
অভিশপ্ত পেইন্টিং। ছবি: সংগৃহীত
চার-পাঁচ বছরের ছোট্ট এক শিশুর ছবি। মলিন মুখের দুঃখ ভারাক্রান্ত ছেলেটির চোখ দিয়ে অঝোরে পড়ছে পানি। দেখলেই এক ধরনের বিষণ্ণতা তৈরি হয়। জনপ্রিয় ‘দ্য ক্রাইং বয়’ নামের এই শিল্পকর্মটিকে অভিশপ্ত তকমা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কী ছিল কারণ?
উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে বাজারে ছড়িয়ে পড়ে ইতালীয় শিল্পী গিয়াভোনি ব্রাগলিনের আঁকা ‘দ্য ক্রাইং বয়’ ছবিটি। একটি সিরিজের অন্তর্গত সবগুলো ছবির মধ্য থেকে আলাদা করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই ছবিটি। পরবর্তী তিন দশকের মধ্যে পঞ্চাশ হাজারের বেশি বিক্রি হয়েছিল অভিশপ্ত বালকের পোর্ট্রেট। বিশেষ করে ইংল্যান্ডে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ছবিটি। কিন্তু আটের দশকে এসে গুঞ্জন শুরু হয়। আশির দশকে ইউরোপে বেশ কিছু বাড়ি অগ্নিদুর্ঘটনার শিকার হয়। তখন প্রায় ১৬টি পুড়ে যাওয়া বাড়িতে এই চিত্রকর্মটি পাওয়া গিয়েছিল। সেসব বাড়ির সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও ছবিটি অক্ষত ছিল। আর তখন থেকেই মানুষজনের মধ্যে বিশ্বাস জন্মে যে, চিত্রকর্মটি অভিশপ্ত।
১৯৮৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডের পত্রিকা ‘দি সান’-এ প্রকাশিত ‘ব্লেজিং কার্স অব দি ক্রাইং বয় পিকচার’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে এক দম্পতির বাড়ি পুড়ে যাওয়ার ঘটনা তুলে ধরা হয়। বাড়িটির প্রায় সব কিছুই পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও কোনো ক্ষতি হয়নি সেই বাচ্চার পেইন্টিং। তখনই অভিযোগ ওঠে ছবিটির ওপর। প্রতিবেদনটিতে দমকল বাহিনীর এক কর্মকর্তা জানান, পনেরোটিরও বেশি বাড়িতে তিনি একই ধরনের অদ্ভুত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন। সব কটি বাড়ির সবকিছু আগুনে পুড়ে গেলেও ছবিগুলোর প্রায় অক্ষত রয়ে গেছে। বিভিন্ন স্থানে খবর নিয়ে এ ধরনের ঘটনার সত্যতা জানা যায়। ‘ভূতুড়ে’ ছবি ঘিরে শোরগোল পড়ে যায়। একই বছরের নভেম্বরে ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় বিপুল পরিমাণে ‘দ্য ক্রাইং বয়’ নামের ছবিটি পোড়ানো শুরু হয়, যা বন ফায়ার নামে পরিচিত।
ছবিটি সত্যিই কি অভিশপ্ত? এ বিষয়ে বিবিসি রেডিওতে ব্রিটিশ লেখক ও কৌতুকশিল্পী স্টিভ পান্ট যুক্তি দেন, ওই ছবিগুলো অগ্নিনির্বাপক পদার্থ দিয়ে বার্নিশ করা হয়েছিল; তাই আগুন স্পর্শ করতে পারেনি ছবিটিকে।
তিনি আরও বলেন, ছবিটি যে স্ট্রিংয়ের সাহায্যে দেয়ালে লাগানো থাকত সম্ভবত আগুনের সংস্পর্শে এসেছিল সেটিই। ফলে সেটি আগুনে পুড়ে দেয়াল থেকে খসে পড়ার সময় উলটো মুখ করে মাটিতে পড়ত। যার ফলে আগুনে সেটার কোনোরকম ক্ষতি হতো না।
