস্বতা।
তাই ফুটবলের ছন্দও এখন খুঁজে পাওয়া যায় আলবেসেলেস্তেদের খেলায়।
রিভালদো বলেছিলেন, ‘ব্রাজিলের বিদেশি কোচ প্রয়োজন নেই। আমাদের দরকার এমন একজন, যার শিরায় ব্রাজিলীয় রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। কোনো সন্দেহ নেই যে বিদেশি কোচরা ভালো। তবে সেলেসাও হচ্ছে আমাদের নিজেদের।’
বিশ্বকাপজয়ী রিভালদোর কথাতে চিরায়ত ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের প্রতি মমত্ববোধ প্রকাশ পেয়েছে। যদিও তিতের পর রেমন মেন্দেজ, ফার্নান্দো দিনিজ পারেননি দলকে গোছাতে। বর্তমান কোচ ডোরিভাল জুনিয়রের চাকরিও কোপা ব্যর্থতার পর থাকবে কিনা সন্দেহ। আর থাকলেও তার ব্রাজিল কি ফিরবে নান্দনিক ফুটবলে? তিনি চাকরি হারালে কে নেবে দায়িত্ব? উত্তরটা দেবে সময়।