ড্রোন-রকেট হামলায় মণিপুর সংঘাতে নতুন মাত্রা

স্বর্ণা চৌধুরী
প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৬:৪৮

মণিপুর রাজ্য যেন শান্তই হচ্ছে না। ছবি: সংগৃহীত
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুর যেন শান্তই হচ্ছে না। নতুন করে সহিংসতা দেখা দিয়েছে। এবারই প্রথমবারের মতো ভারতের মাটিতে কোনো বিদ্রোহী গোষ্ঠী হামলা চালাতে ড্রোন ব্যবহার করেছে। সহিংসতায় অন্তত ছয়জন নিহত হয়েছে। বিষ্ণুপুর ও ইম্ফল পূর্ব জেলার আকাশে বহু ড্রোন দেখা যায়, যা জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, বাসিন্দারা বাড়ির লাইট বন্ধ করে দেন এবং কেউ বাইরে বের হতে সাহস পাননি। সাবেক মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িসহ দুটি স্থানে রকেট হামলা চালিয়েছে কুকি বিদ্রোহীরা। রাজ্যটিতে কুকি ও মেইতেই সম্প্রদায়ের মধ্যে গত বছরের মে মাস থেকে জাতিগত সহিংসতা চলছে। আর তা নিরসনে মণিপুর বা কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।
পুলিশ জানায়, ৬ সেপ্টেম্বর মণিপুরের বিষ্ণুপুর জেলায় অন্তত দুটি ইম্প্রোভাইজড রকেট নিক্ষেপ করেছে বিদ্রোহীরা। এর মধ্যে বিষ্ণুপুরের ত্রংলাওবিতে একটি রকেটের আঘাতে দুটি অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে। আর ময়রাং শহরে সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মাইরেম্বাম কোইরেংয়ের বাসভবনের কাছে আঘাত হেনেছে দ্বিতীয়টি। রকেট হামলায় ৭২ বছর বয়সী এক ব্যক্তি নিহত ও অন্য পাঁচজন আহত হয়েছে। এর ফলে সহিংসতায় বিধ্বস্ত মণিপুরের রাজধানী ইম্ফল উপত্যকায় উত্তেজনা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। এই ঘটনার পর রাজ্যের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। কুকি জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত চূড়াচাঁদপুরের পাহাড় থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরের কোনো এলাকা থেকে রকেটগুলো ছোড়া হয় বলে জানান এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা।
কয়েক দিন ধরে কয়েক দফায় ড্রোন ব্যবহার করে হামলা চালিয়েছে বিদ্রোহীরা। এ ছাড়া বিষ্ণুপুরের বিভিন্ন স্থানে ফাঁকা গুলি ছোড়া হয়, যা জনগণের মধ্যে আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দেয়। মণিপুরের চলমান সংঘাতে এটিই প্রথমবার ড্রোন ও রকেট হামলা ব্যবহার করা হলো। এর আগে ১ সেপ্টেম্বর ড্রোন থেকে বোমা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। সংঘাতের নতুন ঢেউয়ে রাজ্যের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। অতীতে রকেট হামলার নজির থাকলেও ভারতের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ইতিহাসে আগে কখনও এত ব্যাপক পরিমাণে ড্রোন হামলা চালায়নি কোনো বিদ্রোহী গোষ্ঠী।
রকেট হামলার পরপরই রাজ্যজুড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে এবং হামলাকারীদের ধরতে চলছে চিরুনি অভিযান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাজ্য প্রশাসন অ্যান্টি-ড্রোন ব্যবস্থা মোতায়েন করেছে। সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার মোতায়েন করেছে। নামানো হয়েছে অতিরিক্ত সেনা। ইতোমধ্যেই বিদ্রোহীদের কয়েকটি বাঙ্কার নষ্ট করা হয়েছে। বেশ কিছু অস্ত্র উদ্ধারও করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং রাজভবনে গিয়ে দেখা করেছেন রাজ্যপাল এল আচার্যের সঙ্গে। তাকে পুরো পরিস্থিতি সম্পর্কে জানিয়েছেন বিজেপি নেতা। তারও আগে বীরেন সিং শাসক জোটের সব দলের সঙ্গে একটি আপৎকালীন বৈঠক করেন। বৈঠকে বিজেপি ছাড়াও উপস্থিত ছিল নাগা পিপলস ফ্রন্ট ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির প্রতিনিধিরা। গুঞ্জন উঠেছে অশান্ত এই পরিস্থিতিতে পদত্যাগ করতে পারেন মুখ্যমন্ত্রী।
গত বছরের মে মাসে মেইতেই ও কুকি-জো সম্প্রদায়ের মধ্যে সহিংসতা শুরু হয়। সহিংস আক্রমণের ঘটনার পর মেইতেই এবং কুকি একে অন্যের এলাকায় পা রাখতে পারেন না। মণিপুর দুটি অংশে বিভক্ত। মাঝখানে পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং উভয় সম্প্রদায়ের স্বেচ্ছাসেবকদের তৈরি চেকপয়েন্ট।
ভারতের পার্লামেন্ট সদস্য ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক শশী থারুর বলেন, ‘মণিপুরের সাম্প্রতিক ভয়াবহতা গোটা দেশকে নাড়া দিয়েছে এবং পার্লামেন্টকে একেবারে চলনশক্তিহীন করে দিয়েছে। জমি, বিশেষ জাতিগত মর্যাদা, মাদক ব্যবসা ও অভিবাসন নিয়ে মেইতেই ও কুকি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে এক ভয়ংকর দ্বন্দ্বের কারণে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী ছোট রাজ্যটি গত বছরের মে মাসের গোড়া থেকে থেমে থেমে কেঁপে উঠেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের নিরঙ্কুশ ব্যর্থতায় এ গৃহযুদ্ধের আশু কোনো সমাধানও দেখা যাচ্ছে না। অথচ সংঘাত প্রতিনিয়ত নতুন মাত্রা নিচ্ছে।’