ফিলিস্তিনি নেতা সিনওয়ার হত্যা: কিন্তু স্বাধীনতার স্বপ্ন খুন হয় না

অরুন্ধতী সুরঞ্জনা
প্রকাশ: ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ১১:১৪

হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার। ছবি: সংগৃহীত
আকস্মিক হামলার এক বছর পর হামাসের নতুন প্রধানকেও হত্যার মাধ্যমে ইসরায়েল আরও বেশি প্রতিরোধ নিতে উসকে দিল গাজার শাসক গোষ্ঠীকে। আর এই অজুহাতে আরও বেশি হারে গণহত্যা চালানোর ন্যায্যতা দাবি করবে তেলআবিব।
ওদিকে ইসরায়েলের যুদ্ধবাদী প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর যুদ্ধবাজ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন এই গণহত্যায় মদদ দেওয়া অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু একই সময়ে নিজেদের গণতান্ত্রিক আদর্শ প্রমাণে এক ধরনের শঠতার আশ্রয় নিয়েছে, গোটা বিশ্ব যা আলোর মতো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের ওপর বর্বর গণহত্যা যেন চলমান থাকে, তা নিশ্চিতে বাইডেন-শিবির নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দলের প্রার্থী ডেমোক্র্যাট কমলা হ্যারিসকে জেতানোর জন্য সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসকে নির্মূলের নামে গাজা উপত্যকায় সামরিক অভিযান চালিয়ে আসছে ইসরায়েল। এরই মধ্যে সেখানে ৪২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছে। এদের বেশিরভাগই নিরীহ শিশু ও নিরস্ত্র নারী। বিদ্যাপীঠ, উপাসনালয়, সেবাকেন্দ্র- ইসরায়েলি হামলার লক্ষ্যবস্তু হওয়া থেকে কোনো কিছুই বাদ যায়নি। এই যুদ্ধ সম্প্রতি লেবাননেও সামরিকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।
গত জুলাই মাসে ইরানের রাজধানী তেহরানে গুপ্তহত্যার শিকার হন হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়া। তাকে হত্যার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করা হয়। হানিয়া হত্যার পর হামাসের সামগ্রিক নেতা হন ইয়াহিয়া সিনওয়ার। তাকেও ইসরায়েল হত্যা করেছে ১৭ অক্টোবর। হত্যার পর সেদিন নেতানিয়াহু ঘোষণা করেন, ‘আজ একটি লক্ষ্য অর্জিত হলো। আজ শত্রুকে ভড়কে দিয়েছি। কিন্তু আমাদের কাজ এখনও অসম্পূর্ণ।’ ইসরায়েলের ‘কাজ’ আসলে কী? গণহারে নির্বিচারে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা। তা হলে মনে রাখতে হবে, কোনোদিনই এই কাজ সম্পূর্ণ হবে না। কারণ যত দিন একজনও ফিলিস্তিনি প্রাণে বাঁচবেন, কিংবা যত দিন আরবরা ইসরায়েলি রক্তলিপ্সার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আওয়াজ তুলবে, তত দিন ইসরায়েল হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকবে।
এখন তো, সিনওয়ারকে হত্যার মধ্য দিয়ে গাজায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার যুক্তিও হারাতে বসছে নেতানিয়াহুর সরকার। কিন্তু যুক্তির কাছেধারে দিয়ে ইসরায়েল কোনোদিন চলাফেরা করেছে কি? এমনকি তাদের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের কাছেও যুক্তির কোনো অর্থ নেই। উল্টো এর আগে সিনওয়ারকে হত্যায় ইসরায়েলকে সহযোগিতার মর্মে ওয়াশিংটন এই হামাস নেতার আস্তানা সম্পর্কে তেলআবিবকে সব ধরনের তথ্য সরবরাহ করেছে এবং বাইডেন প্রশাসন সে কথা গৌরবের সঙ্গে প্রকাশ্যে এনেছে। অথচ সিনওয়ার গত ১২ মাস গাজাতেই ছিলেন। সেখান থেকেই তিনি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামাসের সামরিক প্রতিরোধের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তিনি ভীরু ছিলেন না। অন্যদিকে নেতানিয়াহুকে দেখেছি কদিন পরপর পশ্চিমের এ কোনা ও কোনায় উড়ে বেড়াতে, মিত্রদের কানের কাছে মাছির মতো ভন ভন করে তাকে এই অভিযোগ উত্থাপন করতে শোনা গেছে, যুদ্ধে তার দেশকে মিত্ররা নাকি পর্যাপ্ত অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা দিচ্ছে না।
পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলোয় সিনওয়ারকে ঘাতক ও শয়তান হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। বলা হয়, তিনি ইসরায়েলকে ধ্বংস করার অভিযান নিয়েছেন। আসলে এই ধরনের বয়ানই ইসরায়েলকে সহায়তা করে তাদের সেই কথিত অসমাপ্ত ‘কাজ’ তথা গাজায় ফিলিস্তিনিদের হত্যা করতে। কিন্তু সিনওয়ার ইসরায়েলকে ধ্বংস করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন না। তিনি ব্যস্ত ছিলেন ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের কাজে। এ ক্ষেত্রে ২০১৮ সালের একটি সাক্ষাৎকারের কথা বলা যায়। তিনি ওই সময় বলেছিলেন, ‘আমি বলব না যে, আর যুদ্ধ করতে পারব না। তবে আমি বলছি, আমি আর যুদ্ধ চাই না। চাই গাজায় ইসরায়েলি দখলদারত্বের অবসান। সূর্যাস্তের সময় সৈকতে গিয়ে দাঁড়ালেই দেখা যায়, কিশোর-কিশোরীরা বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে ওপারের জীবন নিয়ে আলাপ করে- পৃথিবীটা কেমন, জীবনই বা কেমন, এ নিয়ে তারা ভাবে, কথা বলে। আমি তাদের স্বাধীন করতে চাই।’
গাজায় একটি শরণার্থী শিবিরে জন্ম হয়েছিল সিনওয়ারের। ইসরায়েলি বাহিনী তাকে দুই দশকের বেশি সময় ধরে কারাবন্দি করে রেখেছিল। তিনি আসলে ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত ফিলিস্তিনি ‘স্বাধীনতা’র সীমাবদ্ধতা মাপতে পেরেছিলেন। তিনি ফিলিস্তিনিদের প্রকৃত স্বাধীনতা এনে দিতে চেয়েছিলেন। ইসরায়েল তাকে ভয় পেয়েছিল, তাকে তাই হত্যা করেছে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার ইচ্ছাকে খুন করা যাবে না।