Logo
×

Follow Us

আন্তর্জাতিক

‘লাভ জিহাদ’: আসামে নতুন আইনে পুরনো বিদ্বেষ

Icon

স্বর্ণা চৌধুরী

প্রকাশ: ১৩ আগস্ট ২০২৪, ১৯:৩৫

‘লাভ জিহাদ’: আসামে নতুন আইনে পুরনো বিদ্বেষ

প্রতীকী ছবি

ভারতে এখনো প্রেম ব্যক্তিগত বিষয় নয়। এটি যেমন সামাজিক রীতি-নীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত; তেমনি রাজনীতিরও অনুষঙ্গ। ভারতে এখনো ৯০ শতাংশ বিয়ে পরিবারের সিদ্ধান্তে হয়ে থাকে। এক সমীক্ষা বলছে, ভিন্ন ধর্মের নারী-পুরুষের মধ্যে বিয়ের সংখ্যা মোট বিয়ের দুই শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হিন্দু পরিবারই হোক, বা মুসলিম পরিবার; কেউই চায় না তাদের সন্তান অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করুক। বিয়ে ঠেকাতে পরিবারগুলো যে কোনো পন্থা নিতে প্রস্তুত। তারা এমনকি নিজের মেয়ের দুর্নাম ছড়াতেও পিছপা হয় না, যাতে মেয়ের প্রেমিক পিছিয়ে যায়। রাজনৈতিকভাবে হিন্দুত্ববাদী দল ও সংগঠনগুলো এমন বিয়েকে ‘লাভ জিহাদ’ হিসেবে অভিহিত করে; আর এর মাধ্যমে মুসলিম পুরুষদের টার্গেট করা হয়। সেই সঙ্গে থাকে সমাজে মুসলিম-বিদ্বেষ ছড়ানোর কৌশল। 

এবার ‘লাভ জিহাদ’-এর মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হবে বলে নতুন আইন আনছে আসামের বিজেপি সরকার। ৪ আগস্ট আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা এ কথা জানান। তিনি বলেন, ‘আমরা নির্বাচনের সময় লাভ জিহাদের কথা বলেছিলাম। শিগগিরই সেই আইন আনা হচ্ছে, যাতে এই মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় দোষী ব্যক্তির।’

গুয়াহাটিতে রাজ্য বিজেপির বৈঠকে তিনি এ কথা জানান। সেখানে লাভ জিহাদের বিষয়টি ছাড়াও হিমন্ত ঘোষণা করেন, সরকারি চাকরি পেতে হলে আসামে জন্ম হতেই হবে, এমন নিয়ম আনার বিষয়েও চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার। রাজ্য সরকার এক লাখ সরকারি চাকরিতে আসামের আদিবাসীদের অগ্রাধিকার দিয়েছে। পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ হলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। এ ছাড়াও হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে সম্পত্তি বিক্রি নিয়েও নতুন আইনের কথা ভাবছে রাজ্য সরকার।

কয়েক দিন আগে হিমন্ত দাবি করেন, ২০৪১ সালের মধ্যে মুসলিম সংখ্যাগুরু রাজ্য হয়ে উঠবে আসাম। কারণ প্রতি ১০ বছরে মুসলিম জনসংখ্যা ৩০ শতাংশ হারে বাড়ছে। সেখানে প্রতি এক দশকে ১৬ শতাংশ হারে বাড়ছে হিন্দু জনসংখ্যা। যা মুসলিমদের তুলনায় অনেকটাই কম। আসামের মুখ্যমন্ত্রী আরও দাবি করেন, এখনই রাজ্যের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ মুসলিম।

প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে ভারতের কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে মুসলিম-বিদ্বেষ সর্বজনীন রূপ লাভ করে। একই বছরে উত্তর প্রদেশ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের সময় লাভ জিহাদ নগ্নভাবে ব্যবহার করা হয়। কট্টর হিন্দুত্ববাদী দলগুলো এই কথিত লাভ জিহাদ তত্ত্ব ছড়িয়ে বলছে, মুসলিম পুরুষরা হিন্দু নারীদের ইসলামে ধর্মান্তর করার উদ্দেশ্যে প্রেমের ছল দেখিয়ে তাদের বিয়ে করে। ভারতে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির আদর্শিক অভিভাবক হিন্দুত্ববাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) তাদের বিভিন্ন প্রচারমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে লাভ জিহাদের নানা কাহিনি প্রচার করে। আর দীর্ঘসময় ধরে ক্ষমতায় থাকার ফলে তারা এই প্রচার উত্তর প্রদেশ থেকে গোটা ভারতে ছড়াতে সক্ষম হয়েছে।

গবেষক এবং পর্যবেক্ষকরা বলছেন, লাভ জিহাদ নিয়ে অতীতে এবং বর্তমানের প্রচারণার মধ্যে অনেক মিল রয়েছে। তবে বর্তমানের প্রচারণা অনেক শক্তিশালী, কারণ এর পেছনে রয়েছে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক চারু গুপ্তা বলেন, ‘হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলো পোস্টার, গুজব, কানকথা ব্যবহার করে মুসলিম পুরুষদের দ্বারা হিন্দু নারীদের তথাকথিত অপহরণ, ধর্মান্তর, ধর্ষণ, জবরদস্তি করে বিয়ে ঠেকানোর সুপরিকল্পিত প্রোপাগান্ডা শুরু করেছে। এটি তাদের রাজনীতির অন্যতম উপাদান, ধর্মীয় বিদ্বেষ।’

ভারতে ভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে বিয়ের বিরোধিতার ইতিহাস বহু পুরনো। এ নিয়ে ঐতিহাসিক নানা তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। ১৯২০ এবং ১৯৩০-এর দশকে উদ্ভূত সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে উত্তর ভারতের কোথা কোথাও হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীগুলো মুসলিম যুবকদের দ্বারা হিন্দু নারী ‘অপহরণের’ প্রচারণা শুরু করেছিল। মুসলিম পুরুষের বিয়ে করা হিন্দু স্ত্রীদের উদ্ধারের দাবি তোলা হয়েছিল। উত্তর প্রদেশে সে সময় মুসলিমদের দ্বারা হিন্দু নারীদের তথাকথিত অপহরণ বন্ধে হিন্দু একটি সংগঠনও গড়ে উঠেছিল।

এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক চারু গুপ্তা বলেন, ‘স্বাধীনতার আগে এসব প্রচারণা শুধু সংবাদপত্রের ভেতরের পাতাতেই সীমিত থাকত। মূলধারার রাজনৈতিক কোনো দল বা নেতা এসব গুজব কাজে লাগানোর চেষ্টা করতেন না। এখন এসব গুজব এবং প্রচারণা মিডিয়ার প্রথম পাতার খবর এবং রাষ্ট্র এসব আইন তৈরি এবং প্রয়োগের প্রধান উদ্যোক্তা। নারীদের নামে রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের পেছনে মানুষ জড়ো করার চেষ্টা চলছে।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