কিন্তু কে ছিল ছবির এই বালক? ১৯৬৯ সালের ঘটনা। ইতালির ভেনিসের রাস্তায় ঘুরছিল একটি শিশু। মলিন মুখ আর মায়াময় চাহনির শিশুটির মধ্যে পাদ্রিরা কেন জানি অশুভ আত্মার খোঁজ পান। তারা বাচ্চাটিকে পিশাচ বলে ডাকতে থাকেন। কারও বাসায় বাচ্চাটিকে আশ্রয় পর্যন্ত দিতে নিষেধ করে দেন। তবে গুঞ্জন ছিল, ওই ছেলেটি ছিল স্পেনীয় জিপসি পরিবারের সন্তান। কারও মতে তার নাম ছিল ডন বনিলো, কেউ বলে ডায়াব্লো। আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিল তার বাবা-মা। এরপর যারাই ছোট্ট ছেলেটিকে আশ্রয় দিয়েছেন আগুনে পুড়ে গিয়েছে তাদের ঘরবাড়িও! এমনকি, ছেলেটির ছবি আঁকা হয়েছিল যে স্টুডিওতে, সেটিও আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়! এমনও শোনা যায়, ছোট্ট ছেলেটি নিজেও মারা গিয়েছিল আগুনে পুড়ে।
সান পত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দ্য ক্রাইং বয় সিরিজের বিভিন্ন ছবিতে ‘গিয়াভোনি ব্রাগলিন’ নামে সিগনেচার রয়েছে। কিন্তু এই আর্টিস্ট সম্পর্কে কোনো ধরনের তথ্য পাওয়া যায় না। অনেকের ধারণা, বিভিন্ন ছদ্মনামে আঁকতেন বলে আসল আঁকিয়ে আড়ালে রয়ে গেছেন। তবে ২০০০ সালে প্রকাশিত কিছু অমীমাংসিত গল্পের সংকলন ‘হন্টেড লিভারপুল’-এ এই ছবি সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। বইটিতে বলা হয় জর্জ মেলোরি নামে একজন স্কুল শিক্ষক এই ছবির আর্টিস্টকে উদ্ধার করতে পেরেছিলেন। সেই আর্টিস্টের আসল নাম ছিল ফ্রেঞ্চট সেভিল। পরবর্তী সময় মেলোরি এবং সান পত্রিকার বিভিন্ন সূত্র ধরে জানা যায়, ডন বনিলো নামে এক দরিদ্র বাচ্চাকেই রঙতুলিতে ফুটিয়ে তুলেছেন এই আর্টিস্ট।
আরও একটি গল্প প্রচলিত আছে। জানা যায়, ১৯৭৬ সালের দিকে স্পেনের বার্সেলোনাতে এক সড়ক দুর্ঘটনায় গাড়ির ড্রাইভারসহ পুরো গাড়ি জ্বলে যায় অল্প সময়ের মধ্যেই। জ্বলন্ত ড্রাইভিং লাইসেন্সের খানিকটা অক্ষত অংশ থেকে জানা যায়, গাড়ি চালাচ্ছিল ১৯ বছর বয়সী ডন বনিলো নামের এক কিশোর। কিন্তু এই ছেলের খোঁজ নিতে কেউ আসেনি কখনও। অভিশপ্ত ছবি নিয়ে আলোচনা যখন তুঙ্গে, তখন এই ঘটনা যেন পুনরায় হালে পানি দিল। গাড়িতে জ্বলে যাওয়া ওই ছেলেটির সঙ্গে এই অভিশপ্ত ছবির মিল বের করে ধারণা করা হয় বাচ্চাটির অভিশপ্ত আত্মা এখনও বন্দি রয়েছে ছবিগুলোর মধ্যে!
ইউরোপ থেকে ছড়িয়ে পৃথিবীর সব মহাদেশেই ভেসে বেড়িয়েছে ‘দ্য ক্রাইং বয়’কে ঘিরে জমতে থাকা অদ্ভুতুড়ে গল্প। আগুনের মাঝে অক্ষত এক ছবি থেকে অসহায় মুখের তাকিয়ে থাকা এক বালকের দৃষ্টি অনুসরণ করে শিউরে উঠেছে সারা পৃথিবীর মানুষ।